জুম্আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি

| শুক্রবার , ২৮ জুন, ২০২৪ at ৫:২৫ পূর্বাহ্ণ

পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফের

আলোকে যিকরের ফযীলত

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!

আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় করুন। অন্তরে ও মুখে সরবে নিরবে আল্লাহর ভয় ও মহব্বতপূর্ণ হৃদয়ে তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে মহান আল্লাহ তা’য়ালাকে স্মরণ করুন। কাজে কমের্, চিন্তাচেতনায়, কল্পনায়, সদাসর্বদা, দিবারাত্রি ও সকালসন্ধ্যা আল্লাহর যিকর তথা স্মরণে অন্তরাত্মা আলোকিত করুন। দয়মায় প্রভূর করুণা থেকে হতাশ হবেন না, ফরজ ইবাদত সমূহ আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর ভালবাসা অর্জন করুন। আল্লাহর যিকর, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র স্মরণ, শানমান বর্ণনা, আলোচনা ও দরুদসালাম পরিবেশন ও নফল ইবাদত সমূহ দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করুন। অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ, শটতা, কপটতা, কৃপণতা, আমিত্ব হতে অন্তরাত্মাকে পবিত্র রাখুন। দিবারাত্রি, সদাসর্বদা প্রতিটি কর্মে মহান আল্লাহর নাম স্মরণ করুন। সৎ কর্ম দ্বারা আল্লাহর নিকট ওসীলা পেশ করুন। আল্লাহর অনুগ্রহরাজির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করুন। তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করুন।

হে মানব মন্ডলী!

আল্লাহর ও রাসূলের আনুগত্য করুন। জেনেরাখুন! আল্লাহর যিকর বান্দার জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অপরিহার্য দায়িত্ব। আল্লাহর যিকর জাহান্নামের অগ্নিশিখা থেকে পরিত্রাণের এক বড় উপাদান।

পবিত্র কুরআনের আলোকে যিকরের গুরুত্ব:

মহান আল্লাহর যিকর প্রসঙ্গে কুরআন মজীদে অসংখ্য আয়াত বর্ণিত হয়েছে নিম্নে কয়েকটি আয়াতে করীমা উপস্থাপন করা হলো।

মহান আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, জেনে রেখ! আল্লাহর স্মরণেই আত্মাসমূহ প্রশান্তি লাভ করে (সূরা: রাদ ১৩:২৮)

পঞ্জেগানা নামায আল্লাহকে স্মরণ করার উৎকৃষ্ট উপায়। আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় সালাত সকল প্রকার অশ্লীলতা এবং অপছন্দনীয় কাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর যিকর (সালাতই) সর্ব শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন তোমরা যা কিছু করো।” (২৯ সূরা আনকাবুত: ৪৫)

যিকরের প্রকার ভেদ:

যিকর দুই প্রকার। ১. যিকরে কালবী, অন্তরের যিকর, . যিকরে লিসানী, মুখের যিকর। অন্তরে সদাসর্বদা আল্লাহর যিকর জাগ্রত রাখা সম্ভব। অন্তরের যিকর জারী থাকলে আত্মা পরিশুদ্ধ হয়। আল্লাহর ভয় অন্তরে সৃষ্টি হয়। মুখে আল্লাহর যিকর করা, মুখে যিকর করার সাথে সাথে অন্তরে যিকর জারী না থাকলে তা ফলপ্রসু হয়না। অন্তর ও মুখে সমান ভাবে আল্লাহর স্মরণ হলে যিকরকারী এর উপকার ও সুফল পাবে। বান্দার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি ও কল্যাণ সাধিত হয়। আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন, “ হে মু’মীনগণ! তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর এবং সকালসন্ধ্যা তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। ( সূরা: আহযাব, ৩৩: ৪১৪২)

পার্থিব ব্যস্ততা যেন বান্দাকে আল্লাহর যিকর থেকে বিমুখ না করে:

ধনসম্পদ, সন্তান, সন্ততি আল্লাহর নিয়ামত। বান্দা আল্লাহর নিয়ামত প্রাপ্ত হয়ে আল্লাহর স্মরণ থেকে যেন বিচ্যূত না হয়। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “ হে মু’মিনগণ! তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি যেন আল্লাহর স্মরণ থেকে তোমাদেরকে বিমুখ না করে, যারা বিমুখ হবে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।” (৬৩: সূরা, মুনাফিকুন: )

ধর্মপ্রাণ মুসলিম ভাইয়েরা!

জেনে রাখুন! আল্লাহর স্মরণ তথা যিকরুল্লাহর মধ্যে অপরিসীম উপকারিতা নিহিত রয়েছে। অন্তরকে কুফর, শির্ক, বিদয়াত ও যাবতীয় পাপাচার থেকে মুক্ত রাখা ও পবিত্র করতে আল্লাহর যিকর এক পবিত্র উৎকৃষ্ট মাধ্যম। আল্লাহর যিকরকারী বান্দাদেরকে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত ভালবাসেন। আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। যিকরের ফযীলত সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস শরীফ বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে কয়েকটি হাদীস শরীফ উপস্থাপন করা হলো:

আল্লাহ যিকরকারী বান্দাকে উত্তমভাবে প্রতিদান দেবেন:

প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, আমি আমার বান্দার কাছে তার ধারণা অনুযায়ী। বান্দা যখন আমার যিকর করে আমি তার সাথে থাকি। বান্দা আমাকে একাকী স্মরণ করলে আমিও তাকে একাকী স্মরণ করি। আর যদি কোন মজলিসে (মাহফিলে, জমায়াতে) আমাকে স্মরণ করে আমি তাকে তার চেয়ে উত্তম ভাবে স্মরণ করি। যদি সে আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই। আর যদি আমার দিকে হেঁটে আসে আমি তার দিকে অতি দ্রুত আসি। (মুসলিম শরীফ, খণ্ড ৭ম, পৃ: ১৮৯)

যিকরে নেকীর পাল্লায় ভারী হয়:

হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, দু’টি বাক্য এমন যে, মুখে তার উচ্চারণ অতি সহজ পাল্লায় অনেক ভারী। আর আল্লাহর নিকট অতি প্রিয় তা হলো সুবাহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজীম। ( বোখারী শরীফ, হাদীস নং: ৬৪০৬)

লাইলাহা ইল্লাল্লাহু” যিকরের ফযীলত:

হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে লোক একশবার এ দুআটি পাঠ করবে “আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন মাবুদ নেই, তিনি একক অদ্বিতীয়, তাঁর কোন অংশীদার নেই। রাজত্ব একমাত্র তারই, সমস্ত প্রশংসা একমাত্র তাঁরই জন্য। তিনি সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান। এতে দশটি গোলাম আজাদ করার সমান সওয়াব হবে। তার জন্য একশটি সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে। একশটি গুনাহ ক্ষমা করা হবে। ঐদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত শয়তানের নিকট থেকে নিরাপদ থাকবে। কোনো লোক তার চেয়ে উত্তম সওয়াবের কাজ করতে পারবেনা। তবে হ্যাঁ ঐ ব্যক্তি সক্ষম হবে, যে সব চেয়ে ঐ দুআটির আমল বেশী পরিমান আদায় করবে। (বোখারী শরীফ, হাদীস নং : ৩২৯৩)

ফজরের নামাযের পর যিকরে হজ্ব ও উমরার সওয়াব রয়েছে:

হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি জামাত সহকারে ফজরের নামায আদায় করবে তারপর ঐ স্থানে সূর্য উদয় হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর যিকর করতে থাকে তারপর দু’রাকাত সালাত আদায় করে সে একটা পূর্ণ হজ্ব ও পূর্ণ ওমরাহ আদায় করার সওয়াবের অধিকারী হবে। (বোখারী শরীফ, হাদীস নং: ৫৮৬)

যিকরের মজলিস বেহেস্তের বাগান:

হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন তোমরা বেহেস্তের বাগানে পৌছবে, তাতে বিচরণ করবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ। বেহেস্তের বাগান বলতে কি? নবীজি এরশাদ করেছেন, যিকরের মজলিস। (তিরমিযী শরীফ)

আল্লাহর যিকর আযাব থেকে মুক্তিদানকারী ইবাদত:

হযরত আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, প্রত্যেক বস্তু পরিষ্কার করার যন্ত্র রয়েছে, অন্তর পরিষ্কার ও পবিত্র করার যন্ত্র হলো আল্লাহ তা’য়ালার যিকর করা। আল্লাহর যিকর অপেক্ষা আল্লাহর আযাব থেকে অধিক মুক্তিদানকারী আর কোন ইবাদত নেই। (বায়হাকী শরীফ)

দৈনিক একশবার যিকর করলে সমূদ্রের ফেনা পরিমাণ গুনাহ ক্ষমা করা হয়:

হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি প্রত্যহ একশ বার সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি বলবে তার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়। (বোখারী শরীফ, হাদীস নং: ৬৪০৫)

যিকরকারী জীবিত, যিকর থেকে বিমূখ মৃত ব্যক্তির ন্যায়:

যে অন্তরে আল্লাহর যিকর নেই সে অন্তর মৃত। হযরত আবু মুসা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তাঁর প্রতিপালককে স্মরণ করে আর যে স্মরণ করেনা, উভয়ের দৃষ্টান্ত হলো জীবিত ও মৃত ব্যক্তির অনুরূপ। অর্থাৎ যিকরকারী ব্যক্তি জীবিত ব্যক্তির ন্যায় আর যে ব্যক্তি যিকর করেনা সে মৃত ব্যক্তির ন্যায়। ( বোখারী শরীফ, খন্ড ১০ম, পৃ: ২৯)

হে আল্লাহ আমাদেরকে আপনার সন্তুষ্টি মুতাবিক যিকর করার তাওফিক দান করুন। আপনার মকবুল যিকরকারী বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। আল্লাহ আমাদের সকলকে পবিত্র কুরআনের বরকত দান করুন। কুরআনের আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা পবিত্রাণ নসীব করুন। নিশ্চয়ই তিনি মহান দানশীল, সৃষ্টি জগতের মালিক, পুণ্যময়, অনুগ্রহশীল ও দয়ালু। আমীন।

হে আল্লাহ আমাদেরকে আপনার সন্তুষ্টি মুতাবিক যিকর করার তাওফিক দান করুন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী),

বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাজী মোহাম্মদ দানেশ : তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম নেতা
পরবর্তী নিবন্ধআগুনের শিখা জ্ঞানকে ধ্বংস করতে পারে না