ইসলামে সন্তানের প্রতি পিতা–মাতার অধিকার
আল কুরআনের আলোকে সন্তান সন্ততি আল্লাহর নিয়ামত: হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও হাওয়া (আ🙂 এর সৃষ্টির মাধ্যমে পৃথিবীতে মানব জাতির বংশ বিস্তার। ইসলামী শরীয়তের বিধি মোতাবেক দাম্পত্য জীবনে আবদ্ধ হয়ে সন্তান সন্ততি লাভ করতে পারা পিতা মাতার জন্য আল্লাহর বড় অনুগ্রহ ও মহান নিয়ামত। মানব সভ্যতার ক্রম বিকাশ ও আল্লাহর একত্ববাদের প্রচার প্রসারে সন্তান সন্ততির ভূমিকা অনস্বীকার্য। সন্তানের উত্তম প্রতিপালন, তত্বাবধান, সন্তানের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষায় মাতা–পিতার দায়িত্ব ও কর্তব্য অপরিসীম। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, “সম্পদ ও সন্তান–সন্ততি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য। (সূরা: কাহাফ: ৪৬)
সন্তান–সন্ততি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা স্বরূপ: পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে যাদের ধন–সম্পদের অভাব নেই, যশ খ্যাতি সুনাম অট্টালিকা প্রাসাদ, ক্ষমতা সবই আছে কিন্তু তাঁর নেই কোনো সন্তান–সন্ততি পক্ষান্তরে অনেকের নেই সম্পদের প্রাচূর্যতা, বিস্তর ক্ষমতা, তাদের আছে সুসন্তান। তাদের নেই অহমিকা, দাম্ভিকতা, নেই বাহাদুরী প্রদর্শনীর অসুস্থ প্রতিযোগিতা, অনেকে আছেন সন্তানের দাপটে সমাজের নিরীহ অসহায় সাধারণ মানুষের উপর অন্যায় অবিচার ও জুলুম নির্যাতনের কাজে সন্তানকে ব্যবহার করে যা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও পরিত্যাজ্য। মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে সন্তান–সন্ততি আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা স্বরূপ দান করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তোমাদের ধন–সম্পদ ও সন্তান–সন্ততি তো কেবল পরীক্ষা বিশেষ আর আল্লাহর নিকট মহান প্রতিদান।”(সূরা: তাগাবুন, ১৫)
অনেক মু’মিন বান্দা সন্তান–সন্ততির দয়া মায়ায় আবদ্ধ হয়ে দ্বীন থেকে বিমূখ হয়ে যায়, ছেলে মেয়ে অন্যায় অনৈতিক অনৈসলামিক চিন্তা চেতনা ও কর্মকান্ডে নিয়োজিত দেখেও তাদের সতর্ক করেনা, প্রতিবাদ করেনা, সংশোধনের প্রক্রিয়া ও কৌশল অবলম্বন করেনা অনৈতিক কাজ থেকে বিরত রাখতে সক্রীয় ভূমিকা পালন করেনা, মৌনতা বা নীরবতা পালন করে থাকে। মূলত: তারা অন্যায় কাজের সহযোগী হিসেবে সমান অপরাধী। তাদের এ নীরবতা ও অপ্রত্যাশিত ভূমিকা তাদের লজ্জিত অপদস্ত ও অপমানিত করবে। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তা’আলা সতর্কারোপ করেছেন। এরশাদ করেছেন, “ হে মু’মিনগন, তোমাদের ধন–সম্পদ ও সন্তান–সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে আর যারা এরূপ করে তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।” (সূরা: মুনাফিকুন: ৯)
সন্তানকে সর্ব প্রথম তাওহীদের শিক্ষা দান করা অপরিহার্য: সন্তানকে সর্বপ্রথম তাওহীদের শিক্ষা দান করা মাতা–পিতার দায়িত্ব। ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা কালেমা, ঈমান, তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের শিক্ষা দেয়া মাতা–পিতার কর্তব্য। এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (র.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের সর্বপ্রথম “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” বাক্যটি শিক্ষা দিবে। (শুয়াবুল ঈমান, হাদীস: ৮২৮২)
জন্মের পর সন্তানের অধিকার: শিশু সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর ডান কানে আজান দিবে বাম কানে ইকামত দিবে, এতে সন্তান শয়তানের প্ররোচনা থেকে মুক্ত থাকবে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যার সন্তান ভূমিষ্ট হবে তার ডান কানে আজান দিবে এবং বাম কানে ইকামত দিবে এর বরকতে (আজান–ইকামতের) “উম্মে সিবয়ান” তথা শিশু রোগ সন্তান কে ক্ষতি করতে পারবেনা। (মুসনাদ: আবু ইয়ালা, হাদীস : ৬৭৮০)
