জুম্‌’আর খুতবা

কুরআন ও হাদীসের আলোকে মুমিনের বৈশিষ্ট্য

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১ ডিসেম্বর, ২০২৩ at ৬:১৪ পূর্বাহ্ণ

ঈমানের সংজ্ঞা: ঈমান শব্দটি ক্রিয়ামূল। আরবি আমনুন শব্দ থেকে নির্গত। এর আভিধানিক অর্থ, বিশ্বাস স্থাপন করা, দৃঢ়তা অবলম্বন করা, নিরাপদ হওয়া, অবনত হওয়া, আনুগত্য করা। ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র বর্ণনা মতে অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস ও মোখিক স্বীকারোক্তিকে ঈমান বলা হয়। হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (.)’র বর্ণনা মতে ঈমান অর্থ নিরাপত্তা দেওয়া। শরীয়তের পরিভাষায় ঈমান এমন সব ইসলামী আক্বিদার নাম যেগুলো মান্য, বিশ্বাস ও বাস্তবায়ন করলে মানুষ আল্লাহর আযাব থেকে নিরাপত্তার আওতায় এসে যায়। (মিরআতুল মানাজীহ, শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, ১ম খন্ড, পৃ: ১৯)

আল কুরআনের আলোকে মুমিনের বৈশিষ্ট্য: ইসলামের মৌলিক বিষয়াদির প্রতি আন্তরিক বিশ্বাস স্থাপন কারীকে ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় মুমিন বলা হয়। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে মু’মিনের চরিত্র বৈশিষ্ট্য গুনাবলী সম্পর্কে আলোকপাত হয়েছে, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “মু’মিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে যারা নিজেদের নামাযে বিনয় নম্র, যারা অনর্থক কথাবার্তায় লিপ্ত নয়, যারা যাকাত আদায়ে লিপ্ত থাকে এবং যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে হিফাজত রাখে। (সূরা: মুমিনুন ২৩: ০১০৫)

মু’মিনদের আরো অনেক গুনাবলীর মধ্যে রয়েছে “তারা আমানত সুরক্ষায় যত্নবান ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে শঠতা, কপটতা, বিশ্বাসঘাতকতা তাদের স্বভাব বিরুদ্ধ। প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার পালনে তারা সদা সতর্ক। মিথ্যাচার পাপাচার হাঠকারিতা ওয়াদা ভঙ্গ করা ও অনৈতিক কর্মকান্ড থেকে তারা বিরত থাকে, তাকওয়া ভিত্তিক জীবন গঠনে তারা সচেতন ও সক্রীয় থাকে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, এবং যারা আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে হুশিয়ার থাকে এবং যারা তাদের নামায সমূহের হিফাজত করে। (সূরা: মুমিনুন, ২৩: )

কুরআন তিলাওয়াত করা ও আল্লাহর উপর ভরসা করা মু’মিনের বৈশিষ্ট্য: মু’মিনরা বিশ্বাস করে আল কুরআন ‘সেরা মানুষ ও সেরা জাতি নির্মাণের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। মু’মিন জীবন চলার পথে আল কুরআনকে সুষ্পষ্ট নির্দেশিকা হিসেবে মেনে নেবে। কুরআনকে হৃদয়ঙ্গম করবে, আল কুরআনের পঠন পাঠন, অধ্যয়ন, অনুশীলন, কুরআনের শিক্ষা ও আদর্শ প্রচার প্রসার হবে মু’মিনের জীবনের ব্রত। আল্লাহর প্রতিটি বানীর তিলাওয়াতে তাদের আত্না হয় আলোকিত ও পুলকিত। তারা লাভ করে ঈমানী প্রশান্তি আল্লাহর ক্ষমা ও অফুরন্ত অনুগ্রহ। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “মু’মিন তো তারা যাদের অন্তর সমূহ কেপে উঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, আর যখন তাদের ওপর তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের উপর ভরসা করে। (সূরা: আনফাল, :)

মু’মিনদের জন্য ক্ষমা ও সম্মান জনক রিযক: মু’মিন আল্লাহর আনুগত্য ও নির্দেশ পালনে সক্রিয় থাকবে। নামাযের প্রতি তাদের আগ্রহ ও ভালোবাসা তাদের ঈমানের পরিচায়ক, তারা অন্যায় পথে উপার্জন করেনা, অবৈধ পন্থায় রিযক অন্বেষণ করেনা, হারাম পথে তাদের অর্থ ব্যয় করেনা। আল্লাহর দেওয়া অর্থ সম্পদ তারা আল্লাহর পথেই ব্যয় করে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, যারা নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযক দিয়েছি তা হতে ব্যয় করে। (সূরা: আনফাল, :)

