জুম্‌’আর খুতবা

ইসলামে হিজরি সনের গুরুত্ব

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৫ জুলাই, ২০২৪ at ৭:০৯ পূর্বাহ্ণ

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!

আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! জেনে রাখুন! ইসলামের ইতিহাসে হিজরতের গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র মক্কা থেকে মদীনার বুকে নবীজির হিজরত এক উজ্জ্বলতম অধ্যায়ের সূচনা করেছে। হিজরত শুধু মহানবীর জীবনে নয় বরং ইসলামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নবুয়্যত ঘোষিত হয়। চরম প্রতিকূলতার মধ্যে সূদীর্ঘ ১৩ বছর মক্কায় পবিত্র ধর্ম ইসলাম প্রচার করেন, সর্বত্র মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর অনুসারীদের উপর কাফির মুশরিকদের নির্মম নিপীড়ন নির্যাতন, এমন নাজুক ক্রান্তিকালে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী মারফত আদিষ্ট হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে ইয়াসরিবে হিজরত করেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর জন্য বাড়িঘর ত্যাগ করেছেন এবং আল্লাহর পথে নিজ সম্পদ ও জীবন দিয়ে যুদ্ধ করেছে আর ঔইসব লোক যারা আশ্রয় দিয়েছে ও সাহায্য করেছে তারা পরপর পরম্পরের উত্তরাধিকারী। (সূরা: আনফাল, পারা, ১০, আয়াত: ৭২)

হিজরত অর্থ: হিজরত আরবি শব্দ, হিজর ধাতু থেকে নির্গত, এর অর্থ প্রস্থান করা, ত্যাগ করা, গমন করা, বিরত থাকা, বিচ্ছেদ দেশত্যাগ করা বা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করা। ইসলামী পরিভাষায় ইসলামকে বিজয়ী ধর্ম হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে পবিত্র মক্কা থেকে মদীনায় গমন করাকে হিজরত বলে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আল্লাহর প্রেরিত কোনো নবী রাসূল নিজ দেশবাসী কর্তৃক সম্মানিত হননি তাঁরা নিজ মাতৃভূমি থেকে হিজরত করে সম্মানিত হয়েছেন, দোজাহানের নবী রাসূলুল্লাহর ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি।

পবিত্র আল কুরআনের আলোকে গণণার মাস বারটি: হিজরি সনের সম্পর্ক চন্দ্রের সাথে। আকাশে উদিত নবচন্দ্র মুসলমানদের সময় নির্ধারণী ক্যালেন্ডার। বার মাসে এক বৎসর। ইসলামী নববর্ষের সূচনা সৃষ্টির আদিকাল থেকে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে গণনার মাস বারটি, তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ বা সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করোনা। আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেতভাবে যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে রয়েছেন। (সূরা: তাওবা, আয়াত: ৩৬)

আয়াতে উল্লেখিত বারটি মাসের নাম তাফসীরে উল্লেখ হয়েছে এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত তাফসীরকার আবু মুহাম্মদ হুসাইন বিন মসউদ আল ফারা আল বাগভী (রহ) বর্ণনা করেন, “নিশ্চয় মাসগুলোর সংখ্যা আল্লাহর নিকট বারটি। যথাক্রমে মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলক্বদ, জিলহজ্ব এ বিধান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী। কারো মতে এ বিধান লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত তথ্য মোতাবেক। (তাফসীরে মায়ালিমুত তানযীল, খন্ড:, পৃ: ২৮৯)