মধু বা মিষ্টি জাতীয় কোন বস্তু চিবিয়ে শিশু সন্তানের মুখে প্রবেশ করাবে: জন্মের সপ্তম দিবসে অথবা চৌদ্দতম দিবসে বা একুশতম দিবসে আক্বিকা করবে। মেয়ে হলে একটি বকরী ছেলে হলে দুইটি বকরী দিয়ে আকীকা দিবে। হাদীস শরীফে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত হাসান (রা.)’র পক্ষ থেকে একটি বকরী আকিকা করে বলেছিলেন ওহে ফাতিমা! হাসানের মাথা মুড়িয়ে দাও, তাঁর চুলের সমপরিমাণ ওজনে রৌপ্য সাদকা করে দাও, হযরত আলী (রা.) বলেন, আমি তাঁর কর্তিত চুল ওজন করে দেখলাম সেগুলো এক দিরহাম বা কিছু কম ওজনের সমান। (তিরমিযী, হাদীস, ১৫১৯)
সন্তানের সুন্দর নাম রাখার অধিকার: সন্তানের প্রতি পিতা মাতার অধিকার হলো শিশুর জন্মের পর নবজাতকের ইসলাম সম্মত অর্থবোধক শ্রুতিমধুর, সুন্দর নাম রাখবে। ইসলামে নাম করণের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, নামকরণ দ্বারা শিশুর নিজ পরিচয়, বংশ পরিচয় ও জাতীয়তা নির্ণীত হবে। বর্তমানে রাষ্ট্রীয়ভাবেও প্রতিটি সন্তানের জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ইসলামই সর্বাগ্রে এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় কিয়ামতের দিন তোমাদের কে তোমাদের নামে ও তোমাদের পিতাদের নামধরে ডাকা হবে। অতএব তোমরা সুন্দর নাম রাখ। (সুনান আবু দাউদ, হাদীস: ৪৯৪৮)
নিজ সন্তানের জন্য ইসলামী নাম নির্বাচন করুন, সুন্দর নাম রাখুন, মন্দ নাম রাখবেন না।
আবদুল্লাহ, আবদুর রহমান, আবদুর রহীম, আবদুল কাদের, আবদুল খালেক, আবদুল জাব্বার, আবদুল গাফ্ফার, আহমদ, হামেদ এ ধরনের নাম আল্লাহর কাছে খুব পছন্দনীয় এভাবে সম্মানিত নবী রসূলগন, সাহাবাগন, আউলিয়ায়ে কেরাম ও বুজুর্গদের নামে নিজ সন্তানের নাম রাখুন, বিশেষ ভাবে “মুহাম্মদ” নামে নামকরণ অতি বরকতময় ও দুনিয়া আখিরাতে বিশেষ রহমত ও বরকত লাভের ওসীলা। মুহাম্মদ নামে নামকরণ করা হলে ঐ নামের ব্যক্তিকে সম্মান করুন। মেয়ে হলে, আয়েশা, খাদীজা, মায়মুনা, ফাতিমা নাম রাখুন। কথা বলা শুরু হওয়া মাত্রই আল্লাহ আল্লাহ শব্দ উচ্চারণ শিখান এবং কলেমা তৈয়্যবা পূর্ণভাবে শিক্ষা দিন, ইসলামী দুআ দরুদ, পবিত্র কুরআনের আয়াত, সূরা, নিয়মিত শিক্ষা দান ও পড়তে উৎসাহিত করুন, অনুপ্রাণিত করুন। নবীজির প্রতি দরুদ–সালাম পড়ার আদব শিক্ষা দিন।
সন্তানকে নামাযের প্রশিক্ষণ দিন: ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষাই সন্তানের সুন্দর ও উজ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে। সকল প্রকার পাপাচার ও গুনাহ থেকে মুক্ত রাখার জন্য নামাযই একমাত্র নিয়ামক শক্তি। সন্তানকে আদর্শবান চরিত্রবান ও দেশের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে নৈতিক শিক্ষা তথা ধর্মীয় শিক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিন। নৈতিক শিক্ষায় উজ্জীবিত হলে, পিতা মাতা ওস্তাদ ও বড়জন তথা মুরব্বীদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে শিখবে। হযরত আমর ইবন শুআয়ব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা নিজ সন্তানদের সাত বছর বয়সে নামাযের আদেশ দিবে, দশ বছর বয়সে নামায না পড়লে তাদের (মৃদু) প্রহার করবে, এ বয়সে তাদের বিছানা পৃথক করে দিবে। (সুনান আবু দাউদ, হাদীস :৪৯৫)
সন্তানদের মধ্যে সমতা বিধান করুন: একাধিক সন্তান থাকলে প্রত্যেকের অধিকার সুরক্ষায় সচেষ্ট থাকতে হবে। সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে কম–বেশী করা যাবেনা। ন্যায়–নীতির মানদন্ড রক্ষা করতে হবে। কারো প্রতি বৈষম্য বা অবিচার করা যাবেনা। সম্পদের বন্টন ও দান করার ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করতে হবে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, তোমাদের সন্তানদের মধ্যে ইনসাফ করো। আরো এরশাদ করেছেন, দান করার ক্ষেত্রে সন্তানদের মধ্যে সমতা রক্ষা করো। (আল মুজামুল কবীর, হাদীস: ১১৯৯৭)
সন্তানকে পড়ালেখা শিক্ষাদানে পরিবেশ পরিস্থিতি অনুপাতে সজাগ ও সতর্ক করুন। তাদের প্রতি মন্দ আচরণ থেকে বিরত থাকুন। তাদেরকে হাতে প্রহার করবেন না। ভীতি প্রদর্শন সীমিত রাখুন, লেখাপড়ার পাশাপাশি শরীয়ত সম্মত খেলাধুলা আনন্দ বিনোদন ব্যবস্থা করুন। অসৎ সঙ্গে কখনো বসাবেন না অসৎ সঙ্গ সর্পের দর্শনের চেয়েও ক্ষতিকর। (ফাতওয়া রজভীয়্যাহ, ১০ম খন্ড)। সন্তানের প্রতি পিতা–মাতার অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুরক্ষায় আল্লাহ আমাদেরকে তাওফিক দান করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী); খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।