হাদীস শরীফের আলোকে প্রকৃত মু’মিনের বৈশিষ্ট্য: মু’মিনরা নিজেদের জীবনের চেয়েও প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বাধিক ভালোবাসবে। নবীজির প্রতি প্রকৃত প্রেম ভালোবাসাই ঈমানের পরিচায়ক। নবী প্রেম হচ্ছে ইসলামের নির্যাস ও প্রাণশক্তি। এরশাদ হয়েছে, হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবেনা যতক্ষণ আমি তার কাছে তার পিতা মাতা সন্তান সন্তুতি এবং অন্যান্য সকল মানুষের চেয়ে প্রিয় না হব। (বুখারী শরীফ, হাদীস: )

মু’মিন কাউকে ভালোবাসা, দান করা সব কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করবে: মু’মিন বান্দা কথা বলা, কাজ করা, দান করা, কাউকে ভালোবাসা, সব কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে করতে হবে। না হয় ঈমান কখনো পরিপূর্ণ হবেনা। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু ওমামা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসে, আল্লাহর জন্য শত্রুতা পোষণ করে, আল্লাহর ওয়াস্তে দান করে এবং আল্লাহর জন্য বিরত থাকে, সে নিজের ঈমানকে পরিপূর্ণ করে নিল। (আবু দাউদ, হাদীস: ২৮)

আল্লাহর জন্য ভালোবাসা তখনই হবে যখন আল্লাহর সাথে মুহব্বত হবে। ইমাম গাযযালী (.) বর্ণনা করেন, যদি কোন ব্যক্তি এ নিয়্যতে কোনো বাবুর্চিকে মুহাব্বত করে যে তার দ্বারা উত্তম খাবার রান্না করে তা গরীব অসহায় অভাবীদের মধ্যে বণ্টন করবে তাহলে এক্ষেত্রে এটা হবে আল্লাহর জন্য মহব্বত। আর যদি কোন ব্যক্তি পার্থিব স্বার্থে কোনো আলিমেদ্বীনকে এ জন্য মুহব্বত করে যে তাঁর কাছ থেকে ইলমে দ্বীন শিক্ষা করে দুনিয়া অর্জন করবে, এটা দুনিয়ার প্রতি মহব্বত হিসেবে বিবেচিত হবে। উদ্দেশ্য যদি দ্বীনের খিদমত না হয়, বড় আলিম হয়ে যশ খ্যাতি ও অর্থ উপার্জন মুখ্য হয়ে থাকে তাহলে দুনিয়া অর্জন করবে, দ্বীনের কোনো কল্যাণ তার দ্বারা হবে না, দ্বীনকে অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবে। (আশি আতুল লুমআত ও মিরআতুল মানাযীহ, ১ম খন্ড, পৃ: ৫০)

মুমিনরা ঈমানের স্বাদ উপভোগ করেছে: মুমিনগণ জীবনে বাধা বিপত্তি বিপদ আপদ দুঃখ কষ্ট মুসীবত অভাব অনটন নানাবিধ প্রতিকুলতা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তারা ঈমানের উপর অটল অবিচল থাকে। ঈমানের স্বাদ উপভোগ করার কারনে সর্বাবস্থায় তারা আল্লাহর উপর সন্তুষ্ট। এরশাদ হয়েছে, হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ঔই ব্যক্তি ঈমানের স্বাদ উপভোগ করেছে যে আল্লাহকে রব, ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাসূল হিসেবে কবুল করে সন্তুষ্ট হয়েছে। (বুখারী শরীফ, হাদীস: ৩৪)

আল্লাহকে রব হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট থাকার অর্থ হচ্ছে তাকদীরের ফায়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা। অসুস্থ ব্যক্তি চিকিৎসকের তিক্ত ঔষধ এমনকি ঝুকিপূর্ণ অপারেশন করার সিদ্ধান্তের উপরও সন্তুষ্ট থাকেন এতে কোন প্রকার আপত্তি করেন না। ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট থাকার তাৎপর্য হলো, ইসলামের সামগ্রিক বিধি বিধানের উপর আনন্দচিত্তে সন্তুষ্ট থাকা, ইসলামের কোন বিধানের বিষয়ে আপত্তি অভিযোগ না করা, ইসলামের আহকাম সম্পর্কে সমালোচনা না করা।

