তাজেদারে কারবালা হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একটি আদর্শ জীবন
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহকে ভয় করুন! আল্লাহর অনুগ্রহ ভাজন প্রিয় বান্দাদের আদর্শ অনুসরণ করুন, জান্নাতী যুবকদের সরদার সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঈমানের কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ পবিত্র সত্তা নবীজির দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র শাহাদাতের চেতনা ধারণ করুন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে মৃত বলে ধারণাও করোনা। প্রকৃপক্ষে তারা জীবিত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে রিযিক প্রাপ্ত।” (সূরা: ৩, আল–ই–ইমরান, পারা:৪, আয়াত: ১৩৯)
ইমাম হোসাইন (রা.)’র জন্ম:
প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, মওলা আলী শেরে খোদা (রা.)’র আদরের দুলাল মা ফাতেমাতুজ জোহরা (রা.)’র নয়নের মনি, কলিজার টুকরা, বেহেস্তের যুবকদের সর্দার, হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ৪ হিজরীর ৫ শাবান মঙ্গলবার মদীনা মনোওয়ারা শরীফে জন্মগ্রহণ করেন । জন্মের পর হযরত আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিব (র.) এর স্ত্রী হযরত উম্মুল ফযল বিনতে হারেছ তাঁকে দুগ্ধ পান করান। হুযুর পূরনুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য স্বীয় মুখে চিবিয়ে নরম করে এ নুরানী শিশু সন্তানের মুখে তুলে দেন। এ নবজাতকের ডান কানে আজান এবং বাম কানে তকবীর দিলেন। তাঁর মুখে নবীজির লালা মোবারক প্রবেশ করালেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করলেন। সপ্তম দিনে নাম রাখলেন “হোসাইন” এবং তাঁর পক্ষ থেকে একটি বকরী দ্বারা আক্বীকা করেন। অত:পর হযরত ফাতেমা কে বলেছিলেন হোসাইনের মাথা মুড়িয়ে দাও এবং তার চুলের সমপরিমান ওজনে রৌপ্য সদকা করে দাও।
নাম মোবারক ও উপনাম: নাম: হোসাইন, উপনাম: আবু আবদুল্লাহ, উপাধি সৈয়দুশ শোহাদা, সিবতে রাসূল, (রাসূলের দৌহিত্র)।
নামকরণে জিবরাইল (আ:)’র শুভাগমন: প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যখন এ নবজাতকের জন্মের শুভ সংবাদ পৌঁছল তিনি শাহজাদী সৈয়দা ফাতেমা খাতুনে জান্নাত’র ঘরে তাশরীফ নিলেন, হযরত আলী (রা.) কে জিজ্ঞেস করলেন কি নাম রেখেছো, আরজ করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ইরশাদ করেন হে আলী! তাঁর নাম করনের ব্যাপারে আমি ওহীর অপেক্ষায় আছি। ইতিমধ্যে হযরত জিবরীল আমীন (আ🙂 হুযুরের খিদমতে হাজির হলেন, আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! হযরত হারুন (আ🙂 এর তিন পুত্রের নাম ইবরানী ভাষায় যথাক্রমে শিব্বির, শব্বির, মুশাব্বির ছিল, যার আরবী অনুবাদ হাসান, হোসাইন, মুহসিন। বড় শাহজাদার নাম যেহেতু হাসান এর নাম হোসাইন রাখুন। সুতরাং হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নাম হোসাইন রাখলেন। হযরত হাসান ও হযরত হোসাইন এর নামকরণ প্রসঙ্গে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, ইরশাদ হয়েছে, “ হযরত আলী (র.) বর্ণনা করেন, যখন হাসান জন্ম গ্রহণ করেন তিনি তাঁর নাম রাখলেন হামজা এবং যখন হযরত হোসাইন জন্ম গ্রহণ করেন তাঁর নাম স্বীয় চাচার নামানুসারে জাফর রাখলেন, হযরত আলী বলেন, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ডেকে বললেন এ দুজনের নাম পরিবর্তন করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি। (হযরত আলী (রা.) বলেন) আমি বললাম আল্লাহ ও তাঁর রাসুল অধিক জ্ঞাত। অত:পর হুযুর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদের নাম রাখলেন হাসান ও হোসাইন। এ হাদীসটি ইমাম আহমদ বিন হাম্বল আবু ইয়ালা ও হাতেম বর্ণনা করেন, এবং ইমাম হাকেম বলেন এ হাদীসের সনদ বিশুদ্ধ।
