রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র আবির্ভাব ও তিরোধান বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ
পবিত্র কুরআনের আলোকে নবীজির শুভাগমন: আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আমি তো আপনাকে প্রেরণ করেছি সারা জাহানের রহমত স্বরূপ।” (সূরা: আম্বিয়া, আয়াত: ১০৭)
খোদা প্রদত্ত অনন্ত অফুরন্ত অসীম রহমতের মূর্ত প্রতীক শাফায়াতের কান্ডারী, মুক্তির দিশারী সরওয়ারে কায়েনাত তাজেদারে মদীনা মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাঁর রহমতের ফলগুধারা, আসমান–জমীন, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, তৃণলতা, পাহাড়–পর্বত, নদ–নদী, সমগ্র সৃষ্টি রাজির মধ্যে বিরাজিত ও পরিব্যপ্ত। সমগ্র সৃষ্টিরাজি যার নূরে সৃজিত, শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.) কতই সুন্দর বলেছেন, “মুস্তফা জানে রহমত পে লাখোঁ সালাম, শময়ে বজমে হেদায়ত পে লাখোঁ সালাম।” অর্থ: “মুস্তফা (নির্বাচিত সত্তা) রহমতের প্রাণ সমীপে লাখো সালাম, হেদায়তের আসরের আলোকবর্তিকা তাঁর তরে লাখো সালাম।” মহান আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় রাসূলের শুভাগমন সম্পর্কে আরো এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় তোমাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর এসেছে এবং সুস্পষ্ট কিতাব।” (সূরা: মায়েদা, পারা: ৬, আয়াত: ১৫)
আয়াতে বর্ণিত “নূর” দ্বারা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার সত্বাকে বুঝানো হয়েছে। সুস্পষ্ট কিতাব দ্বারা মহাগ্রন্থ আল কুরআন বুঝানো হয়েছে। নবীজির প্রিয় সাহাবী মুফাসসিরকুল শিরোমনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন, নিশ্চয় তোমাদের পক্ষ থেকে নূর অর্থাৎ মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাশরীফ এনেছেন। (তাফসীরে ইবনে আব্বাস, পৃ: ৭২)
ইমাম জাফর মুহাম্মদ বিন জরীর আত্তাবারী (র.) বর্ণনা করেন, নূর দ্বারা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদ্দ্যেশ্যে। (তাফসীরে ইবনে জরীর, তাফসীরে বায়জাবী, খন্ড:১ম, পৃ: ৪১৮)
পৃথিবীতে শুভাগমন সম্পর্কে স্বয়ং নবীজির বর্ণনা: দোজাহানের সরদার সরওয়ারে কায়েনাত, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং নিজের শুভাগমন সম্পর্কে এরশাদ করেছেন, আমি তোমাদেরকে আমার জীবনের সূচনা প্রসঙ্গে বলব (আমি হলাম) ইবরাহীম আলাইহিস সালাম’র দুআ, ঈসা আলাইহিস সালাম’র সুসংবাদ, আমার আম্মাজানের স্বপ্ন, যা আমার জন্মের সময় আম্মাজান দেখেছেন, তাঁর জন্য একটি নূর বের হলো, যে নূরের আলোকে সিরিয়ার প্রাসাদগুলো আলোকিত হয়ে গেল। (মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস নং: ৫৭৫৯)
প্রিয় নবীর আবির্ভাব: নবীজির পিতা হযরত আবদুল্লাহর ইন্তেকালের ৫মাস পর ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের সময় মক্কার শ্রেষ্ঠ কুরাইশ বংশের হাসেমী গোত্রে নূর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেন।
দুগ্ধপান:
রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মের পর প্রথম সাত দিন পর্যন্ত নিজ মাতা হযরত মা আমেনা (র.)’র দুগ্ধ পান করেন। আবু লাহাবের দাসী সুয়াইবার দুগ্ধ পান করেন ৮ দিন। ধাত্রী মা হযরত হালীমা বিনতে সাদিয়ার দুগ্ধ পান করেন ২ বছর।
মা আমেনা (র.)’র ইন্তেকাল: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ৬ বৎসর বয়সে ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মা আমেনা (রা.) ইন্তেকাল করেন, এরপর এক বৎসর তিনি চাচা হযরত আবদুল মুত্তাবিল’র নিকট লালিত পালিত হন।
চাচা আবদুল মুত্তালিবের ইন্তেকাল: ৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ৮ বৎসর ২ মাস ১০ দিন বয়সে চাচা আবদুল মুত্তালিবের ইন্তেকাল হয়। ১০ বৎসর বয়সে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র শরহে ছদর বা সীনা মুবারক বিদীর্ণ করা হয়। ১২ বৎসর ২ মাস ১০ দিন বয়সে চাচা আবু তালেবের সঙ্গে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করেন। এ সময়ে “হিলফুল ফুজুল” নামক সেবা মূলক সংস্থা গঠন করেন। ২৪ বছর বয়সে ২য় বার হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাঙ্গে শাম দেশে বাণিজ্যে গমন করেন। ২৫ বৎসর ২ মাস ১০ দিনে উপনীত হলে হযরত খাদীজাতুল কুবরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তখন হযরত খাদীজা (রা.)’র বয়স ছিল ৪০ বৎসর। বিবাহের সময় নবীজির বয়স ছিল ২৫ বছর। ৪০ বৎসর বয়সে হেরাগুহায় সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআন অবর্তীণ হয়।
