জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৯ জুলাই, ২০২২ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার

আল কুরআনের আলোকে নারীর মর্যাদা: হযরত আদম আলাইহিস সালাম ও হাওয়া (আ:) এর মাধ্যমে পৃথিবীতে মানবজাতির বংশ বিস্তার। ভূপৃষ্ঠে মানব জাতির বংশ বিস্তার ও মানব সম্পদ উন্নয়নে নারী জাতির অবদান ও ভূমিকা অপরিসীম, পূরষ একাকিত্ব জীবনের অবসান ঘটিয়ে শরয়ী পন্থায় বিধিগত ভাবে যুগলজীবনে পদার্পনের যে সামাজিক বন্ধন ‘যা নিকাহ বা বিবাহ নামে স্বীকৃত। এটাই নারী পূরুষের আইনগত বৈধভিত্তি। মহান আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে বৈবাহিক জীবনের মাধ্যমে বংশ বিস্তারের সূচনা প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, “হে মানব জাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালক কে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে এক আত্না বা ব্যক্তি থেকেই সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন যিনি তাদের উভয় থেকে অসংখ্য নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। (আল কুরআন, ৪:১)
নারীর প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালনের অপরিহার্যতা: নারী জাতিকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা যাবেনা। তাদের প্রতি অন্যায় আচরণ, অনৈতিক ব্যবহার, অবজ্ঞা অবহেলা সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক দায়িত্ব ও অধিকার এর গুরুত্ব প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে, তারা স্ত্রীগণ তোমাদের ভূষণ এবং তোমরা স্বামীগণ তাদের ভূষণ। (আল কুরআন: ২:১৮৭)
পোষাক যেভাবে শরীরকে আবৃত রাখে ঢেকে রাখে অনুরূপ স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক বৈবাহিক সর্ম্পক পরস্পরকে অবাঞ্চিত ও অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে রক্ষা করে।
নর-নারীর স্বীকৃত বৈবাহিক সম্পর্ক নারীর মর্যাদার প্রতীক: ইসলামে নারী জাতির প্রতি সকল প্রকার অনৈতিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নারী জাতির সুখ শান্তি সমৃদ্ধি নিরাপত্তা নিশ্চিতভাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রত্যয়ে ইসলামে পরিবার গঠনের উপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জীবনের কোনো পর্যায়ে নারীরা যেন নিগৃহীত-নির্যাতিত ও অবহেলিত না হয় তাদের মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষিত হয়, নর-নারী যেন পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে দাম্পত্য জীবনে আবদ্ধ হয়ে সূখী ও শান্তির পরিবার গঠন করে মর্যাদাপূর্ণ জীবন উপভোগ করতে পারে এ লক্ষ্যে ইসলামে বিবাহ বন্ধনের সুস্পষ্ট নীতিমালা ঘোষিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, এবং তার নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই জাতি থেকে সঙ্গীনীদের সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা দয়া ও মায়া মমতা স্থাপন করেছেন। (আল কুরআন ৩০:২১)
নারীর মোহরানার অধিকার: ইসলাম বিবাহের মাধ্যমে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। ইসলামে যৌতকের স্থান নেই বরং স্ত্রীকে মোহর দেয়ার নির্দেশ দিয়ে তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে সুদৃঢ় করেছে। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, “তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের তাদের মোহরানা খুশি মনে দিয়ে দাও। তারা যদি খুশী হয়ে তা থেকে কিছু অংশ ছেড়ে দেয় তবে তা তোমরা স্বাচ্ছন্দে ভোগ করতে পার। (৪:সূরা নিসা: ৪) ইসলামে বিয়েতে কনেকে মোহরানা প্রদানের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে নারীর আথির্ক নিরাপত্তা বিধান করা। স্বামীর কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক দেয়ার অবাধ স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা।
হাদীস শরীফের আলোকে নারীর মর্যাদা: সমাজে অনেক পিতা মাতা নিজেদের ছেলে সন্তানকে কন্যা সন্তানের উপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। পারিবারিক সুযোগ সুবিধা পড়া লেখার ব্যয় নির্বাহ ইত্যাদি বিষয়ে কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে কমগুরুত্ব দিয়ে থাকে, ক্ষেত্র বিশেষ বৈষম্য সৃষ্টি করে থাকে, যা কোনো ভাবেই উচিৎ না। ছেলে মেয়েদের মধ্যে ভরণ পোষণ, সুযোগ সুবিধা, পড়া লেখা ইত্যাদি বিষয়ে ভারসাম্যপূর্ণ সমতা রক্ষা করা পিতা মাতার দায়িত্ব। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কোনো ব্যক্তি ঘরে কন্যা সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পর তাকে যেন জ্যান্ত কবর না দেয় এবং তাকে অসম্মান না করে এবং পুত্র সন্তানকে কন্যা সন্তানের উপর প্রাধান্য না দেয়, তাহলে আল্লাহ তা’আলা তাকে বেহেশত দান করবেন। (আবু দাউদ ৫১৪৬)
