ইসলামে শহীদের মর্যাদা
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, আল্লাহর পথে নিজের জীবন উৎসর্গ করাকে শহীদী মর্যাদা লাভের সৌভাগ্য মনে করুন।
শহীদ অর্থ: শহীদ শব্দের অর্থ সাক্ষী, পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফে বহু স্থানে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আর এ রসূল তোমাদের রক্ষক ও স্বাক্ষী”। (সূরা: ২ পারা:২ বাকারা আয়াত: ১৪৩)
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের দিবসে উম্মতের কার্যকলাপ সম্পর্কে সাক্ষ্য দিবেন, আরো এরশাদ করেছেন, “এবং হে মাহবুব: আপনাকে তাদের সবার উপর সাক্ষ্য এবং পর্যবেক্ষণকারীরূপে উপস্থিত করবো।” (সূরা: ৪ সিনা, পারা: ৫, আয়াত: ৪১)
মহান আল্লাহর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা কর্তৃত্ব বুঝানোর জন্য এরশাদ করেছেন, “যাঁরই জন্য আসমান সমূহ ও যমীনের রাজত্ব এবং আল্লাহ প্রত্যেক বস্তুর উপর সাক্ষী আছেন।” (সূরা: ৮৫, বুরুজ, আয়াত: ০৯)
শহীদের পারিভাষিক অর্থ: আল্লাহর পথে কাফির মুশরিক কর্তৃক যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিকে শহীদ বলে অথবা অন্যায়ভাবে মুসলমানদের হাতে নিহত ব্যক্তিকে শহীদ বলে। শহীদ অর্থ সাক্ষ্য, যেহেতু মহান আল্লাহ ও তাঁর ফিরিস্তাগন শহীদের জন্য বেহেস্তের সাক্ষ্য দেন। (তাফসীর কুরতুবী)
প্রখ্যাত ইসলামী আইনবিদ আল্লামা ইবনে আবেদীন শামীর বর্ণনা মতে যে মুসলমান কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত হন তাঁকে শহীদ বলা হয়।
পবিত্র কুরআনের আলোকে শহীদের মর্যাদা: আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত রাখার জন্য যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তারা আল্লাহর সান্নিধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদা লাভ করবে। ইসলামে তাঁদের অনন্য মর্যাদার কথা পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “এবং যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে মৃত বলোনা, বরং তাঁরা জীবিত। কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারনা।” (সূরা: বাক্বারা, পরা: ২, আয়াত: ১৫৪)
শানে নুযুল: বর্ণিত আয়াত শোহাদায়ে কেরামের শানে অবতীর্ণ হয়েছে কেউ কেউ যুদ্ধ ময়দানে শহীদগণের নিহত হওয়ায় আফসোস করে বলতো তাঁরা নিহত হয়ে অনেক নি’য়ামত থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছে, এরই জবাবে আল্লাহ এরশাদ করেছেন, তাঁরা ক্ষণস্থায়ী জীবন আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে চিরস্থায়ী জীবন লাভে ধন্য হয়েছে। [তাফসীর নুরুল ইরফান কৃত: হাকীমুল উম্মত আল্লামা মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.)]
শহীদগণ জীবিত: শহীদগণ আল্লাহর দ্বীনের ঝান্ডাকে সমুন্নত করার জন্য ও কাফিরদের শক্তিকে অবনমিত করার জন্য আল্লাহর পথে নিহত হয়েছেন এ কারনে আল্লাহ তাঁদেরকে চিরস্থায়ী জীবন দানে ধন্য করেছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে কখনো তাঁদেরকে মৃত বলে ধারণা করোনা বরং তার নিজ রবের নিকট জীবিত রয়েছে, রিযক প্রাপ্ত।(সূরা: ৩ আল-ইমরান, পারা:৪, আয়াত: ১৬৯)
বর্ণিত আয়াতে করীমা যদিও ওহুদ যুদ্ধে নিহত শহীদগণ সম্পর্কে নাযিল হয়েছে তবুও আয়াতের মমার্থ ব্যাপক হওয়ায় কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর দ্বীনের জন্য নিজেদের প্রাণ উৎসর্গকারী শহীদগনের জীবনকে চিরস্থায়ীভাবে প্রমাণ করেছে। শহীদদের দেহ ও আত্মা উভয়টি জীবিত, এ কারণ শহীদের দেহ কবরে বিগত হয় না, দুর্গন্ধ হয় না, এ প্রসঙ্গে অসংখ্য ঘটনাবলীর বর্ণনা প্রমানিত। শোহাদায়ে কেরামের রূহগুলো সবুজ পাখির আকৃতিতে জান্নাতে ভ্রমন করতে থাকে যা ইচ্ছে পানাহার করতে পারে। শহীদের রূহ শাহাদাত বরণের পর এক কদমেই মদীনা মুনাওয়ারায় পৌছে যায়। [তাফসীর নূরুল ইরফান কৃত: হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.)]
হাদীস শরীফের আলোকে শহীদের মর্যাদা: পবিত্র কুরআনে আল্লাহর অনুগ্রহ ভাজন প্রিয় বান্দাদের চার শ্রেণিতে বিন্যাস করা হয়েছে, ১. নবীগন, ২. সিদ্দিকগন, ৩. শহীদগন, ৪. সালেহীন। শহীদগন আল্লাহর অনুগ্রহ প্রাপ্তিতে আনন্দিত হবেন, শহীদগন বেহেস্তে বিশেষ মর্যাদা লাভ করবেন, তাঁদের জখমগুলো কিয়ামতের দিন রক্তের ন্যায় উজ্বল লাল বর্ণের হবে এবং কস্তুরীর ন্যায় সুগন্ধযুক্ত হবে, তাঁদের মর্যাদা সম্পর্কিত অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, “হযরত মিকদাম ইবন মা’দী কারিব (রা.) থেকে বণির্ত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, শহীদের জন্য ছয়টি মর্যাদা রয়েছে, ১. তাঁর প্রথম রক্তের ফোটা জমীনে পড়ার সাথে সাথে তাঁকে ক্ষমা করা হয়, ২. জান্নাতে তাঁর বাসস্থান তাঁকে দেখানো হয়, ৩. কবরের ভয়াবহ শাস্তি থেকে তাকে পরিত্রাণ দেওয়া হয়, ৪. ভয়ঙ্কর বড় বিপদ থেকে নিরাপদ থাকবে, ৫. তাঁর মাথায় সম্মানের মুকুট পরিধান করানো হবে, এর এক একটি পাথর দুনিয়া ও এর মধ্যকার সবকিছু হতে উত্তম, ৬. শহীদের সাথে বাহাত্তর জন জান্নাতী হুরকে বিয়ে দেওয়া হবে। এবং তাঁর সত্তরজন নিকটাত্মীয়ের জন্য তাঁর সুপারিশ কবুল করা হবে। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস : ১৬৬৩)
শহীদগণ পৃথিবীতে পূনরায় এসে দশবার শহীদ হওয়ার আকাঙ্খা প্রকাশ করবে: শাহাদাতের তৃপ্তি ও স্বাদ যা অনন্য অতুলনীয় একমাত্র শহীদগনই তা অনুভব করতে পারেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, জান্নাতীদের মধ্যে শহীদকে হাজির করা হলে আল্লাহ তা’আলা জিজ্ঞেস করবেন হে আদম সন্তান! তোমার বাসস্থান কেমন পেয়েছো? শহীদ বলবে, হে আল্লাহ সর্বোত্তম স্থান, আল্লাহ বলবেন, আরো কিছু চাও এবং আকাঙ্খা করো, তখন সে বলবে হে আল্লাহ! আমি প্রার্থনা করি আমাকে পৃথিবীতে পূনরায় পাঠানো হোক আমি তোমার পথে দশবার শহীদ হবো, কেননা সে শাহাদতের মর্যাদা দেখেছে। (সুনানে নাসাঈ, হাদীস : ৩১৬০)
শহীদগণ শাহাদতের সময় কষ্ট অনুভব করে না: আল্লাহর পথে নিহত শহীদগনকে আল্লাহ তা’আলা মৃত্যু যন্ত্রণা ও সকল প্রকার কষ্ট থেকে নিরাপদে রাখেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, শহীদ নিহত হওয়ার সময় কোন প্রকার কষ্ট অনুভব করেনা, কেবল এটুকু যে তোমাদের কাউকে পিপড়া দংশন করলে যতটুকু ব্যাথা অনুভব করে। (মু’জামুল আওসাত, হাদীস: ২৮০)
শহীদের শরয়ী বিধান: ফিকহ শাস্ত্রের পরিভাষায় শহীদের মৃতদেহের জন্য কিছু নির্দ্দিষ্ট শর্ত রয়েছে:
