হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব
রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র মর্যাদা
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। যিনি মহাগ্রন্থ আল কুরআনের আয়াত দ্বারা তাঁর প্রিয় নবীর সাহাবাদের মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন। তাঁদের উপর সন্তুষ্টির স্বীকৃতি দিয়েছেন। আয়াত নাযিল করেছেন “আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট।” (সূরা: তাওবা: আয়াত: ১০০)
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি একক ও অদ্বিতীয় তাঁর কোন অংশীদার নেই। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি আমাদের সর্দার মহান অভিভাবক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় বান্দা ও প্রিয় রাসূল। তাঁর উপর দরুদ-সালাম বর্ষিত হোক। তাঁর পবিত্র বংশধরগণ, সম্মানিত সাহাবাগণ ও কিয়ামত অবধি তাঁদের পদাঙ্ক অনুসারীদের প্রতি অসংখ্য করুণাধারা বর্ষিত হোক।
হযরত ওমর (রা.)’র পরিচিতি: আমিরুল মুমেনীন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইসলমের দ্বিতীয় খলিফা। তাঁর নাম ওমর, উপনাম আবু হাফস, উপাধি ফারুকে আজম। পিতার নাম খাত্তাব, মাতার নাম হানতামা। যিনি ছিলেন হিশাম বিন মুগীরার কন্যা, তাঁর অষ্টম পূরুষের ক্রমধারা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলে যায়। তিনি কুরাইশ বংশোদ্ভূত। নবুওয়াতের ৬ষ্ঠ সালে ছাব্বিশ বা সাতাশ বৎসর বয়সে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ( তারিখুল খোলাফা: পৃ: ৮৬, তাবকাত ইবনে সাদ, খন্ড: ০৩, পৃ: ৫৯)
তাঁর পূর্বে ৩৯জন পূরুষ এবং তেইশ জন মহিলা ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি চল্লিশতম ইসলাম গ্রহণকারী পুরুষ।
হযরত ওমরের জন্য রাসূলুল্লাহর দুআ: আল্লাহর নবী দোজাহানের সরদার রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ওমর ’এর জন্য বিশেষভাবে দুআ করেছিলেন, “হে আল্লাহ বিশেষভাবে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব কে মুসলমান বানিয়ে ইসলামকে সম্মান ও শক্তি দান কর।” (ইবনে মাযাহ, পৃ: ১১, আল মুস্তাদারাক লীল হাকিম, খন্ড: ০৩, পৃ: ৮৩)
নবীজির দুআ কবুল হলো, ফারুকে আজম (রা.) ইসলাম গ্রহণে ধন্য হলেন, হযরত ওমর (রা.) ঈমান গ্রহণের সময় সাহাবায়ে কেরাম খুশী আনন্দে উদ্বেলিত হলো, আল্লাহু আকবর তাকবীর ধ্বনিতে মক্কা মুকাররমার পর্বতমালা প্রকম্পিত হলো, (তাবকাত ইবনে সাদ, খন্ড: ০৩ পৃ: ৫৮)
মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ফারুকে আজম (রা.)কে নিজের সন্নিকট বসালেন। পরপর তিনবার নূরনবীজি নবুওয়তের নূরানী হস্ত মোবারক ফারুকে আজমের সীনায় ফিরালেন এবং দুআ করলেন, “ হে আল্লাহ ওমরের সীনাতে যে বিরোধিতা আছে তা বের করে দাও, ওমরের সীনাকে ঈমানের নূর জ্যোতি দিয়ে জ্যোতিময় ও আলোকিত করে দিন। এভাবে নবীজি তিনবার দুআ করলেন।” (আল মুস্তাদরাক লীল হাকিম, খন্ড: ০৩, পৃ: ৮৩)
হযরত ওমর (রা.)’র ইসলাম গ্রহণে আসমানবাসী ফেরেস্তারা উৎসব পালন করেছে: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “যখন হযরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করলেন, হযরত জিবরাঈল (আ:) প্রিয়নবীর দরবারে উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ! হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণে আসমানবাসীরা খুশীর উৎসব পালন করেছে।” (ইবনে মাযাহ, পৃ: ১১, আলমুস্তাদরাক লীল হাকিম, খন্ড: ০৩, পৃ: ৮৩, তারিখুল খোলাফা, পৃ: ১৮৯)
প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা: ওমর (রা.)’র ইসলাম গ্রহণে ইসলামের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো, তিনি প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দিলেন, কা’বার চতুর্দিকে বসা শুরু করলেন, হযরত সুহাইব বিন সিনান বর্ণনা করেন, আমরা প্রকাশ্যে কাবা ঘরের তাওয়াফ শুরু করলাম। যারা আমাদের বাধাদানকারী আমরা তাদের প্রতিরোধের উপযুক্ত হলাম। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, তাবকাত ইবনে সাদ, খন্ড: ০৩, পৃ: ৫৯)
হযরত ওমরের হিজরত: মওলা আলী শেরে খোদা (রা.) বর্ণনা করেন, হযরত ওমর (রা.) ছাড়া আর কারো ব্যাপারে জানি না যিনি প্রকাশ্যে হিজরত করেন, সকলে মক্কার কাফিরদের ভয়ে গোপনে মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনা রওয়ানা হন। হযরত ওমরই প্রকাশ্য তাওয়াফ করলেন, মকামে ইবরাহীমে নামায পড়লেন, কাবার সন্নিকটে উপবিষ্ট মক্কার সর্দারদের প্রত্যেকের নিকট ঘোষণা করলেন, তোমাদের চেহারা মলিন হোক, বিকৃত হোক, তোমাদের মধ্যে এমন কে আছে? যে নিজের মায়ের কোল খালি করতে চায়। যে নিজ ছেলেদের এতিম করতে চায়, নিজের স্ত্রীকে বিধবা করতে চায়, তোমাদের কারো শক্তি থাকলে আমার মোকাবিলা করতে এসো, তাঁর বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতা ও হুঙ্কারে কাফিররা ভীত হয়ে পড়লো কারো সাহস হলো না। (তারিখুল খোলাফা, পৃ: ১৮৮)
হযরত ওমরের রায় মোতাবেক কুরআনের আয়াত অবতরণ: মুজাহিদ থেকে বর্ণিত, আমিরুল মুমেনীন যখন কোনো বিষয়ে রায় দিতেন আল্লাহ তা’য়ালা হযরত ওমর ফারুক আজমের রায় মুতাবিক কুরআনের আয়াত নাযিল করতেন। (তিরমিযী শরীফ, খন্ড: ২, পৃ: ২০৯, উসদুল গাবা, খন্ড: ৩, পৃ: ৬৫৭)
বোখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইসলামের বহু বিষয়ে আমার প্রভূ আমার রায় মোতাবেক কুরআনের আয়াত নাযিল করেন। একদা আমি আমার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কাবা শরীফের তাওয়াফ করছিলাম, আমার অন্তরে ইচ্ছা হলো মকামে ইবরাহীমের পাশে দু’রাকাত নামায আদায় করবো। আমার ইচ্ছা একান্ত ভাবনা মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ব্যক্ত করলাম। তখন আল্লাহ তা’য়ালা আমার মনোভাব ও ইচ্ছা মোতাবেক আয়াত নাযিল করেন, “তোমরা মকাম ইবরাহীমকে নামাযের স্থান বানাও প্রতীয়মান হলো মকামে ইবরাহীম, হযরত ইবরাহীম খলিল (আ:)’র পদচিহ্নের বরকত মন্ডিত স্মারক। মকামে ইবরাহীমে দু’রাকাত ওয়াজিব নামায আদায় করা হযরত ফারুকে আজমের সুন্নাত ও স্মারক। (সূত্র: আনোয়ারুল বায়ান, ৩য় খন্ড, পৃ: ৪০৩)
রাসূলুল্লাহর বিচার অমান্যকারী এক মুনাফিক কে কতল করলেন: এক মুনাফিক ও ইয়াহুদীর মধ্যে সৃষ্ট বিরোধকে কেন্দ্র করে রাসূলুল্লাহ কর্তৃক মিমাংসিত ফায়সালা মানতে মুনাফিক অস্বীকৃতি জানালে দুজনই ফায়সালার জন্য পুনরায় ফারুকে আজমের শরণাপন্ন হলো। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত সিদ্ধান্ত মুনাফিক প্রত্যাখ্যান করার প্রসঙ্গ অবগত হয়ে ফারুকে আজম সেই মুনাফিক কে কতল করলেন। তাঁর সমর্থনে আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করেন, “ (হে মাহবুব) আপনার প্রতিপালকের শপথ, তারা মু’মীন হবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ বিষাদের বিচারভার আপনার উপর অর্পণ না করে। অত:পর আপনার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে না নেয়। (সূরা: নিসা, পারা: ৫, আয়াত: ৬৫, সূত্র: তাফসির খাযেন, খন্ড: ১ম, পৃ: ৪৬১, তাফসীর কবির, খন্ড: ০৩, পৃ: ৩৪৮)
আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রা.)’র বর্ণনা মতে আল্লাহ তা’য়ালা একুশবার হযরত ওমর ফারুক আজম (রা.)’র রায় ও মতামতের সমর্থনে কুরআনের আয়াত নাযিল করেন। (তারিখুল খোলাফা, পৃ: ১৯৮)
হাদীস শরীফের আলোকে ওমর (রা.) ফযীলত: হযরত আইয়ুব বিন মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা ওমরের জবানে সত্য জারী করেছেন। তাঁর অন্তরে সত্যে চিত্রিত করেছেন। তিনি সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী। (আবু দাউদ শরীফ, খন্ড: ২, পৃ: ৫৫, মুদারেজুন নবুওয়ত, খন্ড:২, পৃ: ৯১৫)
উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় আমি দেখতে পাচ্ছি জ্বিন শয়তান ও মানব শয়তান উভয়েই হযরত ওমরের ভয়ে পালিয়ে যায়।” (মিশকাত শরীফ, পৃ: ৫৫৮)
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যদি আমার পর কেউ নবী হতো ওমর নবী হতেন। ( তিরমিযী শরীফ, খন্ড: ২, পৃ: ২০৯)
হযরত ওমর (রা.)’র অবদান: হযরত ওমর (রা.) এর প্রথম খলিফা, যিনি আমীরুল মুমিনীন, উপাধি লাভ করেন, মুসলমানদের স্বতন্ত্র হিজরি সন সর্বপ্রথম তিনি প্রবর্তন করেন। জামাত সহকারে বিশ রাকাত তারাবীহ নামায পড়ার ব্যবস্থা তিনি প্রবর্তন করেন। মদ্য পানে ইসলামী শাস্তির বিধান আশিটি বেত্রাঘাত নির্ধারণে দন্ডবিধি তিনি নির্ধারণ করেন। তিনি নাগরিক সেবা ও রাষ্ট্রীয় সুবিধা জনগণের দৌরগোড়ায় পৌঁছা নিশ্চিত করার জন্য তিনি রাষ্ট্রকে বিভিন্ন প্রাদেশিক বিভাগে বিভক্ত করেন। তিনি ও হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) দু’জনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন। তাঁর খিলাফত কালে ইসলামী সাম্রাজ্যোর পরিধি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়। ১০৩৬টি শহর বিজিত হয়। তাঁরই বলিষ্ঠ পদক্ষেপে বাইজান্টাইন, রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের পতন হয়।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক ও হযরত ওমর (রা.) প্রতি বিদ্বেষ করা কুফরি: হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও হযরত ওমর (রা.)’র প্রতি ভালবাসা ঈমানের পরিচায়ক তাঁদের উভয়ের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ কুফরী। (জামে সগীর, খন্ড: ০১, পৃ: ১৪৬)
আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.) হযরত ফারুক আজমের খিলাফত ও মর্যাদা বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন। “মাতলাউল কামরাইন ফী এবানাতে ছাবকাতিল ওমরাইন।” হিজবি-১২৯৭
“ওয়াজহুল মাশুক বে জালওয়াতে আসমায়িসিদ্দিক ওয়াল ফারুক।” হিজরি-১২৯৭
এতে তিনি সাহাবী বিদ্বেষী শিয়া, রাফেজীদের দাঁত ভাঙা জবাব দিয়েছেন।
খিলাফত: হযরত সিদ্দিক আকবর (রা.)’র ইন্তিকালের পর ফারুকে আজম ১৩ হিজরির ২৩ জমাদিউস সানি ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে খিলাফতের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। ২৩ হিজরি ২৩ জিলহজ্ব ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর খিলাফত সমাপ্ত হয়। তাঁর খিলাফতের মেয়াদকাল ১০ বৎসর ৬ মাস। তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫৩৯টি।
শাহাদত: তিনি সর্বদা আল্লাহর দরবারে দুআ করতেন, “ হে আল্লাহ আমাকে তোমার রাস্তায় শাহাদাত নসীব কর। তোমরা প্রিয় রসূলের শহরে আমার মৃত্যু নসীব কর। (বোখারী শরীফ, খন্ড:১, পৃ: ২৫৩)
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত মুগীরা ইবনে শুবার (রা.) অগ্নি উপসক দাস আবু লুলু ফিরোজ ফজরের নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় এ মহান খলিফাকে ছুরিকাঘাত করেন। ২৩ হিজরি ২৬ জিলহজ্ব বুধবার ৬৩ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। হযর সুহাইব (রা.) তাঁর নামাযে জানাযায় ইমামতি করেন। উম্মুল মু’মেনীন আয়িশা সিদ্দিকা (রা.)’র অনুমতিক্রমে তাঁকে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র বাম পার্শ্বে দাফন করা হয়। (তারিখুল খোলাফা, পৃ: ১৩২)
মহান আল্লাহ আমাদেরকে অন্তরে হযরত ফারুকে আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর আদর্শ নসীব করুন। কুরআনের বরকত আমাদের নসীব করুন। নিশ্চয় তিনি মহান দানশীল, রাজাধিরাজ, পুণ্যময় অনুগ্রহশীল ও দয়ালু।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।