জুম্‌’আর খুতবা

ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকার

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

প্রতিবেশীর সংজ্ঞা:

প্রতিবেশীর আরবি প্রতিশব্দ “জার” শব্দটি এ্রক বচন, বহু বচনে “জিরান” শব্দটির মূল অর্থ প্রবাহিত হওয়া। ইমাম রাগিব আল ইস্পাহানী বর্ণনা করেন, বসবাসে যার বসতবাড়ী তোমার নিকটে তিনিই তোমার প্রতিবেশী। ইবনুল মনযুরের বর্ণনা মতে যে ব্যক্তি তোমার পাশ্বে বসবাস করছে তিনি তোমার প্রতিবেশী, সে মুসলিম হোক অমুসলিম হোক, নেককার হোক বা পাপী হোক, বন্ধু হোক বা শত্রু, দানশীল হোক বা কৃপন, কল্যাণকামী হোক বা অনিষ্টকারী হোক, আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, দেশী হোক বা বিদেশী হোক। (লিসানুল আরব, /১৫৩, পৃ: ৫৪) যারা পাশের বাড়ীতে থাকেন তারা প্রতিবেশী।

প্রতিবেশী কারা? ইসলামের দৃষ্টিতে কারা প্রতিবেশী:

এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, কতটুকু দূরত্বে বসবাসকারী লোকেরা প্রতিবেশী হবে সে সম্পর্কে ইসলামী স্কলার মনিষীদের দৃষ্টিতে বিভিন্ন অভিমত রয়েছে হাসান (.) প্রতিবেশীর সংজ্ঞায় উল্লেখ করেছেন, নিজ গৃহের সামনে চল্লিশ ঘর, পিছনে চল্লিশ ঘর, ডানে চল্লিশ ঘর, বামে চল্লিশ ঘর পর্যন্ত প্রতিবেশী হিসেবে গণ্য হবে। কারো মতে চারদিকের দশ ঘর প্রতিবেশী হিসেবে গণ্য হবে। কারো মতে যারা একই মসজিদে সমবেত হয় তারা প্রতিবেশী। (আত্‌তারগীব ওয়াত তারহীব “আত্‌ তাক্বছীর ফী হুকুকিল জার” পৃ: /)

আল কুরআনে প্রতিবেশীর অধিকার:

বিশ্ব মানবতার মুক্তির সনদ মহাগ্রন্থ আল কুরআনে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবধরণের সব শ্রেণির প্রতিবেশীর অধিকারের কথা বিঘোষিত হয়েছে, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, কোনো কিছুকে তাঁর সাথে শরিক করবেনা। আর সদ্ব্যবহার কর, মাতা পিতার সাথে নিকট আত্মীয়ের সাথে ইয়াতীম মিসকীন নিকট আত্মীয় প্রতিবেশী অনাত্মীয় প্রতিবেশী পাশ্বসাথী মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস দাসীদের সাথে। (সূরা: নিসা, : ৩৬)

প্রতিবেশীর অধিকার তিন প্রকার: . আত্মীয় মুসলিম প্রতিবেশী, . অনাত্মীয় মুসলিম প্রতিবেশী, . অমুসলিম প্রতিবেশী। আত্মীয় মুসলিম প্রতিবেশীর তিনটি অধিকার রয়েছে, . আত্মীয়তার হক, . প্রতিবেশীর হক, . মুসলিম হওয়ার হক, অনাত্মীয় প্রতিবেশীর হকের দুটি দিক রয়েছে, একটি হলো প্রতিবেশী হওয়ার হক অপরটি মুসলিম হওয়ার হক, তৃতীয় পর্যায়ের প্রতিবেশী হচ্ছে ক্ষণিকের সঙ্গী পার্শ্বসাথী যেমন গাড়ীতে, বাহনে, ট্রেনে, বিমানে আপনার পাশের সীটে বসা সঙ্গী দূরদূরান্তে সফর সঙ্গী, মসজিদে, মজলিসে, নামাযে বা মাহফিলে আপনার পাশে বসা লোকটি হতে পারে লোকটি আপনার অপরিচিত, হয়তো জীবনে কোনো দিন তাকে দেখেননি না আর কোনদিন তার সাথে দেখার সম্ভাবনা নেই কিছুক্ষণ সময়ের জন্য সঙ্গী হওয়ার কারনে ইসলাম তাকেও প্রতিবেশীর মর্যাদা দিয়েছে। তাঁর সাথে সুন্দর আচরণ ও সদ্ব্যবহার করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

