সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন। কুরআন সুন্নাহর বিধান আকড়িয়ে ধরুন। জেনে রাখুন, মু’জিযা হচ্ছে সম্মানিত নবী রাসূলগণের পক্ষ থেকে প্রকাশিত খোদা প্রদত্ত অলৌকিক ক্ষমতার নাম। মুজি’যার সংজ্ঞা: মু’জিযা হচ্ছে নবী রাসূলদের জন্য খোদা প্রদত্ত ক্ষমতা যা নবীদের থেকে প্রকাশ পায়। যা প্রকৃতির নিয়মনীতির বাইরে, সমগ্র পৃথিবী ও জগতবাসী মুজিযার মুকাবিলা করা অথবা তদ্রুপ প্রকাশ করতে অক্ষম ও ব্যর্থ হয়।
মু’জিযার সংখ্যা: আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রেরিত নবীদের নবুওয়তের সত্যতা প্রমানের জন্য দলীল হিসেবে প্রত্যেক নবীকে একটি দুইটি তিনটি বা ততোধিক মু’জিযা প্রদান করেছেন। সকল নবীদের মু’জিযা সমূহ এককভাবে আমাদের নবী ইমামুল আম্বিয়া হায়াতুন নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দান করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মু’জিযার সংখ্যা সম্পর্কে তাফসীরকার, হাদীস বিশারদ ও ঐতিহাসিকদের বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। ইমাম বায়হাকী (রা.) এর বর্ণনা মতে রাসূলুল্লাহর মু’জিযার সংখ্যা এক হাজার। ইমাম নববী (রা.)’র মতে এক হাজার দুশত, কোনো কোনো আলেমের মতে এর সংখ্যা তিন হাজার। প্রকৃত প্রস্তাবে রাসূলুল্লাহর মু’জিযার সংখ্যা গণনা করা অসম্ভব। তাঁর পবিত্র সত্তা সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের মু’জিযার সমষ্টি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে আল্লাহ তা’আলা এমন সব মু’জিযা দান করেছেন, যা অন্য কোনো নবী রাসূলকে দান করা হয়নি। পৃথিবীর দেশে দেশে বিভিন্ন ভাষায় মু’জিযার উপর অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হলেও রাসূলুল্লাহর সব মু’জিযা গুলো কেউ একত্রিত করতে পারেনি, এটি রাসূলুল্লাহর অসাধারণ শ্রেষ্ঠত্বের সমুজ্জ্বল নিদর্শন, ইমাম বায়হাকী মু’জিযার উপর “দালায়িলুন নবুওয়ত” নামক স্বতন্ত্র কিতাব রচনা করেছেন, আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ুতী (র.) “খাসায়েসুল কুবরা” নামে বিশ্ব ব্যাপী সমাদৃত আলোড়ন সৃষ্টিকারী অনবদ্য কিতাব রচনা করেছেন।
পূর্ববর্তী নবীদের মু’জিযা: জালিম নমরুদ কর্তৃক হযরত ইবরাহীম (আ.) কে জলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত করা হলে অগ্নিকুন্ড গোলজারে রূপান্তর হওয়া, হযরত মুসা (আ.) কর্তৃক লাঠির আঘাতে সমূদ্রের উপর রাস্তা হয়ে যাওয়া, হযরত ঈসা (আ.) কর্তৃক মৃতকে জীবিত করা, কুষ্ঠ রোগী ও জন্মান্ধ ব্যক্তিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়া নবুওয়তের সত্যতার প্রমাণ। হযরত সালেহ (আ.) পাহাড়ের দিকে ইশারা করলে পাহাড়ের বড় পাথর ফেটে দুটুকরো হয়ে যাওয়া এবং তার ভেতর থেকে অতি চমৎকার সুন্দর স্বাস্থ্যবতী উষ্টী এবং তার একটি বাচ্চা বেরিয়ে আসা, এ সবগুলো ছিল পূর্ববর্তী নবীদের মু’জিযা।
আমাদের নবীর মু’জিযা: আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় রাসূলের পবিত্র সত্তার মধ্যে পূর্ববতী সকল নবীদের সকল মু’জিযা একীভূত করেছেন। রাসূলুল্লাহর উপর অবতীর্ণ মহাগ্রন্থ আল কুরআন নবীজির শ্রেষ্ঠতম ও স্থায়ী মু’জিযা। নবীজির মু’জিযার পরিধি ও বিস্তৃতির অন্ত নেই। ভূমন্ডল থেকে নভোমন্ডল, পৃথিবী থেকে আসমানি জগতের পরিভ্রমণ, সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম, উর্ধ্বজগতের আরশে মুয়াল্লায় আরোহন, শাহাদাত আঙ্গুলীর ইশারায় আকাশের চাঁদ দ্বিখন্ডিত করণ, অস্তমিত সূর্য পুনরায় উদয় করা, আঙ্গুল মুবারক থেকে পানির ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করা, এক মুষ্টি খেজুর দিয়ে ক্ষুধার্ত সাহাবায়ে কেরামের বিশাল কাফেলাকে পরিতৃপ্ত সহকারে আহার করানো, বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে কয়েক জন কুরায়শ সর্দারের বধ্যভূমি চিহ্নিত করে নিহতদের বিষয়ে অগ্রিম সংবাদ দেওয়া, খায়বর যুদ্ধে বিজয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করা, হযরত ওমর (রা.) হযরত ওসমান (রা.) ও হযরত আলী (রা.) এর শাহাদাতের সংবাদ, খারেজি সম্প্রদায় সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী ইত্যাদি।
