জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১১ নভেম্বর, ২০২২ at ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে সময়ের গুরুত্ব

আল কুরআনের আলোকে সময়ের গুরুত্ব:
সময় আল্লাহর শ্রেষ্ট নিয়ামত। সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পবিত্র আল কুরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা সময়ের গুরুত্বারোপ করেছেন। এরশাদ করেছেন, “শপথ সময়ের নিশ্চয় মানবজাতি ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু তারা নয় যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে এবং পরস্পরকে সত্যের জন্য জোর দিয়েছে এবং একে অপরকে ধৈর্যধারণের উপদেশ দিয়েছে।” (সূরা: আল-আসর, আয়াত: ১-৩)
আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, “শপথ রাতের যখন তার অবসান হয়, শপথ দিবসের যখন তা আলোকোজ্জ্বল হয়।” (সূরা: মুদ্দাসসির, ৩৩-৩৪)
আসর’র ব্যাখায় তাফসীরকারদের অভিমত: মুফাসসিরকুল শিরোমনি হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) ’র বর্ণনা মতে আসর হল সময় কাল। এক বর্ণনায় আসরের নামাযের শপথ, যা মধ্যবর্তী নামায, যাতে দিন ও রাতের ফিরিস্তাগন সমবেত হন। (তাফসীর নূরুল ইরফান, পারা, ৩০, পৃ: ১৬৭৬)
সময় বলতে কি বুঝায়:
এ বিষয়ে কম বেশী আমরা সকলে অবগত আছি যে, সময় বলতে মূর্হুত, ক্ষণ, সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা, দিন, রাত, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস, বৎসর, যুগ, শতাব্দী, বুঝায়। সময়ই জীবন, জীবনের অপর নাম সময়। উল্লেখ্য যে পাথির্ব জগতের সবকিছু সুখ-শান্তি, সুস্থতা-অসুস্থতা, স্বচ্ছলতা-অসচ্ছলতা, ভালো, মন্দ, ন্যায়, অন্যায়, সময়ের মাঝেই আবর্তিত ও পরিবেষ্টিত। মনীষারা বলেছেন, জীবনে অনেক কিছু ফিরে আসে ফিরিয়ে আনা যায় কিন্তু সময়কে ফিরিয়ে আনা যায় না। সময়ের শুরু আছে শেষ আছে। আমাদের জীবন সীমিত। আমাদের জীবনের সময় কখন শেষ হবে আমাদের কারো জানা নেই। আল্লাহ আমাদের মৃত্যুর সময় নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। প্রত্যেক ব্যক্তিকেই মরতে হবে। (সূরা: আনকাবূত:৫৭)
আমাদের সময় ক্ষণস্থায়ী, কার জন্য জীবনের কতটুকু সময় বরাদ্দ কারো জানা নেই। জীবনের ক্ষুদ্র পরিসরে ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রতিটি মূহুর্তকে উত্তম ও মহৎ কাজে সদ্ব্যবহার করতে পারলেই জীবনটা হবে সফল ও সার্থক। সময়ের প্রতিটি মূহুর্তগুলো যথাযথ কাজে লাগানোর নামই সময়ের সদ্ব্যবহার।
হাদীস শরীফের আলোকে সময়ের গুরুত্ব:
পাঁচটি বিষয়কে মূল্যায়ন করুন। সময়ের কাজ সময়ে করুন। অবস্থা ও পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে। বিভিন্ন সমস্যা জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। বেচে থাকার গ্যারান্টি নেই। যে কোনো মূহুর্তে জীবন বাতি নিভে যেতে পারে। সময়কে গুরুত্ব দিন, কদর করুন, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আমর ইবনে মায়মুন আল আওদী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয়ের আগে গনীমত মনে কর। বৃদ্ধ হওয়ার আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দরিদ্র হওয়ার আগে স্বচ্ছলতাকে, কর্মব্যস্ত হওয়ার আগে অবসর সময়কে, মৃত্যেুর আগে জীবনকে। (কানযুল উম্মাল, খন্ড: ১৫, হাদীস নং: ৪৩৪৯)
হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে, হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বণির্ত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহর দুটি নিয়ামত যে বিষয়ে অধিকাংশ মানুষ ধোঁকায় পতিত হয়। একটি হলো সুস্থতা, অপরটি হল অবসর সময়। (সহীহ বুখারী শরীফ, হাদীস নং: ৪৯৩৩)
বাস্তবে দেখা যায় অনেক মানুষ শাররীকভাবে সুস্থতার সময় সানন্দে প্রতিটি ভালোকাজ করার সুযোগ হাতে রয়েছে কিন্তু তিনি এটা কল্পনা করেনা যে, অসুস্থ হয়ে পড়লে বিভিন্ন জটিল কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে ইবাদত বন্দেগী নামায রোজা হজ্ব ও উত্তম আমল করা তার জন্য কঠিন ও কষ্টকর হয়ে পড়বে। অথচ তিনি অবহেলা উদাসীনতায় সময় কাটিয়ে দেয় ভালোকাজে মনোযোগী হয়না। এভাবে এখন অবসর সময় আছে অনেক নেক আমল করার সুযোগ আছে অথচ হেলায়ফেলায় অলসতায় সময় অপচয় করে অবসর সময়কে পার করে দিল। জীবনে অবসর সময় ভবিষ্যতে নাও আসতে পারে। সুযোগ থাকতে এ নিয়ামতগুলোকে সঠিক ব্যবহার ও মূল্যায়ন করতে পারলে জীবন মূল্যাবান হয়।
চারটি বিষয়ে বান্দাকে জবাব দিহী করতে হবে:
হযরত মুআয ইবনে জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কিয়ামত দিবসে চারটি বিষয়ে প্রশ্নের সম্মূখীন হওয়ার পূর্বে কোনো বান্দা এক কদম সামনে অগ্রসর হতে পারবেনা। এক. তাঁর জীবন কোন কাজে অতিবাহিত করেছে, দুই. যৌবন সে কিসে ক্ষয় করেছে, তিন. ধন-সম্পদ কোন পথে আয় করেছে এবং কোন খাতে ব্যয় করেছে, চার. ইলম অনুযায়ী কতটুক আমল করেছে। (আততারগীব ওয়াত্‌ তারহীব, ৬: পৃ: ১৮৭)
জীবন তো সময়ের সমষ্টি:
প্রখ্যাত তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী (রা.) বর্ণনা করেন, হে আদম সন্তান, তুমি তো কতেক দিনের সমষ্টি, সুতরাং যখন একটি দিন অতিবাহিত হলো তখন তোমার জীবনের একাংশ হারিয়ে গেল। (কিতাবুয যুহুদ, পৃ: ৩৯৭)
হাসান বসরী (রা.) সময়ের গুরুত্ব প্রসঙ্গে আরো বলেন, গতকাল তো অতিবাহিত হয়ে গেলো, আজ হল কাজের দিন, আগামীকাল তো আশা মাত্র। আগামীকাল কি ঘটবে সে সম্পর্কে কারো জ্ঞান নেই। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, কেউ জানেনা আগামীকাল সে কী অর্জন করবে। (সূরা: লুকমান, ৩৪)
প্রতিটি মূহুর্ত ও দিন মানুষের কর্মের সাক্ষী:
সুষ্ঠু পরিকল্পনা ভিত্তিক সময়ের সঠিক ব্যবহার ও গুরুত্বারোপ করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চমৎকার ভাবে বর্ণনা করেছেন। প্রতিদিন প্রত্যূষে দু’জন ফেরেস্তা ডাক দিয়ে বলে হে আদম সন্তান! আমি একটি নতুন দিন, তোমার কর্মের আমি সাক্ষী। তাই সময়কে কাজে লাগাও, সময় থেকে উপকৃত হও কিয়ামত পর্যন্ত আমি আর ফিরে আসবো না। (হিলয়াতুল আউলিয়া, খন্ড: ২, পৃ: ৩০৩)