হাদীস শরীফের আলোকে প্রতিবেশীর অধিকার:

হাদীস শরীফে প্রতিবেশীর খোজ খবর রাখা, প্রতি বেশীর কল্যাণে কাজ করা তাঁকে সহযোগিতা করা, প্রতিবেশীর প্রতি ভালো ব্যবহার করা, প্রতিবেশীর কোন প্রকার ক্ষতি না করা, প্রতিবেশীকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করা ইসলামী আদর্শ ও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, যে লোকটি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে তারই কর্তব্য প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করা। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৭৭)

যে ব্যক্তি প্রতিবেশীর নিকট উত্তম সে আল্লাহর নিকট উত্তম:

আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি যার বিশ্বাস রয়েছে, দ্বীনি আদর্শ ও চরিত্র যিনি ধারণ করেন, কুরআন ও সুন্নাহর আদর্শ অনুসরণ করা যার প্রত্যয়, তিনি প্রতিবেশীর প্রতি কোনো প্রকার অশোভন অরুচিকর ও বিরূপ মন্তব্য করতে পারেন না। প্রতিবেশীর প্রতি মার্জিত শালীন সুন্দর ও আদর্শিক আচরণ মু’মীনের পরিচায়ক। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, যে লোক আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে তাঁর কর্তব্য প্রতিবেশীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। (বুখারী হাদীস: ৬০১৯)

সৎ প্রতিবেশী সৌভাগ্যের প্রতীক:

অসৎ প্রতিবেশী সদা অসৎ চিন্তা ও প্রতিবেশীর ক্ষতি সাধনে সক্রিয় থাকে। সৎ প্রতিবেশী উপকার ও কল্যাণধর্মী কাজে প্রতিবেশীকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করে থাকে।

তিনটি জিনিস সৌভাগ্যের নিদর্শন:

হযরত নাফে ইবনে আবদুল হারিস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, তিনটি জিনিস মুসলমানের সৌভাগ্যের অন্তর্ভুক্ত। ১. প্রশস্ত বাসস্থান, . সৎ প্রতিবেশী, . চমৎকার সওয়ারি (যানবাহন) (আল আদাবুল মুফরাদ)

ক্ষুধার্ত প্রতিবেশীর খোঁজ খবর রাখা মু’মিনের পরিচায়ক:

আজকের সমাজ ব্যবস্থায় অনেক ধনিক বণিক প্রভাবশালী সম্পদশালী ব্যক্তিবর্গ বিলাস বহুল জীবন যাপনে অভ্যস্ত, অথচ সমাজে অসংখ্য বনী আদম অনাহারে অর্ধাহারে ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করছে সমাজের অসংখ্য অগনিত নি:স্ব হত দরিদ্র অবহেলিত বঞ্চিত জনগোষ্টী পরিবারের দৈনন্দিন মৌলিক চাহিদা ও অভাব পূরণ তো দূরের কথা দুবেলা খাবার যোগাড়েও তারা ব্যর্থ। মানবতার কল্যাণে উৎসর্গীত নিবেদিতপ্রাণ মানবিক মানুষগুলো অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়ে মানবতার ধর্ম ইসলামের আদর্শ ও ত্যাগের মহিমাকে উজ্জ্বীবিত করে তোলে।

হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহ তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ কথা বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তৃপ্তি সহকারে উদরপূর্তি করে ভক্ষণ করে আর তারই পাশে তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে সে ঈমানদার নয়। (বায়হাকী ১/৬৯৪)

প্রতিবেশীর ভাল মন্দ মূল্যায়ন:

