সূরা ফালাক্ব’র শিক্ষা ও তাৎপর্য
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! সৃষ্টির ক্ষতি ও অনিষ্টতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁরই আশ্রয় প্রার্থনা করুন। যাদুর প্রভাব, ভীতিমুক্ত নিরাপদ জীবন লাভে তাঁরই আশ্রয় অনুসন্ধান করুন। মনস্তাত্ত্বিক রোগ “হাসাদ” তথা হিংসা ও ক্রোধ থেকে নিজকে রক্ষা করুন। হিংসুকের ক্ষতি ও অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর আশ্রয় কামনা করুন।
সূরা ফালাক্ব প্রসঙ্গ: তাফসীকারদের মতে সূরা ফালাক্ব মাদানী সূরা, অপর মতানুসারে মক্কী, বিশুদ্ধতর বর্ণনামতে মক্কী, রুকু সংখ্যা এক, আয়াত সংখ্যা পাঁচ, শব্দ সংখ্যা তেইশ, বর্ণ সংখ্যা চুয়াত্তর।
সূরার আলোচ্য বিষয়:
১. লবীদ ইবনে আসেম ইহুদী ও তার কন্যাগণ কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যাদু করার বর্ণনা।
২. সৃষ্টিকুলের বিপদাপদ থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনার বর্ণনা।
৩. কুরআনের আয়াত দ্বারা ঝাড়, ফুক ও তাবিজ লিখন জায়েজ ও শরীয়ত সম্মত হওয়ার বর্ণনা।
৪. হিংসুকের হিংসা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনার শিক্ষা।
সূরার অনুবাদ:
১. আপনি বলুন! আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি, যিনি প্রভাতের সৃষ্টিকর্তা। ২. তাঁর সৃষ্টকুলের অনিষ্ট থেকে, ৩. এবং অনিষ্ট হতে রাত্রির যখন তা গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়। ৪. এবং যে সব নারীর অনিষ্ট হতে যারা গ্রন্থি সমূহে ফুৎকার দেয়। ৫. এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন হিংসা করে। (সূরা: ফালাক্ব, আয়াত: ১-৫)
শানে নুযুল: লবীদ ইবনে আসেম নামক ইহুদী ও তার কন্যাগণ রাসূলুল্লাহর উপর যাদু করেছিলো। নবীজির নূরানী দেহ মুবারকে এর প্রভাব পড়েছিলো। আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ যে, মানুষের ক্ষতি ও অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনার নিয়ম তিনি আমাদের শিখিয়েছেন। এটাও পরীক্ষিত যে আল্লাহর আশ্রয় চাইলে তিনি বান্দার প্রার্থনা কবুল করেন। বান্দাকে নিজের আশ্রয়ে নিয়ে নেন। ইহুদী কর্তৃক নবীজিকে যাদু টোনা করার বিষয়টি হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম নবীকে জানিয়ে দিলেন যে, যাদুর উপকরণগুলো অমুক কূপে একটি পাথরের নীচে রয়েছে। নবীজি কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে হযরত মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সেখানে গেলেন এসব উপকরণ পাথর নীচ থেকে উদ্ধার করে নবীজির দরবারে পেশ করলেন, উল্লেখ্য যে, জনৈক বালক নবীজির কাজকর্ম করত। ইহুদী লোকটি বালকটির মাধ্যমে নবীজির চুল ও চিরুনী হস্তগত করতে সক্ষম হয়। একটি তাঁতের সূতায় এগারটি গ্রন্থি লাগিয়ে প্রত্যেক গ্রন্থিতে একটি করে সুঁই সংযুক্ত করা ছিল। অত:পর আল্লাহ তা’আলা ১১টি আয়াত বিশিষ্ট দু’টি সূরা, ফালাক্ব ও নাস নাযিল করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক গ্রন্থিতে আয়াত তিলাওয়াত পড়ার সাথে সাথে একেকটা গ্রন্থি খুলে যাচ্ছিলো। গ্রন্থি খোলা সমাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে নবীজি পূর্ণরূপে সুস্থতা অনুভব করলেন। সূরা দু’টি নাযিল হওয়ায় নবীজি অত্যন্ত খুশী হয়েছেন ও মানসিক প্রশান্তি পেয়েছেন। [তাফসীরে নুরুল ইরফান কৃত: হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (র.)]