সময়ের সঠিক ব্যবহারে রুটিন মেনটেইন করুন:
একজন আদর্শ মানুুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো দৈনিক চব্বিশ ঘণ্টা সময়ের কর্ম পরিকল্পনা ও রুটিন অনুযায়ী সময় ব্যয় করা। কোন কাজ কোন সময়ে কতটুকু সময়ে সম্পাদন করবেন। একটি রুটিন করুন। এমন কিছু কাজ যা প্রতি দিনই করতে হয়। যেমন গোসলের প্রস্তুতি, নামাযের সময়, খাবারের সময়, স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, ভার্সিটি গমনের সময়, ক্লাশের সময়সূচি, পেশা জীবিদের দৈনিক কার্যক্রমের সময় সূচি, অফিসিয়াল সময়সূচি, খেলাধুলার সময়, বিশ্রামের সময়, পিতা-মাতা, আত্মীয় স্বজন ও মানব সেবার জন্য জীবনের কিছু সময় বের করে নিন। ব্যবসা, বাণিজ্য, চাকুরী ইত্যাদি ব্যস্ততার মধ্যেও আল্লাহর বান্দাদেরকে “দাওয়াতুল খায়র” তথা সত্য ও কল্যাণের পথে দাওয়াত দানের কিছু সময় বের করুন। এভাবে নিজের কর্তব্য, স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য ও সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য পালনে প্রতিদিনকার চব্বিশ ঘণ্টার সময়কে ভাগ করে রুটিন মাফিক সময়কে কাজে লাগালে একজন বান্দা আদর্শ মানুষ হিসেবে তার জীবন ও কর্মে সাফল্য বয়ে আনবে। তাই সময়মত যা করা প্রয়োজন তা করতে হবে। অসময়ে কাজ করার প্রবণতা পরিহার করতে হবে। কল্যাণকর কাজে সময় দিতে হবে। ক্ষতিকর কাজে সময় ব্যয় করা থেকে নিজকে বিরত রাখতে হবে। সময়ের সদ্ব্যবহারে মহামনীষীদের অনুসরণ করুন। সময়কে সর্বোত্তম কাজে লাগিয়ে নিজকে গড়ে তুলুন। শিক্ষা দীক্ষায়, সৌন্দর্যে, শৃঙ্খলায়, বিনয়ে, আচারে, ব্যবহারে ব্যক্তিত্বে আদর্শে চরিত্রে মহত্বে আক্বিদায় বিশ্বাসে সময়ের সদ্ব্যবহারে যারা দ্বীনি আদর্শ স্থাপনে অবিস্মরনীয় দৃষ্টান্ত রেখেছেন। তাঁদের অনুসরণ করুন। ইমাম আযম আবু হানিফা (র.), ইমাম বুখারী (র.), গাউসুল আযম দস্তগীর আবদুল কাদের জিলানী (র.), খাজা মাঈনুদ্দিন চিশতি (র.), ইমামে রব্বানী মুজাদ্দিদে আলফেসানী (র.), ইমাম গাজ্জালী (র.), শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (র.), আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা বেরলভী (র.), খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (র.), কুতবুল আউলিয়া সৈয়দ আহমদ শাহ সিরিকোটি (র.), আল্লামা রুমী (র.), আল্লামা জামী (র.), আল্লামা ইকবাল প্রমুখ মনীষীগন জীবনের স্বল্প সময়ে অক্লান্ত ত্যাগ সাধনার মাধ্যমে সময়ের সঠিক ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী স্মরণীয় হয়ে আছেন। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সময়ের সদ্ব্যবহার করার ও গুরুত্ব বুঝার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী),
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ জাহেদুল করিম
মুরাদপুর, পাঁচলাইশ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগৌরব ও ঐতিহ্যের ৫০ বছরে যুবলীগ
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে