বিতর নামাযের ফযীলত ও মাসায়েল
পবিত্র কুরআনের আলোকে বিতর:
বিতর শব্দটির আভিধানিক অর্থ বিজোড়। পবিত্র আল কুরআনের সূরা আল ফজর, এ–বিতর শব্দ উল্লেখ হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “ওয়াশ শাফ‘ই ওয়াল ওয়াত্রি” অর্থ শপথ জোড় ও বিজোড়ের। (৮৯ সূরা: আল ফজর, আয়াত: ৩)
বর্ণিত আয়াতে জোড় ও বিজোড় দ্বারা কি বুঝানো হয়েছে এ প্রসঙ্গে তাফসীরকারদের বিভিন্ন মত রয়েছে। এক বর্ণনা মতে জোড় দ্বারা সমগ্র সৃষ্টি জগতকে বুঝানো হয়েছে, কেননা আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি কূলকে জোড়া জোড়া সৃষ্টি করেছেন। যথা ভালা–মন্দ, আলো–অন্ধকার, ঈমান–কুফর, রাত্রি ও দিন, শীত–গ্রীষ্ম, জ্বীন ও মানব, নর ও নারী। মহান স্রষ্টা রব হলেন বিজোড় একক সত্তা। আমাদের কর্মে ভালো ও মন্দ রয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্মে বিতর বা বিজোড় অর্থাৎ তিনি শুধু ভালো কাজই করেন। কোন প্রকার গুণাহ বা মন্দ কাজ তাঁর দ্বারা সম্পন্ন হওয়া সম্ভবপর নয়। এক বর্ণনা মতে জোড় ও বিজোড় দ্বারা নামাযের কথা বুঝানো হয়েছে যথা ফজর, জোহর, আসর, এশা চার ওয়াক্তের নামায জোড়া জোড়া। আর মাগরীব ও বিতরের নামায বিজোড়। (তাফসীর নূরুল ইরফান, সূরা: ফজর এর ৩ নং আয়াতের সংশ্লিষ্ট তাফসীর, পৃ: ১৬৩০)
হাদীস শরীফের আলোকে বিতরের নামায:
বিতর নামায এর গুরুত্ব ও ফযীলত সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, প্রতিদিন এশার নামাযের পর বিতর নামায আদায় করতে হয়। এ নামায তিন রাক’আত স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম এ নামায আদায় করেছেন। উম্মতের জন্য এ নামায অপরিহার্য করেছেন। এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, প্রত্যেক মুসলমানের উপর বিতর সালাত অপরিহার্য। (আবুদাউদ, আসসুনান, হাদীস: ১৪২২)
বিতর নামাযের যথাযথ পাবন্দী ও হিফাজতের জন্য হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা তোমাদের উপর একটি সালাত বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তার হিফাজত করো। আর তা–হলো বিতরের সালাত। (কানযুল উম্মাল, হাদীস নং: ১৯৫২৫)
বিতর নামাযের সময়:
অন্যান্য নামাযের যে ভাবে সময়সূচি রয়েছে তেমনিভাবে বিতর নামাযেরও সময়সূচি রয়েছে এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত মুআয ইবনে জাবল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা আমাকে একটি নামায বৃদ্ধি করে দিয়েছেন আর তা হলো বিতরের নামায, এর সময় হলো এশা ও ফজর উদিত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ২২০৯৫)
হযরত মসরুক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা কে রাসূলুল্লাহর বিতর নামায সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তখন তিনি বললেন, তিনি প্রত্যেক রাতেই বিতর আদায় করতেন। কখনো রাতের প্রথমভাগে, কখনো রাতের মধ্যভাগে, তবে নবীজি ইন্তিকালের আগে রাতের শেষ প্রহরে বিতর সালাত আদায় করতেন। (ইবনে মাযাহ, হাদীস : ১১৮৫)
শেষ রাতে বিতর পড়া অধিক উত্তম:
হযরত জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ শেষ রাতে নিদ্রা হতে জাগতে শংকিত হলে সে যেন রাতের প্রথম ভাগেই বিতর আদায় করে। এরপর যেন সে নিদ্রা যায়।