তার আঙ্গি’ক ও গঠনগত সৌন্দর্য: তিনি বক্ষ হতে পা মুবারক পর্যন্ত পূর্ণমাত্রায় হুযুর আক্বদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাদৃশ্য ছিলেন। তাঁর আঙ্গিক ও অবয়ব ছিল নূরে এলাহী ও জামালে মুস্তফার আধার। তাঁর নূরানী চেহারা মুবারকের উজ্জ্বলতার তুলনায় চন্দ্র সূর্যের উজ্জ্বলতা ছিল নেহায়েতই নগন্য। অন্ধকার রজনীতে চেহারা মুবারক থেকে আলো বিচ্ছুরিত হতো।
শিক্ষাদীক্ষা: হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) দরবারে রিসালতের নূরানী পাঠশালার অনন্য অসাধারণ প্রতিভা’র শিক্ষার্থী ছিলেন। নবীজির সার্বিক তত্তাবধানে জ্ঞান প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্যে গভীর বুদ্ধিমত্তা ও পূর্ণতা অর্জন করেন। নবীজি তাঁকে সর্বাধিক আদর স্নেহ করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনম্র খোদাভীরু দয়া ও করুণা প্রদর্শনে রাসূলের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। দূরন্ত দূর্বার প্রচন্ড সাহসী, অকূতোভয় তেজম্বী ও অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে আপোষহীন নির্ভীক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। স্বয়ং রাসূলে খোদাও জানতেন যে, এমন এক যুগ আসবে এই প্রিয় দৌহিত্রই আমার উম্মতকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করবে। আমার প্রচারিত দ্বীনের ঝান্ডা সমুন্নত করবে। নিজের পরিবার পরিজনসহ জীবনের বিনিময়ে ইসলামের মর্যাদা ও আদর্শকে অক্ষুন্ন রাখবে। সকল প্রকার অশুভ বাতিল অপশক্তির মোকাবিলায় মুনাফিক চক্রকে পদদলিত করে ভয়াবহ দূর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে ঈমান ইসলামের অতন্দ্র প্রহরী ও দ্বীনের কান্ডারী হিসেবে ভূমিকা পালন করবে।
উত্তম চরিত্র: তাজেদারে কারবালা হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ছিলেন উত্তম আদর্শ চরিত্রের এক অনুস্মরনীয় দৃষ্টান্ত। সততা, ন্যায়পরায়নতা, পারস্পরিক সহমর্মিতা উদারতা অসহায় অনাথ দূর্বল নিঃস্ব গরীব ফকীর মিসকিনদের প্রতি তিনি ছিলেন উদার সহনশীল, আদর্শ চরিত্র ছিল তাঁর সহজাত বিশিষ্ট্য। তাঁর জীবনের অসংখ্য ঘটনাবলী এর উজ্বল প্রমান। এ ক্ষেত্রে একটি ঘটনার উল্লেখ প্রনিধানযোগ্য, তিনি একদিন কতিপয় মেহমানদের সাথে খাবার গ্রহণ করছিলেন।কৃতদাস প্রচন্ড গরম ঝোলের পাত্র দস্তরখানায় পরিবেশনের সময় ভীত কম্পিত হয়ে ঝোলের পাত্র ছুটে নীচে পড়ে গেল ঝোল তাঁর চেহারা মুবারকে গিয়ে ছিটকে পড়ল, তিনি পরিবেশনকারীর দিকে দৃষ্টিপাত করা মাত্রই লোকটি নিতান্ত আদব ও বিনয়ের সাথে আরজ করল রাগ সংবরণকারী, তিনি বললেন আমি রাগ সংবরণ করলাম। কৃতদাস লোকটি অবার বললেন মানুষকে ক্ষমা কারী তিনি জবাব দিলেন, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। লোকটি পূনরায় বললেন কল্যাণকামীদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন, তিনি উত্তর দিলেন আমি তোমাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে আজাদ করে দিলাম।
হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র মর্যাদার বর্ণনা: হযরত ইমাম হোসাইন (রা.)’র মর্যাদার বর্ণনায় অসংখ্য হাদিস শরীফ বর্ণিত হয়েছে, আপনাদের জ্ঞাতার্থে কয়েকটি হাদিস শরীফ উল্লেখ করব। তিরমিযী শরীফের হাদীস “হযরত ইয়ালা বিন মুররাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, হুযুর করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হোসাইন আমার থেকে আমি হোসাইন থেকে। অর্থাৎ হোসাইন (রা.)’