তাওহীদ ও রিসালতে বিশ্বাসী মু’মিনরা জান্নাতী: হযরত ওবাদাহ ইবনে সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এরশাদ করতে শ্রবণ করেছি, যে ব্যক্তি এ মর্মে সাক্ষ্যদেবে আল্লাহ ব্যতীত কোন মাবুদ নেই এবং নিঃসন্দেহে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, আল্লাহ তা’আলা তার উপর দোজখ হারাম করে দেবেন। (মুসলিম শরীফ: ৩৩), আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে মুমিন বান্দা হিসেবে কবুল করুন। ঈমানের উপর অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ রাশেদুল ইসলাম

মুরাদপুর, পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: দরুদ শরীফের উপর লিখিত সর্ববৃহৎ একটি কিতাবের নাম ও এর রচয়িতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে জানালে কৃতার্থ হব।

উত্তর: গবেষকদের বর্ণনায় দেখা যায় দরুদ শরীফের উপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় অসংখ্য কিতাব লিখিত হয়েছে, তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শানে দরুদ শরীফের উপর আরবি ভাষায় লিখিত ত্রিশ পারা সম্বলিত একমাত্র অদ্বিতীয় গ্রন্থ মাজমুওয়ায়ে সালাওয়াতই রাসূল। এ গ্রন্থের পূর্ণ নাম “মুহাইয়্যারুল উকুল আল ফুহুল ফী বয়ানি আওসাফই আক্বলিল উকুল মাজমুওয়ায়ে সালাওয়াতির রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ গ্রন্থের প্রণেতা “আল্লামা খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী” রাহমাতুল্লাহি আলাইহ, তিনি ১২৬২ হিজরিতে পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হরিপুর জেলার চৌহর নামক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি বংশ পরম্পরায় ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর সাথে সম্পৃক্ত। এ জন্য তাঁকে আলভীও বলা হয়। হযরত খাজা চেহিরভী (.)’র প্রণীত ত্রিশপারা দরুদ শরীফ প্রতি পারা ৪৮ পৃষ্ঠা করে ১৪৪০ পৃষ্ঠার এ বিশাল গ্রন্থ খানা ১২ বছর ৮ মাস ২০ দিনে রচনা সম্পন্ন হয়েছে। যা তাঁর কামালিয়াত ও আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতার এক উজ্জ্বল প্রমাণ। গ্রন্থটিতে যদিও প্রসিদ্ধি আছে যে, এতে দরুদ শরীফের সংখ্যা ৬৬৬৬টি তবে গবেষকদের পরিবেশিত তথ্য অনুযায়ী প্রমাণ পাওয়া যায় এতে সর্বমোট ১৭৪৮টি দুআ এবং ১০২৫৮টি দরুদ শরীফ আছে, সবমিলিয়ে ১২০১৬টি দুআ দরুদ রচিত ও সংকলিত হয়েছে। গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণ আল্লামা সায়্যিদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (.)’র তত্ত্বাবধানে ১৯৩৩ খ্রি. প্রথম সংস্করণ ইসলামিয়া স্টীম প্রেস কাশ্মীরি বাজার লাহোর থেকে প্রকাশিত। বর্তমানে দরুদ শরীফের এ বিশাল গ্রন্থটি বাংলায় উচ্চারণ ও অনুবাদসহ আনজুমানএ রাহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট কর্তৃক চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত। উপমহাদেশসহ আরব বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলেও এ কিতাবটি সমাদৃত ও পঠিত। সূত্র: সুন্নীয়তের পঞ্চরত্ন, প্রথম সংস্করণ ১ জুন ১৯৯৮ খ্রি. “আধ্যাত্নিক মহান সাধক আল্লামা খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ইসলামী শিক্ষা ও আরবী সাহিত্যে তাঁর অবদান” কৃত: . মাওলানা মোহাম্মদ সাইফুল আলম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাতীয় অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন: একজন অদম্য কর্মবীরের জীবনালেখ্য
পরবর্তী নিবন্ধগাউসিয়া কমিটি পাঠানপাড়া ইউনিটের মতবিনিময়