ইসলামে মহররম ও আশুরার গুরুত্ব
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন। সত্যকে মনে প্রাণে গ্রহণ করুন। জেনে রাখুন ইসলামে মহররম ও আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। পৃথিবী সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে সংঘটিত অসংখ্য ঘটনাবলীর স্মারক মহররম ও আশুরা। সর্বশেষ ৬১ হিজরির ১০ই মহররম কারবালার প্রান্তরে জালিম অত্যাচারী কুখ্যাত এজিদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে নবীজির প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) স্ব–পরিবারে ৭২ জন আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে শাহাদাতের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক হৃদয় বিদায়ক মর্মস্পশী ঘটনা।
পবিত্র কুরআনের আলোকে শহীদগণ জীবিত:
আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত রাখার জন্য জালিমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যারা নিহত হন তাঁদের জন্য রয়েছে অসংখ্য নিয়ামত ও কল্যাণের সু–সংবাদ। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলোনা, প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পারনা। (২–সূরা, আল বাকারা, ১৫৪)
আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাঁদেরকে মৃত বলে ধারণা করোনা, প্রকৃতপক্ষে তাঁরা জীবিত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে রিযক প্রাপ্ত। (৩–সূরা আলে ইমরান, ১৬৯)
মহররম ও আশুরার গুরুত্ব:
কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার পর মহররম ও আশুরা মুসলমানদের জন্য বিষাদের বার্তা বয়ে আনে। এ দিন ত্যাগের দিন, মুসলমানদের আত্নবিসর্জনের দিন। এ দিন ইবাদত বন্দেগী নফল নামায, রোযা পালন, দান সাদকার মাধ্যমে শোহাদায়ে কেরামের প্রতি ঈসালে সওয়াবের দিন। তাঁদের জীবনাদর্শ স্মরণে মাহফিল, সভা, সেমিনার ও আলোচনা করার দিন। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, রমজান শরীফের রোযার পর আল্লাহর মাস মহররমের রোযাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ। এবং ফরজ নামাযের পর শ্রেষ্ঠ নামায হচ্ছে রাতের নামায তথা তাহাজ্জুদের নামায। (মুসলিম শরীফ, মিশকাত শরীফ, পৃ: ১৭১)
আশুরার দিনে চার রাকাত নফল নামাযের ফযীলত:
রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে চার রাকাত নামায আদায় করবে প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহার পর সূরা ইখলাস এগারবার পড়বে আল্লাহ তা’আলা তার পঞ্চাশ বৎসরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন এবং তার জন্য একটি নূরের মিম্বর তৈরী করবেন। (নুজহাতুল মাজালিস, ১ম খন্ড, পৃ: ১৪৬, আনোয়ারুল বায়ান, ১ম খন্ড, পৃ: ২৪৪)
আশুরার রাতে নফল নামাযের ফযীলত:
হুযুর গউসুল আযম বড়পীর হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি আশুরার রাতে চার রাকাত নফল নামায পড়বে প্রতি রাকাতে আলহামদু শরীফ সূরা ইখলাস পাঠ করবে আল্লাহ তা’আলা তার বিগত পঞ্চাশ বৎসর ও ভবিষ্যৎ পঞ্চাশ বৎসরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। (গুনীয়াতুত তালেবীন ২য় খন্ড, পৃ: ৫৪, আনোয়ারুল বয়ান, ১ম খন্ড, পৃ: ২৪৪)
হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র ইবাদত:
আল্লামা ইবনুল আছীর জাযরী (র.) বর্ণনা করেন, হযরত সায়্যিদুনা ইমাম হোসাইন (রা.) অধিকহারে নামায পড়তেন, রোযা রাখতেন, হজ্ব করতেন, সাদকা ও খায়রাত দিতেন এবং সকল প্রকার কল্যাণ মূলক কাজে অংশ গ্রহণ করতেন। (উসদুল গাবা, হাদীস: ১১৭৩)
আশুরার দিবসের আমল:
আশুরা দিবসে ফজিলত লাভের উদ্দ্যেশে গোসল করা একটি উপকারী আমল। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে গোসল করবে সেই ব্যক্তি মৃত্যুর ব্যাধি ছাড়া কোন প্রকার রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে না। (গুনীয়াতুত্ তালেবীন: খ ২, পৃষ্ঠা ৫৩)
১০ মহররম আল্লাহর দরবারে অধিকহারে তাওবা করা উচিত। এদিনে আল্লাহ্ দ্রুত তাওবা কবুল করেন। আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত মুসা আলায়হিস্ সালামকে নির্দেশ দিলেন তিনি যেন তাঁর জাতিকে আল্লাহর দরবারে তাওবা করার নির্দেশ দেন। আল্লাহ্ বলেন, আমি সকলের গুনাহ মার্জনা করবো। (ফয়জুল কদীর, শরহে জামে সগীর: খ ৩, পৃষ্ঠা ৩৪)