রাসূলুল্লাহর সন্তান সন্ততি: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্তান–সন্ততি, যথাক্রমে হযরত কাসিম, আবদুল্লাহ, যয়নাব, রুকাইয়া (রা.), উম্মে কুলসুম (রা.), হযরত ফাতিমা (রা.), এরা সকলে হযরত উম্মুল মুমেনীন হযরত খাদীজা (রা.)’র গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন। আবদুল্লাহর দুটি ডাক নাম ছিল তায়্যিব ও তাহির। হযরত কাসিম ২ বছর বয়সে ও হযরত আবদুল্লাহ শৈশবে নবীজির নবুওয়ত প্রকাশের পরই ইন্তেকাল করেন। একমাত্র ইবরাহীম হযরত মারিয়া কিবতিয়ার (রা.)’র গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত ইবরাহীম ৮ম হিজরিতে জন্মলাভ করেন, ১০ম হিজরিতে মাত্র ১৬ মাস বয়সে ইন্তেকাল করেন। রুকাইয়া (রা.) ২য় হিজরি, হযরত যায়নাব ৮ম হিজরি, হযরত উম্মে কুলসুম ৯ম হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। নবীজির এ তিন কন্যার ইন্তেকাল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। নবীজির ৪র্থ কন্যা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমা (রা.) ১১ হিজরি সনের জিলক্বদ মাসে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। নবীজির ওফাতের পর একমাত্র হযরত ফাতেমা (রা.) জীবিত ছিলেন। (আছাহহুর ছিয়ব, কৃত: মাওলানা আবদুর রহীম।)
নবুয়ত পরবর্তী মদীনার জীবন: মদীনায় হিজরত: প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৮ রবিউল আউয়াল ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদীনায় হিজরত করেন।
মসজিদে কুবা স্থাপন: প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১২ রবিউল আউয়াল ২৭ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে সোমবার দুপুরে মদীনার কুবা পল্লীতে উপনীত হন এবং সেখানকার স্থানীয় মুসলমানদের নিয়ে প্রথম মসজিদ স্থাপন করলেন, এটা মসজিদে কুবা নামে পরিচিত।
প্রথম জুম’আর সালাত আদায়: কুবা হতে মদীনায় যাওয়ার পথে কুনিয়া উপত্যকার মসজিদে হযরত বনী সালেম গোত্রের পল্লীতে ১০০ জন সাহাবাদের নিয়ে জুমার সালাত আদায় করেন। এটা ছিল ইসলামী জগতে প্রথম জুম’আর সালাত।
মসজিদে নববী নির্মাণ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নাজ্জার গোত্রের দুই কিশোর সাহল ও সুহাইলের নিকট হতে মসজিদের জন্য জায়গা ক্রয় করে মসজিদে নববী নির্মাণ করেন।
১১ হিজরির সফর মাসের শেষ বুধবার নবীজির অসুস্থতা থেকে একটু সুস্থতাবোধ করলেন, হযরত আয়েশা (রা.) কে ডেকে বললেন, আমার জ্বর কমে গেছে আমাকে গোসল করিয়ে দাও নবীজিকে গোসল করানো হলো।
৮ রবিউল আউয়াল অসুস্থতা বেড়ে যায়, ১১ রবিউল আউয়াল রবিবার রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র চাচা হযরত আব্বাস (রা.) তাঁকে লাদুদ নামক ঔষধ খাইয়ে দেন।
রাসূলুল্লাহর ওফাত: ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার ৬৩ বৎসর বয়সে বিশ্বশান্তির অগ্রদূত স্রষ্টার শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশাল কর্মময় জীবনের অবসান ঘটিয়ে তাঁর মওলায়ে হাকীকী রাব্বুল আ’লামীনের সান্নিধ্যে চলে যান তাঁর মোট জীবনকাল ২২৩৩০ দিন ৬ ঘণ্টার মত।
গোসল দান: হযরত আলী (রা.) হযরত আব্বাস (রা.), হযরত আব্বাসের দুই ছেলে ফজল ও কুছাম উসামা বিন যায়েদ গোসল করালেন ১৩ই রবিউল আউয়াল মঙ্গলবার দিবাগত রাত্রে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হযরত আয়েশা (রা.)’র ঘরে দাফন করা হয়। (“আল বিদায় ওয়ান নিহায়া”, খন্ড: ৫ম, পৃ: ২৫৪–২৫৬, নবীয়ে রহমত এক নযরমে, কৃত: মাওলানা মোহাম্মদ আলী)
উল্লেখ্য যে নবীজীর জানাযায় কোন ইমাম ছিল না, মুক্তাদিও ছিলনা, হাদীস বিশারদদের বর্ণনা মতে প্রমানিত, সাহাবায়ে কেরাম হুজরা মুবারকে প্রবেশ করে খাটের সন্নিকটে গিয়ে প্রত্যেকে একা–একা দরুদ–সালাম পেশ করে একদল বের হওয়ার পর আর একদল প্রবেশ করতেন, প্রথম পূরুষগন, তারপর মহিলাগন, তারপর ছোট ছোট বালকগন, মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে যে ভাবে নবীজির উপর দরুদ সালাম পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন, নবীজির ইন্তেকালের পরও অনুরূপভাবে দরুদ সালামের হাদিয়া পেশ করা হয়েছিল। এটাও ছিল নবীজির সুমহান মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক। (মাওয়াহিবে লুদুন্নিয়া কৃত: আল্লামা শিহাব উদ্দিন কুস্তুলানী (র.), আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড: ৫ম, পৃ: ২৬৫)
সালাম জানাই ওহে রাসূল, মানবতার শাহানশাহ, হে নবী সালাম, সাল্লাল্লাহু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহু! হে আল্লাহ, মুসলিম উম্মাহকে আপনার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জীবনাদর্শ অনুসরন করার তাওফিক নসীব করুন। নিশ্চয় আপনি মহান দানশীল রাজাধিরাজ পুণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।