আর তোমাদের যে ব্যক্তি রাতের শেষ ভাগে জাগতে পারবে বলে ধারণা রাখে সে যেন শেষ রাতে বিতর সালাত আদায় করে। কেননা শেষ রাতের কিরাআত অধিক মকবুল হয়, আর এটাই উত্তম। (ইবনে মাযাহ, হীদস: ১১৮৭)
মাসআলা: বিতরের সালাত তিন রাক’আত, সব রাক’আতে কিরাআত পড়া ফরজ। প্রত্যেক রাক’আতে সূরা ফাতেহার সাথে অন্য সূরা মিলানো ওয়াজিব। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৪, পৃ: ০৪)
বিতর নামায আদায়ের পদ্ধতি:
এশার নামাযের পর বিতরের তিন রাক’আত নামায ওয়াজিব। দ্বিতীয় রাক’আতে বসে তাশাহহুদ পড়া ওয়াজিব। তাশাহহুদ পড়ার পর তৃতীয় রাক’আতে সূরা ফাতিহার পর সূরা মিলাতে হবে। তারপর আল্লাহু আকবর বলে উভয় হাত কান পর্যন্ত উঠিয়ে পূনরায় হাত বাঁধবে এবং দুআ কুনুত পড়বে। দুআ কুনুত পড়া ওয়াজিব। ইমাম মুক্তাদি সকলেই দুআ কুনুত পড়বে। দুআ কুনুত আস্তে পড়া সুন্নাত। অত:পর রুকু সিজদা করে যথারীতি নামায সমাপ্ত করবেন। (উমদাতুল ফিক্হ, ২য় খন্ড)
দুআ কুনুত মুখস্থ না থাকলে একবার “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতও ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাঁও ওয়াক্বিনা আযাবান্–নার” পড়বে। অথবা তিনবার “আল্লাহুম্মাগ্ফির লানা” পড়বে। (আলমগীরি, মুমীন কী নামায)
মাসআলা: কোন ব্যক্তি রমজান মাসে এশার নামায জামাতে পড়তে পারেনি ওই ব্যক্তি বিতর নামাযও জামাতে পড়বে না। এশার নামায একাকী পড়ে থাকলে, বিতর নামাযও একাকী পড়বে। (ফাতওয়া–এ–রজভীয়্যাহ, খন্ড:৩, পৃ: ৪৮১)
মাসআলা: এশার নামায কাযা হলে বিতর নামাযও কাযা আদায় করা ওয়াজিব। কাযা আদায়ের সময় দু’আ কুনুতও পড়তে হবে। (ফাতওয়া–এ– রজভীয়্যাহ, খন্ড: ০৩, পৃ: ৬২৪)
মাসআলা: যে ব্যক্তি নিদ্রা থেকে জাগ্রত হওয়ার ব্যাপারে আত্নবিশ্বাস রাখে তার জন্য শেষ রাত্রে বিতর পড়া মুস্তাহাব। অন্যথায় নিদ্রার পূর্বে পড়ে নিবে। এরপর যদি শেষ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় তাহলে তাহাজ্জুদ পড়ে নিবে। বিতর দ্বিতীয়বার পড়া জায়েজ নেই। (বাহারে শরীয়ত, ৩য় খন্ড, পৃ: ১৩১)
মাসআলা: নামায শারীরিক ইবাদত। এতে “নিয়াবত” বা প্রতিনিধিত্ব করা যাবেনা। অর্থাৎ একজনের নামায অন্যজন আদায় করলে আদায় হবেনা। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৩য়, পৃ: ১২৭)
মাসআলা: বিতর নামাযে মুক্তাদি দুআ কুনুত পড়া শেষ হওয়ার আগে ইমাম রুকুতে চলে গেল। এমতাবস্থায় মুক্তাদিও ইমামের অনুসরনে রুকুতে চলে যাবে। (আলমগীরি, রদ্দুল মুহতার)
মাসআলা: রমজান মাস ব্যাতীত অন্যান্য সময়ে বিতরের নামায জামাত সহকারে পড়া মাকরূহ। (আলমগীরি, বাহরুব রায়েক, ওমদাতুল ফিক্হ)
দুআকুনুত: “আল্লাহুম্মা ইন্না নাস্তাঈনুকা ওয়ানাস্তাগফিরুকা ওয়া নু’মিনুবিকা ওয়া নাতাওয়াককালু আলাইকা ওয়ানুছনি আলাইকাল খাইর ওয়া নাশকুরুকা ওলা নাকফুরুকা ওয়া নাখলাউ ওয়ানাত্রুরু মাঁই ইয়াফজুরুকা আল্লাহুম্মা ইয়্যাকা নাবুদু ওয়ালাকা নুছাল্লি ওয়ানাছজুদু ওয়াইলাইকা নাছ্আ ওয়া নাহফিদু ওয়া নারজু রাহমাতাকা ওয়া নাখশা আজাবাকা ইন্না আজা–বাকা বিল্ কুফফারি মুল্হিক।” হে আল্লাহ, আমাদের কবুল করুন! যথা নিয়মে আপনার ইবাদত করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ আবদুল খালেক
দোহাজারী, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।