আপনার প্রতিবেশী যদি আপনার কর্মের স্বীকৃতি ও ত্যাগের মূল্যায়ন করে সেটা হবে প্রকৃত মূল্যায়ন, প্রতিবেশী আপনার পারিবারিক সামাজিক কার্যক্রমের প্রত্যক্ষদর্শী। আপনার কর্মের নীরব সাক্ষী। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আরজ করল, হে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমি ভালো করছি না মন্দ করছি তা আমি কি করে জানব? নবীজি এরশাদ করেন, যখন তোমার প্রতিবেশীদের বলতে শুনবে যে তুমি ভালো করছ তবে প্রকৃতই তুমি ভালো করছ আর যখন প্রতিবেশী বলবে তুমি মন্দ করছ তবে মনে করবে ঠিকই মন্দ কাজ করছ। (মুসনাদে আহমদ, /৩৮০৮)

হযরত জিবরাঈল (.) কর্তৃক প্রতিবেশীর হকের উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, হযরত জিবরাঈল (.) প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যাপারে আমাকে এতোবেশী গুরুত্বারোপ করেছেন এমনকি আমার ধারণা জন্মেছিল হয়তো প্রতিবেশীকে সম্পত্তিতে হকদার (ওয়ারিস) তথা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে গণ্য করা হবে। (বুখারী, হাদীস: ৫৫৫৫)

হে আল্লাহ! আমাদেরকে হেদায়ত দান করুন, পবিত্র কুরআনের বরকত নসীব করুন, প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা ও ইসলামী আদর্শ মেনে চলার তাওফিক দান করুন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

মুহাম্মদ সেলিম আজাদ

পতেঙ্গা স্টীলমিল, পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: অনেক এলাকায় দেখা যায় মৃত ব্যক্তিকে দাফনের পর কবরে তালকীন করা হয়, এ আমলটি কতটুকু শরীয়ত সম্মত? জানালে কৃতার্থ হব।

উত্তর: মৃত ব্যক্তিকে দাফনের পর কবরস্থানে দুআ দরুদ পড়া মৃত ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা তালকীন করা শরীয়ত সম্মত মুস্তহাব আমল। যা পবিত্র হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত এবং মুজতাহিদ ফকীহগণের নির্ভরযোগ্য কিতাবাদির বর্ণনা ও উদ্ধৃতির আলোকে সর্বজন সমর্থিত উত্তম ও শরীয়ত সম্মত আমল। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মৃত ব্যক্তির দাফন প্রক্রিয়া শেষ করতেন তখন কবরস্থানে দাঁড়াতেন এবং এরশাদ করতেন, “তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য মাগফিরাত তথা ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং কবরে সঠিক জবাব দেয়ার জন্য প্রার্থনা করো কেননা এখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে।” (আবু দাউদ, হাদীস ৩২২১) আরো এরশাদ হয়েছে, “তোমরা তোমাদের মৃতদেরকে লা’ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর তালকীন করাও।” (মুসলিম শরীফ, খন্ড:১ম, পৃ: ৩০০) প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা ইবনে হাজর আসক্‌ালানী (.) বলেন, “মাইয়্যতকে দাফনের পর তালকীন করা মুস্তহাব। (ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী “তালহিসুল হুবাইর”) হাদীস বিশারদ ইমাম নববী (.) বলেন, দাফনের পর মৃত ব্যক্তির তালকীন করা মুস্তাহাব। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (.)’র বর্ণনামতে উম্মতের সর্বসম্মত “ইজমা” এর ভিত্তিতে তালকীন করা মুস্তাহাব। (আইনী খন্ড: , পৃ: ১৭৭) দাফনের পর কবরস্থানে আজান দেয়া নি:সন্দেহে জায়েজ ও শরীয়ত সম্মত। (ফতোওয়ায়ে শামী, খন্ড: , পৃ ২৮৩, ওয়াকারুল ফাতাওয়া, খন্ড: , পৃ: ৩৭৮, বাহারে শরীয়ত, খন্ড: ২য়, ফতোওয়ায়ে আফ্রিকা, পৃ.৩৭৮, কৃত ইমাম আহমদ রেযা (.) এ বিষয়ের বৈধতা প্রমানে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা বেরলভি (.)’র “ইযানুল আজর ফী আজানিল কবর” নামক একটি স্বতন্ত্র রিসালা প্রণয়ন করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআখেরাতের প্রস্তুতি
পরবর্তী নিবন্ধচুয়েট: প্রকৌশল শিক্ষার ‘সেন্টার অফ এক্সিলেন্স’