জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৯ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

ফেরেশতার সংজ্ঞা: আরবি মালাকুন শব্দের অর্থ ফেরেশতা এর বহুবচন মালায়িকা। ফেরেশতাগণ আল্লাহর এক প্রকার সম্মানিত সৃষ্টি। শরীয়তের পরিভাষায়-“ফেরেশতাগণ জ্যোতির্ময় সূক্ষদেহের অধিকারী নূরের সৃষ্টি। তাদেরকে বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যাঁরা আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধাচারণ করেন না। সর্বদা আল্লাহর নির্দেশ পালনে নিয়োজিত থাকেন।” (কাউয়ায়েদুল ফিকহ)
বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার ইবনে হাজর আসকালানীর মতে ফেরেশতার এক অর্থ বার্তাবাহক, তাঁদের অবস্থানস্থল আসমানী জগৎ। (ফাতহুল বারী, খন্ড:৬, পৃ:২৩২)
ফেরেশতাদের ব্যাপারে যে ধরনের বিশ্বাস রাখা অপরিহার্য: ১. ফেরেস্তাদের অবিশ্বাস করলে মু’মিন হিসেবে গণ্য হবেনা। ২. তাঁরা আল্লাহর নূরের সৃষ্টি। ৩. তাঁরা পূরুষও নন নারীও নন। ৪. ফেরেশতাদের কোন সন্তান সন্ততি নেই। ৫. তাঁরা পানাহার করেন না। তাঁদের তন্দ্রাও নেই নিদ্রাও নেই। ৬. তাঁরা সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে পূত:পবিত্র সকলেই মাসুম বা নিস্পাপ। ৭. তাঁরা বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করতে পারেন। (কুকুর ও শূকর ব্যতীত) ৮. ফিরিস্তাদের প্রকৃত সংখ্যা আল্লাহ ব্যাতীত কারো জানা নেই। ৯. আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকা তাঁদের প্রধান কাজ। ১০. ফেরেশতারা আল্লাহ যা বলেন তা ছাড়া নিজ ইখতিয়ারে কিছু করতে পারেন না। ১১. হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম বিভিন্ন আকৃতিতে প্রিয় নবীর দরবারে উপস্থিত হতেন। অধিকাংশ সময় হযরত দেহইয়ায়ে কালবী (রা.)’র আকৃতিতে আসতেন।
আলকুরআনে ফেরেশতাদের বর্ণনা: ফেরেশতাগণ আল্লাহর তাওহীদ তথা একত্ববাদের সাক্ষ্যদাতা আল্লাহতা’আলা এরশাদ করেছেন, “আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই, এবং জ্ঞানীগণও (এই সাক্ষ্য দেন)।” (সূরা: আলে ইমরান, আয়াত: ১৮)
ফেরেশতাদের পরিচয় হলো তাঁরা আল্লাহর সম্মানিত বান্দা এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “বরং তারা (ফেরেশতারা) আল্লাহর সম্মানিত বান্দা। (সূরা: আম্বিয়া, আয়াত: ২৬), ফেরেস্তারা আল্লাহর নির্দেশের বাইরে কোন কাজ করেন না। তাঁরা আল্লাহর একান্ত অনুগত সৃষ্টি কোন প্রকার নাফরমানী তাঁরা করেন না। এরশাদ হয়েছে “আল্লাহ তাঁদেরকে যে আদেশ করেন তাই তাঁরা পালন করেন।” (সূরা: নাল: আয়াত: ৫০)
ফেরেশতাদের অবিশ্বাস করা কুফরী: ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান রাখা ঈমানের সপ্ত মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “যে আল্লাহ ফেরেশতাগণ তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণও পরকালকে অবিশ্বাস করবে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়বে।” (সূরা: নিসা: আয়াত: ১৩৬)। ফেরেশদতাদের সংখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কারো জানা নেই। আল্লাহ তা’আলা অসংখ্য ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন এর প্রকৃত সংখ্যা তিনিই