র সাথে হুযুরের এবং হুযুরের সাথে হোসাইনের নিবিড় ঘনিষ্টতা, যেন উভয়ে অভিন্ন সত্তা। হোসাইনের স্মরণ অর্থ হুযুরকে স্মরণ করা, হোসাইনকে ভালবাসা অর্থ হুযুরকে ভালবাসা। হোসাইনের বিদ্বেষ করা অর্থ হুযুরের প্রতি বিদ্বেষ করা। হোসাইনের সাথে যুদ্ধ করা মানে হুযুরের সাথে যুদ্ধ করার শামিল। সরকারে দো’আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যিনি হোসাইন (রা.) কে ভালবাসল তিনি আল্লাহকে ভালবাসল। হযরত জাবের বিন আবদু্ল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, বেহেস্তের যুবকদের সর্দারকে যিনি দেখতে চায় সে যেন হোসাইন বিন আলীকে দেখে, হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হে আল্লাহ, আমি তাকে (হোসাইনকে) ভালবাসি, তুমিও তাকে ভালবাস এবং যে তাকে ভালবাসবে তুমি তাকেও ভালবাস। হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) বায়তুল্লাহ শরীফের ছায়াতলে দন্ডায়মান ছিলেন তিনি হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) কে এদিকে তাশরীফ আনছেন দেখে বলে উঠলেন আজকে আসমান বাসীদের নিকট জমীন বাসীদের থেকে ইনিই সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি।
ইমাম হোসাইনের শাহাদাত ও আমাদের শিক্ষা: হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাহাদাতের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে সত্য ও মিথ্যার মানদন্ড নিরাপন হলো। সততা ন্যায় পারায়ণতা প্রিয় নবী মুস্তফার পবিত্র দ্বীনের হিফাজত ও সংরক্ষনে ইমাম হোসাইনের (রা.) ভূমিকা ও আত্মত্যাগের ইতিহাস অক্ষয় হয়ে থাকবে। পক্ষান্তরে অভিশপ্ত কলংকিত অন্যায় অপরাধ ও জুলুম নির্যাতনের মহানায়ক হিসেবে কুখ্যাত ইয়াজিদ চিরদিন মুসলিম সমাজে তথা বিশ্ববাসীর নিকট ঘৃনার পাত্র হয়ে থাকবে। মহাপ্রলয় অবধি ইমাম হোসাইন (রা.) এর চর্চাকারী থাকবে। হোসাইনী আদর্শের পতাকা কিয়ামত পর্যন্ত সমুন্নত থাকবে। এজিদ ও এজীদিয়তের প্রতি মুসলিম মিল্লাতের ক্ষোভ ঘৃণা ও নিন্দাবাদ অব্যাহত থাকবে। ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে আজো আলী আকবর ও আলী আজগর (রা.)’র রক্তমাখা মরুপ্রান্তর আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওহে হোসাইনের প্রেমিকরা! কথা ও কাজের সমন্বয়ে হোসাইনী আদর্শকে আবারো জীবন্ত করো, যুগের ইয়াজিদী শক্তিকে চিহ্নিত করো, এজিদীরা আজো মুসলমানদের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করার অপচেষ্টায় সক্রিয়। মুসলমানদের বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টিতে এজিদী অপশক্তিরা সকল প্রকার ষড়যন্ত্রে সদা সক্রীয়। অনৈক্য ও বিশৃঙ্খংলা ইয়াজিদী চরিত্র। ঐক্য, শান্তি, সংহতি ও শৃঙ্খলা হোসাইনী আদর্শের অপর নাম। হোসাইনী আদর্শ দেশ জাতি ও মুসলিম উম্মাহর সম্মান মর্যাদা ও ঐতিহ্যের প্রতীক। ইয়াজিদীয়ত অজ্ঞতা মূর্খতা বর্বরতা ও অন্ধকারের প্রতীক। আসুন, আমাদের অন্তরাত্মাকে হোসাইনের প্রেমানলে সিক্ত করি। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি সোনার বাংলাদেশকে ইয়জিদী চক্রের অশুভ চক্রান্ত থেকে মুক্ত করি। শত সহস্র অলী আউলিয়াদের পূণ্যভূমি এ দেশের পবিত্র মাটি ও মানুষকে আহলে বায়তে রাসূলের মহব্বতের কেন্দ্রে পরিণত করি। সন্ত্রাসবাদ জঙ্গীবাদ অত্যাচার পাপাচার ও জুলুম নির্যাতনকে বিতাড়িত করে হোসাইনী আদর্শের প্রজ্জলিত আলোকবর্তিকায় অন্তরাত্বা আলোকিত করুন, যেভাবে হিজরী প্রথম শতাব্দীতে ইয়াজিদের অপকর্মের কারণে ইসলাম ভুলুন্ঠিত হতে যাচ্ছিল, আজো ইয়াজিদের উত্তরসূরী ইসলাম বিকৃতকারী বাতিল অপশক্তি গুলোর অপতৎপরতায় ইসলামের অগ্রযাত্রা সর্বগ্রাসী হুমকী ও ষড়যন্ত্রের শিকার। যাদের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন ঈমানের পরিচায়ক তাঁদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা আজো অব্যাহত রয়েছে।
হে আল্লাহ আমাদেরকে তোমার মাহবুব বান্দাগনের পদাঙ্ক অনুসরণ পূর্বক আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র প্রতি অকৃত্রিম মহব্বত প্রদর্শন করার তৌফিক দান করুন। আমীন বেহুরমতে সৈয়্যদিল মুরসালীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।