১। নিহত ব্যক্তি মুসলমান হওয়া শর্ত, অমুসলিম ব্যক্তির জন্য শহীদের বিধান প্রযোজ্য হবে না, ২। বিনা অপরাধে অন্যায়ভাবে নিহত হওয়া শর্ত, কাজেই কেউ যদি কৃত অপরাধের শাস্তি স্বরূপ মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হয়ে মারা যায় বা মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পূর্বেই স্বাভাবিক ভাবে মারা যায় সে ক্ষেত্রে শহীদের বিধান প্রযোজ্য হবে না, ৩। গুনাহের কাজে বা মন্দ কাজের নিয়্যতে ভ্রমণকারী বা ব্যাভিচারের কারনে অন্ত:স্বত্বা মহিলা মারা গেলে তার ক্ষেত্রে শহীদী বিধান কার্যকর হবে না। যে মুসলমান কাফির কর্তৃক যুদ্ধে নিহত হয়েছে অথবা কোন মুসলমান অন্যায় ভাবে কোন মুসলমানকে আঘাতকারী যন্ত্র বা অস্ত্র দ্বারা হত্যা করা হলে শরীয়ত মতে সে শহীদের পর্যায়ভুক্ত হবে। এ পর্যায়ের শহীদের হুকুম হলো এ প্রকার শহীদকে গোসল দেয়া যাবেনা। তার রক্তসহ দাফন করা হবে। তাঁর শরীর থেকে রক্ত মুছে ফেলা হবেনা। তাঁর শরীরের পরিহিত কাপড় খোলা হবেনা। শহীদের শরীরে পরিহিত জিনিস যদি কাফন জাতীয় না হয় তা খুলে নিবে। যেমন চামড়া জাতীয় কাপড় হলে তা খুলে নিবে। পায়জামা খুলবেনা। শহীদের সব কাপড় খুলে নতুন কাপড় দেয়া মাকরুহ। (আলমগীরি, রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ২৩০-২৩১)
অন্যান্য মৃতদেরকে যেভাবে সুগন্ধি ব্যবহার করা যায়, শহীদেরকেও সুগন্ধি লাগানো যাবে। শহীদের রক্ত ধৌত করা যাবেনা। রক্তসহ দাফন করবে। কাপড়ে যদি না পাকী থাকে তা ধুয়ে নিবে। (আলমগীরি) শহীদের জানাযা নামায পড়তে হবে। ফিকহর কিতাব সমূহ দ্রষ্টব্য (বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ২৩১)
যুদ্ধে নিহত হওয়া ছাড়াও যারা শহীদের সওয়াব পাবে হাদীস শরীফে শহীদদের অসংখ্য ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, জিহাদে নিহত ছাড়াও এক বর্ণনায় আরো সাত প্রকার শহীদ রয়েছে, ১। যে প্লেগ রোগে মারা যায়, ২। যে পানিতে ডুবে মারা যায়, ৩। আগুনে পুড়ে মারা গেলে, ৪। পেটের রোগে যিনি মারা গেছেন, ৫। দেওয়াল চাপা পড়ে যিনি মারা গেছেন, ৬। যে নারী সন্তান প্রসবকালে মারা গেছেন, ৭। কুমারিত্ব অবস্থায় মারা গেলে এ ক্ষেত্রে পার্থক্য হলো এদেরকে গোসল দিতে হবে, কাফন পরাতে হবে, জানাযা পড়তে হবে। (বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ২২৮)
হে আল্লাহ আমাদেরকে শহীদের মর্যাদা বুঝার তাওফিক দান করুন। আমীন। লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ আবদুল মুত্তলিব
বুড়িশ্চর, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।