জ্ঞাত। তবে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা কিছু সংখ্যক ফেরেশতাদের নাম উল্লেখ করেছেন যেমন সূরা বাকারায় জিবরাইল (আ:) মিকাঈল (আ:) হারূত,মারুত (আ:) ফেরেশতাদের নাম উল্লেখ হয়েছে এরশাদ হয়েছে, “যে কেউ আল্লাহর তাঁর ফেরেশতাগণের তাঁর রাসূলগণের এবং জিবরাইল ও মিকাঈলের শক্র সে জেনে রাখুুক নিশ্চয় আল্লাহ কাফিরদের শত্রু।” (সূরা: আল বাকারা, আয়াত: ৯৮)। আল্লাহ তা’আলা চার জন ফেরেশতাকে বিশেষ মর্যাদা ও দায়িত্ব দিয়েছেন। ১. জিবরাইল (আ:) তিনি আল্লাহর নিকট থেকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ সকল সম্মানিত নবী রাসূলগণের নিকট ওহী আনয়ন করেছেন। নবীজি তাঁকে প্রকৃত আকৃতিতে দু’বার দেখেছেন। মক্কার পাহাড়ের উপত্যাকায় একবার, দ্বিতীয়বার মিরাজ রজনীতে সিদরাতুল মুনতাহা নামক স্থানে। এরশাদ হয়েছে, “আর তিনি (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁকে (জিবরাইলকে) স্পষ্ট দিগন্তে দেখেছেন।”(সূরা: তাক্‌ভীর, আয়াত: ২৩) আরো এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় তিনি (মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জিবাইলকে আরেকবার দেখেছিলেন। তখন রুহুল আমীন জিবরাইল (আ.)’র ছয়শত ডানা বিশিষ্ট বৃহদাকার আকৃতিতে পৃথিবী ও আকাশের মধ্যবর্তীস্থানে পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।” (সূরা: নাজম, আয়াত: ১৩-১৪)। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে,“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরাইল (আ.)কে ছয়’শ ডানা বিশিষ্ট অবস্থায় দেখেছেন।” (ফাতহুল বারী শরীফ, ২য় খন্ড, পৃ: ২৪২), ২. হযরত মিকাঈল (আ:) তাঁর দায়িত্ব হলো সৃষ্টি জগতের খাদ্য দ্রব্যের ব্যবস্থাপনা, মেঘমালা প্রস্তুতকরণ, বৃষ্টি বর্ষণ, আল্লাহর নির্দেশক্রমে সৃষ্টি জগতের জীবিকা সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত। ৩. হযরত ইসরাফীল (আ:) আল্লাহর নির্দেশে কিয়ামতের পূর্বক্ষণে সিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া। বিশ্বজগতের আয়ুস্কাল সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তিনি শিঙ্গায় ফুৎকার দিবেন। শেষ বিচারের দিনও ফুৎকার দিবেন। এরশাদ হয়েছে, “যেদিন শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে, তোমরা দলে দলে সমাগত হবে।” (সূরা: আল নাবা আয়াত: ১৮), ৪. আযরাঈল (আ:) কুরআন হাদীসে তাঁকে মালাকুল মউত (মৃত্যুর ফেরেশতা) বলা হয়েছে। বিশ্ব জগতবাসীর রূহ কবজ করা তাঁর দায়িত্ব। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “( হে হাবীব) আপনি বলুন, তোমাদের জন্য নিযুক্ত মৃত্যুর ফেরেশতা তোমাদের প্রাণ হরণ করবে। অবশেষে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে। (সূরা: সাজদা, আয়াত: ১১)
কবর জগতের ফেরেশতা মুনকার ও নকীর: মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর কবরে মুনকার ও নকীর নামে দু’জন ফেরেশতার কবরবাসীর নিকট সওয়াল জওয়াব এর দায়িত্ব পালন করেন হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “নবীজি এরশাদ করেন, যখন মৃত ব্যক্তিকে কবরস্থ করা হয় তখন কালো নীল বিশিষ্ট দু’জন ফেরেশতা আগমন করেন একজন কে বলা হয় মুনকার অন্যজনকে নকীর। অত:পর তাঁরা তাকে তার রব, দ্বীন ও নবী সম্পর্কে প্রশ্ন করেন।