আল কুরআন নবুওয়তের সত্যতার মহিমান্বিত মু’জিযা: আল্লাহর কালাম সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐশী গ্রন্থ আল কুরআনুল করীম রাসূলুল্লাহর শ্রেষ্ঠতম মু’জিযা, যা অনন্তকাল টিকে থাকবে। যাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। যে আসমানী গ্রন্থ পরিপূর্ণ জীবন বিধান, যে কিতাবের যবর যের পেশ দাঁড়ি কমা সহ অদ্যেপ্রান্ত কিয়ামত পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকবে। আল কুরআনের অলৌকিকত্ব। অলংকারিক সৌন্দর্য বিস্ময়কর, যে কুরআনের বানীর সৌন্দর্য, মহত্বের উদারতায় শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় অভিভূত হয়ে পৃথিবীর লাখো লাখো অমুসলিম ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রিত হয়েছেন। এই পবিত্র কিতাবকে আল্লাহ তা’আলা অবিশ্বাসীদের যে কোন হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করেছেন, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আমিই কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই ইহাকে সংরক্ষণ করব। (সূরা হিজর, আয়াত: ৯)
এই কিতাবের সন্দেহকারীদের প্রতি নিম্নোক্ত আয়াতের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, “অর্থ: এবং যদি এই কিতাবের ব্যাপারে তোমাদের কোন সন্দেহ হয়, যা আমি আমার বিশেষ বান্দার উপর নাযিল করেছি তবে এরূপ একটি সূরা নিয়ে এসো এবং আল্লাহ ব্যতীত নিজেদের সকল সাহায্যকারীকে আহ্বান করো যদি তোমরা সত্যবাদী হও। (সূরা: আল বাকার, আয়াত: ২৩)
চন্দ্র দ্বিখন্ডিতকরণ: আকাশের চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি শক্তিশালী মু’জিযা যা পবিত্র কুরআন ও একাধিক সহীহ হাদীস সূত্রে প্রমাণিত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, কিয়ামত সন্নিকটে এসেছে এবং চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়েছে। এবং কাফিররা যদি কোন নিদর্শন দেখে তখন মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলতে থাকে এটা তো চিরাচরিত কোনো যাদু। (সূরা: ক্বামার, আয়াত:১–২)
বর্ণিত আয়াত থেকে প্রমানিত চাঁন্দ দ্বিখন্ডিত হওয়া কিয়ামতের আলামত সমূহের মধ্যে একটি যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে ঘটে যায়। যা মক্কার কাফিররা প্রত্যক্ষ করার পরও ঈমান গ্রহণ করেনি। বরং দুর্ভাগা কাফিররা মন্তব্য করলো মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উপর যাদু করেছেন। (সীরাত–এ মুস্তাফা)
হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, মক্কাবাসীরা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট মু’জিযা দাবী করে যে, আমাদেরকে মু’জিযা প্রদর্শন করুন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয়বার চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করে দেখান তখন লোকেরা হেরা পর্বতের দু’পাশে চাঁদের দু’টুকরো দেখতে পায়। (মুসলিম, হাদীস নং: ৫০১৩)
নবীজির নির্দেশে অস্তমিত সূর্য পুনরায় উদিত হলো: এ কথা সত্য যে, কেবল মু’মিন নয় আল্লাহর অসংখ্য সৃষ্টিরাজি নবীজির নির্দেশের আনুগত্য করে। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসর নামায আদায় করে মাওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কোলে নবীজির মাথা মুবারক রেখে বিশ্রামরত অবস্থায় হযরত আলী (রা.)’র এর আসর নামায কাযা হয়ে গেল। নবীজির খিদমতে নিয়োজিত থাকার কারণে কাসা নামায হওয়ার অনুশোচনায় তিনি যেন চিন্তিত না হয়ে পড়েন নবীজি অস্তমিত সূর্যকে পূনরায় ফিরিয়ে দিতে আল্লাহর সমীপে প্রার্থনা করলে আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবীব দুআ কবুল করলেন। হযরত আসমা বিনতে উমাইস (র.) বর্ণনা করেন, একদা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর ওহী অবতীর্ণ হতে শুরু হয় ঐ সময় তিনি হযরত আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর) এর উরুর উপর মাথা মুবারক রেখে বিশ্রাম করছিলেন তাই হযরত আলী (রা.) আসর নামায আদায় করতে পারেননি, সূর্য অস্তমিত হয়ে যায়, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী (রা.) কে জিজ্ঞেস করলেন হে আলী! তুমি কী আসরের নামায পড়েছো? হযরত আলী বললেন না, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ করলেন হে আল্লাহ নিশ্চয় ‘আলী তোমার ইবাদত ও তোমার রাসূলের আনুগত্যে থাকার কারণে তাঁর নামায কাযা হয়ে গেছে, দয়া করে তাঁর জন্য সূর্য ফিরিয়ে দিন, হযরত আসমা বিনতে উমাইয়া (রা.) বলেন, আমি নিজ চোখে অস্তমিত হওয়া সূর্য পুনরায় উদিত হতে দেখলাম এবং পাহাড়ের চূড়ার উপর এবং ভূপৃষ্টের ওপর চারদিকে সূর্যালোক ছড়িয়ে পড়ল। (তাবরানী, মু’জামুল কবীর, আশ শিফা বিতা‘রীফি হুকুকিল মুস্তফা, খন্ড:১ম, পৃ: ৫৯৩, যুরকানী, ৫ম খন্ড, পৃ: ১১৩, মাদারেজুন নুবুওয়্যাত ২য় খন্ড, পৃ: ২৫৭)
মিরাজুন্ন নবী রাসূলুল্লাহর বিস্ময়কর মু’জিজা: রাসূলুল্লাহর স্বশরীরে জাগ্রত অবস্থায় মিরাজে গমন, সপ্ত আসমান পরিভ্রমণ, সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম, আরশে মুয়াল্লায় দিদারে ইলাহী অর্জন, জান্নাত জাহান্নাম পরিদর্শন, সমগ্র সৃষ্টি রাজির বিষয়ে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্যে কথোপকথন, মুহূর্তের মধ্যে ভূপৃষ্টে অবতরণ যা পবিত্র কুরআন ও অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, আল্লামা যুরক্বানী হাদীস এবং সীরাতের গ্রন্থ সমূহে মিরাজের হাদীস বর্ণনাকারী ৪৫জন সাহাবীর নামসহ উল্লেখ করে মিরাজের বিস্ময়কর ঘটনার সত্যতা উল্লেখ করত এটিকে উল্লেখ যোগ্য মু’জিযা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। (জুরকানী ১ম খন্ড)
আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মু’জিযা সমূহের তাৎপর্য বুঝার তাওফিক দান করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ তসলিম উদ্দিন
খলিফা পাট্টি, কোতোয়ালী, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়া সংক্রান্ত শরয়ী মাসআলা জানালে কৃতার্থ হবো
উত্তর: মৃত ব্যক্তির গোসল প্রসঙ্গে শরয়ী নিয়মনীতি অনুসরণ করা উচিত। মৃত ব্যক্তির গোসল ও কাফন দাফনে বিলম্ব করা সমীচীন নয়। বিনা প্রয়োজনে দেরী করা নাজায়িজ বিলম্ব করার কারণে মৃত ব্যক্তির পেট ফুলে ফেটে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। (মিরআতুল মানাযিহ, খন্ড:২, পৃ: ৪৪৭)
গোসল দেয়ার সময় সমপ্ত শরীরে একবার পানি প্রবাহিত করা ফরজ। তিন বার সুন্নাত। গোসল দেয়ার স্থানে পর্দা করে নেয়া উত্তম। যেন গোসলদানকারী ও সাহায্যকারী ছাড়া অন্যজন দেখতে না পায়। (আলমগীরি, খন্ড:১, পৃ: ১৫৮)
গোসল দানকারী ব্যক্তি মৃতব্যক্তির নিকটাত্মীয় হওয়া উত্তম। নিকটাত্মীয় না থাকলে বা গোসল দিতে না জানলে বিশ্বস্ত এবং পরহেজগার ব্যক্তি গোসল দিবে। (আলমগীরি, খন্ড:১, পৃ: ১৫৯)
পুরুষ লোক পুরুষকে গোসল দিবে, মহিলা মহিলাকে দিবে। মৃত বক্তি ছোট ছেলে হলে মহিলাও তাকে গোসল দিতে পারবে। ছোট মেয়েকেও পুরুষও গোসল দেয়া জায়েজ আছে। (আলমগীরি, খন্ড: ১ম, পৃ: ১৬০)