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদি. থেকে বর্ণিত আছে, এ দিবসে যে ব্যক্তি নিজ চোখে সুরমা ব্যবহার করবে তার চক্ষু নিরাপদ থাকবে, চক্ষু রোগের শিফা হিসেবে সুরমা ব্যবহার ফলপ্রসূ হবে। এরশাদ হয়েছে, তার চক্ষু কখনো ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে না। (বায়হাক্বী)
কারবালার মরু প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে জালিম কুখ্যাত ইয়াজিদ বাহিনী ইমাম আলী মকাম শহীদে কারবালা ইমাম হোসাইন রাদি. সহ আহলে বায়তে রসূলকে কঠিন পিপাসার্ত অবস্থায় এক ফোঁটা পানি থেকেও বঞ্চিত করেছিল। এ অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে ও ঘৃণা প্রদর্শন করত: যারা শোহাদায়ে কেরামের স্মরণে কোন বান্দাকে পানির শরবত পান করাবে তাদের মর্যাদা প্রসঙ্গে এরশাদ হযেছে, যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে পানি পান করাবে সে যেন কিছুক্ষণের জন্য আল্লাহর নাফরমানী করলনা। (অর্থাৎ সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কাজ করলো)। (গুনীয়াতুত্ তালেবীন: খ ২, পৃষ্ঠা ৫৪)
মহররম মাসে সংঘটিত ঘটনাবলী:
ইসলামী বর্ষের প্রথম মাস মহররম। ইসলাম আগমনের পূর্বে ও পরে সর্বদা এ মাসের সম্মান বহাল ছিল। এমনকি জাহেলী যুগের লোকেরাও এ মাসটিকে সম্মান করতো, এ মাসে তারা অন্যায় অবিচার জুলুম নির্যাতন যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে বিরত থাকতো। এ মাসে সংঘটিত ঘটনাবলীর আংশিক উপস্থাপনা করা হলো:
১. হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর তাওবা আশুরা দিবসে কবুল হয়েছে। ২. হযরত ইউনুস আলাইহিস সালাম মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভ করেছেন। ৩. হযরত নুহ আলাইহিস সালাম মহাপ্লাবনের সময় কিস্তি থেকে নিরাপদে অবতরণ করেছিলেন। ৪. হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম আশুরা দিবসে জন্ম লাভ করেন। ৫. হযরত ঈসা এ দিবসে জন্ম গ্রহণ করেছেন। (ফয়জুল কদীর, শরহে জামে ছগীর, ৩য় খন্ড, পৃ: ৩৪) ৬. হযরত ইবরাহীম (আ.) আশুরা দিবসে নমরুদের জলন্ত অগ্নিকুন্ড থেকে পরিত্রাণ লাভ করেন। ৭. হযরত আইয়ুব আলাইহিস সলাম কঠিন রোগ থেকে শেফা লাভ করেছেন। ৮. হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সলাম চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছিলেন। ৯. হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম কুপ থেকে পরিত্রাণ লাভ করেন। ১০. হযরত সোলায়মান আলাইহিস সালাম গোটা পৃথিবীর বাদশাহী রাজত্ব লাভ করেন। ১১. হযরত মুসা আলাইহিস সালাম এ দিনে জন্ম লাভ করেন এ দিনে যাদুকরদের উপর বিজয়ী হন। (আজায়িবুল মাখলুকাত, পৃ:৪৪), ১২. এ দিনে সর্বপ্রথম আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। ১৩. আশুরার দিনে বাগদাদ থেকে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে পঞ্চাশ মাইল এবং ইউফ্রেটিস নদী থেকে ছয় মাইল পশ্চিমে অবস্থিত কারবালা প্রান্তরে ৬১ হিজরি ১০ মহররম নবীজির প্রাণ প্রিয় দৌহিত্র জান্নাতের যুবকদের সর্দার ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু স্বপরিবারে শাহাদাতের স্বর্গীয় সুধা পান করেন। ১৪. এ দিবসে পৃথিবী ধ্বংস হবে কিয়ামত সংঘটিত হবে। (গুনীয়াতুত তালেবীন, পৃ: ৪২৯, মাসাবাতা বিসসুন্নাহ পৃ: ২২, আনোয়ারুল বয়ান, ১ম খন্ড, পৃ: ২৪১)
আশুরার তাৎপর্য ও শিক্ষা:
সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল অবিচল থাকার অঙ্গীকারের দিন আশুরার দিন। কারবালা ও আশুরার চেতনার নামে পথভ্রষ্ট শিয়াদের সাহাবা বিদ্বেষী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ইমাম হোসাইন ও আহলে বায়তের স্মরণের নামে তাজিয়া মিছিল করা, হায় হোসাইন হায় হোসাইন বলে শরীরের রক্ত প্রবাহিত করা, ঢাক ঢোল পিটিয়ে তবলা ও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আশুরা দিবসের ত্যাগের ইতিহাসকে কলংকিত করা ও শিয়াবাদ প্রতিষ্ঠার সকল প্রকার ঘৃণ্য অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানো প্রতিটি মু’মিন মুসলমানদের ঈমানী দায়িত্ব। আল্লাহ তা’আলা মুসলিম মিল্লাতকে হোসাইনী আদর্শের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী); খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।