হিজরি সনের সূচনা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিজরতকে চিরস্মরনীয় করে রাখার জন্য হিজরতের ১৭ বছর পর খোলাফায়ে রাশেদীনের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইসলামী হিজরি সন প্রবর্তন করেন। বোখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ “ফাতহুল বারী” ৩৭১৯ নং হাদীসের ব্যাখ্যায় হিজরি সনের সূচনার প্রেক্ষাপট বর্ণিত হয়েছে। আমিরুল মু’মিনীন খলিফা হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফত কালে তৎকালীন কুফার গভর্ণর হযরত আবু মুসা আশয়ারী রাদ্বিয়াল্লাহু হযরত উমর (রা.)’র খিদমতে পত্র যোগে এ মর্মে আবেদন করেন, যে আমিরুল মু’মিনীন! আপনার পক্ষ থেকে প্রেরিত রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট আদেশ নির্দেশ পরামর্শ সম্বলিত যে সব চিঠিপত্র আমরা পেয়ে থাকি তাতে সন ও তারিখ উল্লেখ না থাকায় সময় ও কাল নির্দ্ধারণ করে কার্য সম্পাদনে আমরা যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হই, এ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সুষ্ঠ সমাধান কল্পে হযরত উমর (রা.) শীর্ষ স্থানীয় সাহাবায়ে কেরামের একটি পরামর্শ সভা আহবান করলেন, উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম থেকে তিনি এ বিষয়ে গঠনমূলক পরামর্শ ও মতামত কামনা করলেন। প্রত্যেকে স্বস্ব মতামত ও প্রস্তাব উপস্থাপন করলেন। একদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জন্ম দিবস কে করার প্রস্তাব করেন, কিছু সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নবুওয়ত প্রকাশের দিবসকে করার মতামত দেন, কোনো কোনো সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ওফাত দিবসকে ইসলামী বর্ষের সূচনা হিসেবে নির্ধারণের প্রস্তাব করেন। আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে মদীনা হিজরত করেছিলেন যে তারিখে সেদিনটিকে হিজরি সনের তারিখ হিসেবে নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেন সর্বশেষ এ প্রস্তাবটি গৃহীত ও অনুমোদিত হয়। ঐতিহিাসিক মুহাম্মদ ইবন ইসহাক বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১লা রবিউল আউয়াল সোমবার মদীনা মুনাওয়ারা রওয়ানা হন, ৮ রবিউল আউয়াল সোমবার দ্বিপ্রহরে কুবা পল্লীতে উপস্থিত হন, আল্লামা ইবন হাযম ও হাফিজ মুগলতাঈ এ অভিমত ব্যক্ত করেন। (যারকানি, খন্ড:, পৃ: ৩৫১)

রবিউল আউয়াল মাসের পরিবর্তে মহররম মাসকে হিজরি সনের প্রথম মাস হিসেবে এ জন্য করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহররম মাস থেকেই হিজরতের ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন।

মুসলমানদের ধর্মীয় ইবাদত বন্দেগী: রোজা, হজ্ব, ১লা শাওয়াল ঈদুল ফিতর, ১০ যিলহজ্ব ঈদুল আযহা, ১০ মহররম পবিত্র আশুরা, সফর মাসের শেষ বুধবার আখেরী চাহার সোম্বা, ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ১১ রাবিউস সানী ফাতেহায়ে ইয়াজদাহম, ২৭ রজব পবিত্র মেরাজ্জুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ১৪ শাবান পবিত্র শবে বরাত, ১৭ রমজান বদর দিবস, ২৭ রমজান শবে কদর, সাহাবায়ে কেরামের জন্ম ও ওফাত সন ও তারিখ আউলিয়ায়ে কেরামের জন্ম ও ওফাত বার্ষিকী হিজরি সনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। হিজরত ইসলামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। হিজরতের মাধ্যমে ইসলাম বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত হয়। মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। হিজরতের পরই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান প্রণীত হয়। যা মদীনার সনদ নামে পরিচিত। হিজরতের ফলে ইসলাম আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করে। ইসলামের শান্তি ও সাম্যের বাণী পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। হিজরত ভ্রাতৃত্ববোধ মমত্ববোধ সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির চেতনাবোধ জাগ্রত করে। মক্কা থেকে হিজরতকারী মুহাজির ও মদীনাবাসী আনসারদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মুসলিম উম্মাহর পারস্পরিক ঐক্য সংহতি ও ভ্রাতৃবোধের এক অনুস্মরণীয় দৃষ্টান্ত। হিজরতের মাধ্যমেই সর্বকালের সর্বযুগের সর্ব শ্রেষ্ঠ অনুস্মরণীয় আদর্শ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর মনোনীত পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান পবিত্র ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হিজরি সন ত্যাগের স্মারক। নবীজির আদর্শের উত্তরাধিকার সাহাবায়ে কেরাম তাওহীদ ও রিসালাতের ঝান্ডাকে সমুন্নত রাখার দৃঢ় প্রত্যয়ে ধন সম্পদ পরিবার পরিজন ও মাতৃভূমি ত্যাগ করে মিল্লাতের ভিত সুদৃঢ় করেছেন। তাঁরা মিল্লাতের রাহবার, চেতনার বাতিঘর। আসুন সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে প্রাত্যহিক জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য এবং হিজরতের মহান শিক্ষায় আমরা সমাজকে আলোকিত করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

আহমদ হোসেন কাদেরী

দোহাজারী, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: ঈদে গদীরে খুম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানালে উপকৃত হব।

উত্তর: গদীর অর্থ পুকুর বা কুপ, খুম জায়গার নাম। এটি মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম। দশম হিজরির বিদায় হজ্বের শেষে মক্কা থেকে মদীনায় ফেরার পথে এ স্থানে ১৮ জিলহজ্ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি খুত্‌বা পেশ করেন। এ খুত্‌বায় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী (রা.) ও আহলে বায়ত তথা নবীজির পবিত্র বংশধরগণের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষন করতে নিষেধ করেছেন। কারো কারো অন্তরে কোনো কারণে হযরত আলী (রা.)’র প্রতি মনোমালিন্য ছিল, কারো অন্তরে যেন আলী (রা.)’র প্রতি শত্রুতা ও বিষন্নতা না থাকে নবীজি হযরত আলী (রা.) ও আহলে বায়তের মর্যাদা বিষয়ক এ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন। হযরত আলী (রা.) ও আহলে বায়তের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন ঈমানের অপরিহার্য দাবী। এ খুত্‌বার সাথে ইমামত ও খিলাফতের কোন সম্পর্ক নেই। পথভ্রষ্ট শিয়ারা গদীরে খুমের হাদীসের অপব্যাখ্যা করে হযরত আলী (রা.)’র ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন করে থাকে, তারা হযরত আলী (রা.) কে রাসূলুল্লাহর পরই খলিফা মনে করে। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হযরত উমর (রা.) ও হযরত উসমান (রা.) তিনজনের খিলাফত কে অস্বীকার করে। অথচ হযরত আলী (রা.) ইসলামের চতুর্থ খলিফা হওয়ার বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। শিয়ারা ১৮ জিলহজ্ব ঈদে গদীরে খুম নামক উৎসব পালন করে মাওলা আলী (রা.)’র শান বর্ণনার আড়ালে সাহাবায়ে কেরামকে গালিমন্দ কটূক্তি ও সমালোচনা করে। যা সুস্পষ্টভাবে হারাম ও কুফরি। ঈদে গদীরে খুম শিয়াদের একটি উৎসবের নাম। বিগত সাড়ে চৌদ্দশত বৎসরের ইতিহাসে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী ইমাম মুজতাহিদগণ ঈদে গদীরে খুম পালনের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। (বিস্তারিত, রদ্দুর রিফযাহ কৃত ইমাম আহমদ রেযা (.) সীরাতুল মুস্তফা, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৩য় খন্ড, পৃ: ১৪২১৪৩)

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকাত্তরের খণ্ডচিত্র : ২
পরবর্তী নিবন্ধবড় উল্লম্ফনে পুঁজিবাজারে সেঞ্চুরি পার