ইসলামে নারী জাতির গৌরবময় অতীত: ইসলামের সূচনাকাল থেকে ইসলামের অগ্রযাত্রা ইসলামের প্রচার প্রসার, ইসলামী জিহাদে অংশগ্রহণ, ব্যবসা বানিজ্যে অবদান, হাদীস চর্চা, কাব্যচর্চা, সাহিত্য চর্চা শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞান গবেষণায় মানবতায় কল্যাণ সাধন ও মানব সেবায় নারী সমাজের বহুমাত্রিক ভূমিকা ও অবদান ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল সোনালী অধ্যায়। সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী নবীজির সহধর্মিনী উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদিজাতুল কুবরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা। তাঁর অসামান্য বহুমূখী অবদান ইসলামের বিজয়কে তরান্বিত করেছে। নবীজির কদমে তাঁর সমুদয় ধন-সম্পদ উৎসর্গ করা তাঁর মহানূভবতা দানশীলতা ও বদান্যতার ইতিহাস, নারী জাতির গৌরবময় ইতিহাসের আলোকবর্তিকা। সর্বপ্রথম যিনি ইসলামের জন্য নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেছেন হযরত সুমাইয়া তিনিও একজন নারী। নবীজির পত্নী উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) যিনি নবীজির ওফাতের পর আরো ৪৮ বৎসর জীবিত ছিলেন, কুরআন হাদীস ফিকহ ইতিহাস বংশনামা ইত্যাদি বিষয়ে গভীর প্রজ্ঞা ও বুৎপত্তির অধিকারী। নারী বিষয়ক ইসলামের অসংখ্য বিষয়ে ২২১০টির অধিক হাদীস বর্ণনা করে ইলমে হাদীসের এক বিশাল ভান্ডার মুসলিম উম্মাহকে উপহার দিয়ে বিশ্ববাসীকে ঋণী করেছেন। রাসূলুল্লাহর যুগে নারীরা নবীজির নিকট আরজ করলেন, আপনি আমাদের জন্য পৃথকভাবে কিছু সময় বরাদ্দ করুন। আপনার দরবারে সর্বদা পুরুষদের ভীড় লেগে থাকে। (ফলে আমরা আপনার গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ শ্রবণ থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকি) আমাদের জন্য একটি পৃথক দিন ধার্য করুন। অত:পর নবীজি তাদের জন্য দিন বরাদ্দ রাখার প্রতিশ্রুতি দেন, এতে তিনি তাঁদেরকে ধর্মীয় বিষয়ে ওয়াজ নসীহত করেন। (সহীহুল বুখারী কিতাবুল ইলম, ১ম খন্ড)
ধর্মীয় শিক্ষা অর্জনে নারীদের উৎসাহ: ধর্ম বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা অর্জনে মহিলা সাহাবীদের উৎসাহ উদ্দীপনা ও আগ্রহ ছিলো অসামান্য। এ প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আনসার নারীগন কতই না উত্তম। তারা ধর্ম বিষয়ে শিক্ষালাভ করতে কোন লজ্জাবোধ করেনা। (সহীহ মুসলিম ১ম খন্ড)
ইসলামের সোনালী যুগে নারীরা হিজাব পরিধান করে সমাজের ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে আছেন। নারীজাতির হিজাব আধুনিকতা ও প্রগতি বিরোধী নয়, বরং হিজাব তথা পর্দা ব্যবস্থা নারীজাতির সম্ভ্রম মর্যাদা ও সম্মান সুরক্ষায় দুর্ভেদ্য রক্ষা কবচ, নারীজাতির মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষনেই ইসলামই একমাত্র আল্লাহর মনোনীত জীবন ব্যবস্থা।
বিদায় হজ্বে ভাষণে নারীর অধিকার প্রসঙ্গ: বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণে নবীজি নারীজাতির মুক্তি ও কল্যাণে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ঘোষনা করেছেন, এরশাদ করেছেন, হে মানবমন্ডলী, তোমাদের প্রতি তোমাদের স্ত্রীদের যেরূপ অধিকার রয়েছে সেরূপ তাদের প্রতি তোমাদের অধিকার রয়েছে। স্ত্রীগণের উপর তোমাদের অধিকার হলো তারা যেন তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে না দেখে যা তোমরা অপচন্দ করো, তোমরা প্রকাশ্যে অপকর্মে লিপ্ত হবেনা। নারীদের সম্পর্কে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, তাদের সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ কর, কেননা তারা তোমাদের নিয়ন্ত্রনে, তোমারা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছ, তার নামেই তারা তোমাদের জন্য হালাল হয়েছে, কোন নারী তার স্বামীর ধন-সম্পদ থেকে কিছু মাত্র তার অনুমতি ব্যাতিরেকে কাউকে দিতে পারবেনা।(আস্‌-সিরাতুন নববিয়্যাহ লি ইবনি হিশাম ৪/৪৪৬-৪৬৭)। হে আল্লাহ বর্তমান সমাজে নারী জাতিকে ইসলামী আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী); খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজ্বালানির উৎস অনুসন্ধানে সঠিক পরিকল্পনাতে নিহিত অর্থনীতির মুক্তি
পরবর্তী নিবন্ধদূরের দুরবিনে