ফেরেশতারা নবীজির উপর সর্বদা দরুদ শরীফ পাঠ করেন: দরুদ শরীফ এক উত্তম ও বরকতময় আমল স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর অসংখ্য ফেরেশতারাজি তাঁর প্রিয় হাবীবের উপর সর্বদা দরুদ শরীফ পাঠ করেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন “আল্লাহ নবীর প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণও নবীর উপর দরুদ পাঠ করেন।” (সূরা: আহযাব, আয়াত: ৫৬)
ফেরেশতাগণ মু’মিনদের রহমত কামনা করেন ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন এরশাদ হয়েছে, “তিনি আল্লাহ তোমাদের প্রতি রহমত করেন এবং তাঁর ফেরেশতাগণও তোমাদের জন্য অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন অন্ধকার হতে তোমাদেরকে আলোকে আনার জন্য এবং তিনি মু’মিনদের প্রতি পরম দয়ালু। (সূরা: আহযাব, আয়াত: ৪৩)
দৈনিক সকালে দু’জন ফেরেশতা অবতীর্ণ হন: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যখনই আল্লাহর বান্দারা প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করে তখনই দু’জন ফেরেশতা অবতীর্ণ হন। তন্মধ্যে একজন বলতে থাকেন হে আল্লাহ তুমি দাতা ব্যক্তিকে প্রতিদান দাও। অন্যজন বলতে থাকেন হে আল্লাহ কৃপণ ব্যক্তিকে ধ্বংস‘ করো।” (বুখারী ও মুসলিম)
ফেরেশতাদের মৃত্যু: পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “প্রত্যেকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে।” (সূরা: আল ইমরান, আয়াত: ১৮৫)
যখন এ আয়াত অবতীর্ণ হল ফেরেশেতারা বললো আমরাও মৃত্যু বরণ করবো। ইমাম রাযী তাফসীরে কবীরে ইবনে জরীর থেকে বর্ণনা করেন, মালাকুল মাউত মুসলমান এবং ফেরেশতাদের রুহ কবজ করবেন। তবে ফেরেশতাগণ কিয়ামত পর্যন্ত জীবিত থাকার বিষয়টি অসংখ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। কিয়ামতের পূর্বে কোন ফেরেশতার মৃত্যু হবে না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, সিংগায় যখন প্রথম ফুৎকার দেয়া হবে মালাকুল মাউত ফেরেশতাদের রুহ কবজ করবেন। অত:পর তিনিও মৃত্যু বরণ করবেন। হযরত আবু হুরায়ারা (রা.) থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “ফেরেস্তাদের মধ্যে সর্বশেষ মালাকুল মাউত এর মৃত্যু হবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ হবে মরে যাও তখন তিনিও মৃত্যু বরণ করবেন। তখন আল্লাহ নিজেই বলবেন, যারা পৃথিবীতে দাম্ভিকতার সাথে বিচরণ করত: ক্ষমতা ও রাজত্বের দাবী করতো, তারা আজ কোথায়? তখন আল্লাহর সামনে জবাব দেওয়ার কেউ থাকবে না। আল্লাহ তখনই বলবেন আজকের সকল কর্তিৃত্ব ক্ষমতা বাদশাহী আল্লাহরই জন্য।
হে আল্লাহ আমাদেরকে আপনার মকবুল বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত করুন এবং মু’মিনদের কাতারে শামিল করুন। যাঁরা সকলে আল্লাহ তাঁর ফেরেশতাগণ তাঁর কিতাবসমূহ এবং তাঁর রসূলগণের প্রতি ঈমান আনয়ন করেছে। কুরআনের আয়াত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা নাজাত দান করুন। নিশ্চয় তিনি দানশীল, সৃষ্টি জগতের মালিক, পুণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাসযোগ্য একটি সুন্দর চট্টগ্রামই নগরবাসীর কাম্য
পরবর্তী নিবন্ধস্বর্ণের বাজার এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি