জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৬ জুন, ২০২৩ at ৫:১০ পূর্বাহ্ণ

মদীনা মনোওয়ারা ও রওজা শরীফ যিয়ারতের ফযীলত

ইয়াসরিব হলো মদীনা মনোওয়ারা: পবিত্র কুরআন, তাফসীর, হাদীস ও ইতিহাসের বর্ণনা সূত্রে আল্লামা সামহুদী রাহমাতুল্লাহ আলায়হি মদীনা মনোয়ারার চুরানব্বইটি নাম উল্লেখ করেছেন। নবীজি হিজরতের পর এ শহরের নাম রাখেন তৈয়্যবাহ ও তাবা। এ শহরের উল্লেখযোগ্য নাম সমূহের মধ্যে রয়েছে মদীনাতুন নবী, মদীনাতুর রাসূল, দারুল হিজরাত, আল মাহবুবা, আসসাকীনা, আল মরহুমা, আল হারাম, দারুল আবরার, দারুল ঈমান, দারুস সালাম, দারুস সুন্নাহ, কুব্বাতুল ইসলাম, আল মুবারাকা, আল মুকাদ্দাসা, আল মদীনা, আরদুল্লাহ, আরদুল হিজরাহ (হিজরতের ভূমি) এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআন এরশাদ করেছেন, “আল্লাহর যমীন কি প্রশস্ত ছিলনা যে, তোমরা সেখানে হিজরত করবে।” (সূরা: নিসা, আয়াত: ৯৭, জযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব কৃত: শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী)

ইয়াসরিব বলা নিষেধ: নবীজি এ পবিত্র নগরীতে শুভাগমনের পর এর নাম রাখেন মদীনা তাইয়্যিবা। হযরত বারাআ ইবন আযিব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজি এরশাদ করেছেন, যে লোক মদীনা কে ইয়াসরিব বলবে সে যেনো আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। এটা “তাবা” এটা “তাবা” অর্থাৎ পবিত্র। (রুহুল মাআনী, খন্ড: ১১, পৃ: ২০৮)

মদীনা শরীফের প্রধান আকর্ষণ রওজা শরীফ: মদীনা মনোওয়ারার রওজা শরীফে শায়িত আছেন দোজাহানের সরদার মুসলিম উম্মাহর ঈমানের স্পন্দন, ইমামুল আম্বিয়া, রাহমাতুল্লীল আলামীন, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। রওজা শরীফে শায়িত নবীজির নুরানী দেহ মুবারকের সাথে সংযুক্ত মাটিকে মুজতাহিদ ফকীহগন, বায়তুল্লাহ শরীফ এমনকি আল্লাহর আরশের চেয়েও উত্তম ও শ্রেষ্ঠ বলে মত প্রকাশ করেছেন। (জযবুল কুলুব, ওয়াফাউল ওয়াফা, পৃ: ২০, ফতোওয়ায়ে শামী, খন্ড: )

আল কুরআনের আলোকে রওজা মুবারকের যিয়ারত: আল কুরআনের আলোকে রওজা মুবারকের যিয়ারত এক বরকতময় আমল ও উত্তম ইবাদত। হযরত ইমাম ফাসী মালেকী (.) রওজা শরীফ যিয়ারত কে ওয়াজিব বলেছেন। হানাফী মাজহাবের প্রসিদ্ধ ফকীহ আল্লামা হাসান শারাম্বোলালী (.)’র মতে রওজা পাকের যিয়ারত করা ওয়াজিবের কাছাকাছি। নবীজির যিয়ারতের গুরুত্ব ও ফযীলত পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “যখন তারা নিজেদের আত্মার উপর জুলুম করে তখন হে মাহবুব তারা আপনার নিকট আসলে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলে আর রাসূলও তাদের জন্য শফায়াত করলে তারা আল্লাহকে তাওবা কবুলকারী ও দয়বান পাবে।” (সূরা: নিসা, আয়াত: ৬৪)

আয়াত বর্ণিত “যখনই” শব্দটি সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত। এটি শুধু নবীজির জাহেরী জীবদ্দশার সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং এটি কিয়ামত অবধি সময়ের জন্য প্রযোজ্য।

হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম কর্তৃক মদীনা শরীফের প্রতি সম্মান প্রদর্শন: একদা আল্লাহর নবী হযরত সোলায়মান আলাইহি সালাম নিজ সিংহাসনে আরোহন করে বিশ্বভ্রমণে বের হলেন, সে যুগের সম্মানিত নবীগন ও আলিমগন, তাঁর সাথে ছিলেন। তাঁর সিংহাসনের দ্বার প্রান্তে জ্বিনরা দাঁড়িয়েছিল। সিংহাসন উর্ধারোহন করে এমন স্থানে এসে উপনীত হলো যেখানে পৌছে তিনি আসনকে নিচে অবতরণের নির্দেশ দিলেন সকল সফরসঙ্গীদের যমীনের এ অংশে পদব্রজে গমন করার আদেশ করলেন। সকলে আদেশ মেনে নিলেন, স্বয়ং হযরত সোলায়মান (🙂 পায়ে হেঁটে চলা শুরু করলেন, যমীনের এ অংশ ভ্রমন করে যখন বেরিয়ে পড়েন সিংহাসন পূনরায় উর্ধ্বাকাশে দ্রুত অগ্রসর হলো। উপস্থিত একজন আরজ করলেন হে আল্লহর নবী! আপনি এ যমীনের প্রতি ও এই ময়দানের প্রতি এতো বেশি সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শনের কারণ কি? আপনি পায়ে হেঁটে কেন এ জমীন অতিক্রম করলেন, হযরত সোলায়মান (🙂 উত্তর দিলেন, এখনো এ জমীন অনাবাদী, এমন এক সময় আসবে এ স্থানে একটি শহর গড়ে উঠবে। এ শহরের নাম হবে মদীনা মনোওয়ারাহ। এ শহরেই আল্লাহর প্রিয় নবী সর্বশেষ নবী ইমামুল আম্বিয়া, মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনের শেষ সময়কাল এখানেই অতিবাহিত করবেন। এ জমীনেই তিনি ওফাত বরণ করবেন এ জমীনেই তিনি চিরশায়িত হবেন, এখানে তাঁর সমাধি নির্মিত হবে। এ কারনেই এ জমীন ও এই ময়দানের প্রতি সম্মান করেছি। (সংক্ষেপিত) (রুহুল বয়ান শরীফ, আনোয়ারুল বয়ান, খণ্ড: ৩য়, পৃ: ৩৯)

মদীনা শরীফের প্রতি ভালোবাসার দুআ: উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রাণ প্রিয় শহর মদীনার জন্য এ মর্মে দুআ করেছেন, হে আল্লাহ আমাদের অন্তরে মদীনা মনোওয়ারার প্রতি ভালোবাসা দান করুন। যেমন আমরা মক্কা মুকাররমাকে ভালবাসি এবং তার চাইতেও বেশী। (সহীহ বুখারী শরীফ)

মদীনায় বরকতের জন্য নবীজির দুআ: দেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ। দেশের উন্নতি অগ্রগতি কল্যাণ ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করা ও মঙ্গল কামনা করা নবীজির সুন্নাত। কথায় কাজে কর্মে দেশ বিরোধী ভূমিকা পালন করা, দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা অনৈতিক কাজ। নবীজি দেশকে ভালোবাসার দুআ করেছেন, নবীজি এরশাদ করেছেন, হে আল্লাহ! আমাদের জন্য আমাদের মদীনায় বরকত দান করুন। আমাদের “সা” পরিমাপে বরকত দিন। আমাদের “মুদ” ওজন পরিমাপে বরকত দিন, হে আল্লাহ! হযরত ইবরাহীম (🙂 আপনার বান্দা, বন্ধু, এবং নবী, আর আমি আপনার বান্দা ও নবী, তিনি মক্কা শরীফের জন্য আপনার নিকট দুআ করেছেন, আর আমি মদীনার শরীফের জন্য আপনার নিকট প্রার্থনা করছি যেমনিভাবে তিনি মক্কা শরীফের জন্য প্রার্থনা করেছেন। (তিরমিযী শরীফ)

নবীজির দুআর ওসীলায় আজ মদীনা শরীফে সার্বিক প্রাচুর্যতা, রিযিকের প্রশস্ততা, পার্থিব বরকত ও উন্নতি দিবালোকের ন্যায় সমুজ্জল।

হাদীস শরীফের আলোকে রওজা মোবারক যিয়ারত: রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজা শরীফ যিয়ারতে শাফায়াতের স্বীকৃতি রয়েছে। এরশাদ হয়েছে, হযরত নাফে (রা.), হযরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে আমার রওজা যিয়ারত করেছে তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে যায়। (বায়হাকী শরীফ, রাহাতুল কুলুব, পৃ: ২০৪)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হজ্ব করল অত:পর আমার ওফাতের পর আমার রওজার যিয়ারত করল সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাক্ষাৎ করলো। (বায়হাক্‌ী, সুনানে কুবরা, খন্ড ৫, পৃ:২৪৬)

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আমার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আসে এবং তার সফরে আমার যিয়ারত ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকেনা, কিয়ামত দিবসে তার জন্য সুপারিশকারী হওয়া আমার দায়িত্ব হয়ে যায়। (তাবরানী, দারেকুতনী, খোলাসাতুল ওয়াফা, পৃ:৬০)

নবীজির যিয়ারত না করার পরিণতি: যে ব্যক্তি কেবল হজ্ব করল, নবীজির যিয়ারতকে গুরুত্ব দিলনা তার জন্য ভয়াবহ পরিণতির দু:সংবাদ রয়েছে, “রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি হজ্বে বায়তুল্লাহ আদায় করল আর আমার যিয়ারত করলনা, সে আমার উপর অবিচার করল।” (জযবুল কুলুব, পৃ:২০৬)

আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে নবীজির রওজা মোবারক যিয়ারত করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী),

খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইক্বামতে দ্বীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহীহ্‌ ইসলামী সংগঠনসমূহের ঘাটতি
পরবর্তী নিবন্ধকালজয়ী বাংলা গানের অমর গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের গান