সূরা ফালাক্ব’র আলোকে প্রমাণিত বিষয়:
১. যাদু টোনার প্রভাব দূরীভূত করার জন্য দুআ সমূহ পাঠ করা ও আয়াত সম্বলিত তাবীজ ব্যবহার করা শরীয়ত সম্মত। ২. চুল ও ভাঙ্গা চিরুনি যত্রতত্র ফেলা উচিত নয়, এগুলো যাদু টোনার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয়। তাই রক্ষিত স্থানে ফেলা উচিত।
৩. কুরআনের আয়াতসমূহ পাঠ করে রোগীদের উপর দম করা শরীয়ত সম্মত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে দম করতেন।
৪. মহান আল্লাহ যেভাবে ভোর দ্বারা রাতের অন্ধকার দূর করেন। তেমনি ভাবে কুরআনের আয়াত ও দুআ পাঠের মাধ্যমে রোগব্যাধি থেকে সুস্থতা ও শিফা দান করেন। (তাফসীরে নুরুল ইরফান, সূরা: ফালাক্ব সংশ্লিষ্ট তাফসীর, পারা: ৩০, পৃ: ১৬৯১)
হিংসুকের অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রার্থনা: হাসিদ তথা হিংসুক ব্যক্তি অপরের নিয়ামত সহ্য করেনা। হিংসা নিকৃষ্ট স্বভাব ও মন্দ গুনাহ। হিংসা এক জগন্যতম অপরাধ। হিংসার পরিণতি মারাত্নক ও ভয়াবহ। হিংসুক ব্যক্তি অপরের নিয়ামতের ধ্বংশ ও পতন কামনা করে। মু’মিন একে অপরের প্রতি হিংসাবিদ্বেষ পোষন, হারাম ও নিষিদ্ধ। হিংসা ও ঈর্ষা এক নয়। “গিবতাহ” বা ইর্ষা হচ্ছে নিজের জন্য অন্যের মতো নিয়ামত উন্নতি সুখ শান্তি সমৃদ্ধি ও সাফল্য কামনা করা। ধর্মীয় বিষয়াদিতে ঈর্ষা শরীয়ত সম্মত।
“ওয়া মিন শার্রি হা-সিদিন” আয়াতের তাৎপর্য: হিংসা এমন এক মারাত্মক গুনাহ হিংসুক অন্যের নিয়ামত, সম্পদ, খ্যাতি, সুনাম, মর্যাদা ও সম্মান দেখে হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে। এতে নিজের নেক আমল সমূহ ও ভস্মীভূত করে ফেলে।
হাদীস শরীফে হিংসার পরিণতি: তাজেদারে মদীনা সরকারে দো আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হিংসা নেক আমল সমূহ এমনভাবে ভক্ষণ করে যেমনিভাবে আগুন লাকড়ীকে ভক্ষণ করে। (ইবনে মাযাহ, পৃ: ৩২০, মিশকাত, পৃ: ৪২৮)
নবীজি আরো এরশাদ করেছেন, শীঘ্রই আমার উম্মতের মধ্যে পূর্বেকার উম্মতদের ব্যাধি পৌছে যাবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পূর্বেকার উম্মতের ব্যাধিসমূহ কি? নবীজি বললেন, ১. অহংকার, ২. অধিক সম্পদের মোহ, ৩. পারস্পরিক বিভাজন, ৪. হিংসা করা। (আল মুস্তাদরাক হাকেম, খন্ড: ৪, পৃ: ১৬৮, এয়াহিয়াউল উলুমুদ্দীন, খন্ড:৩, পৃ: ৪২২)
হযরত ইমাম গাজ্জালী (র.) বর্ণনা করেন, হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম বলেন, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, হিংসুক আমার নিয়ামতের শত্রু। সে আমার বিচারের উপর অসন্তুষ্ট, আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যে বণ্টন করেছি, হিংসুক আমার বণ্টনে সন্তুষ্ট নয়। (এয়াহিয়াউল উলুম, খন্ড:৩, পৃ: ৪২২)
সর্বপ্রথম হিংসা করেছে ইবলিস শয়তান: হযরত ইমাম গাজ্জালী (র.) বর্ণনা করেন, সর্বপ্রথম গুনাহ হলো হিংসা করা। অভিশপ্ত মলউন শয়তান ‘হযরত আদম’ আলাইহিস সালামের সম্মান ও মর্যাদা দেখে সর্বপ্রথম তাঁর প্রতি হিংসা করেছে। তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে অস্বীকার করেছে। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ১ম, পৃ: ৬২৪)
আপন ভাইয়ের প্রতি হিংসা করা: ইমাম গাজ্জালী (র.) বর্ণনা করেন, হযরত আদম আলাইহিস সালাম’র পুত্র কাবিল আপন ভাই হাবিলকে হিংসার কারণে হত্যা করেছে। পবিত্র কুরআনে সূরা ইউসূফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম’র ভাইয়েরা তাঁর প্রতি হিংসার কারণে তাঁকে কুপে নিক্ষেপ করেছে। হিংসার কারণে তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছে। ইহুদীরা হিংসার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অস্বীকার করেছেন।
একই সম্প্রদায়ভুক্ত লোকের পারস্পরিক হিংসা: নৈতিকতার অবক্ষয় ও চারিত্রিক অধঃপতনের বাস্তব সমাজচিত্র বড়ই করুণ ও বেদনাদায়ক, এক আলেমের প্রতি অন্য আলেমের হিংসা, এক মুসলমানের প্রতি অন্য মুসলমানের হিংসা, এক ব্যবসায়ীর প্রতি অন্য ব্যবসায়ীর হিংসা, এক ভাই অপর ভাইয়ের প্রতি হিংসা শত্রুতা, এক আত্নীয়ের প্রতি অন্য আত্নীয়ের হিংসা। হযরত ইমাম গাজ্জালী (র.) বর্ণনা করেন, এ সব বর্ণিত অবস্থার মূল ভিত্তি ও কারণ হলো, পার্থিব দুনিয়াবী স্বার্থ। তিনি আরো বলেন, যখন আলেমগন, ইলম দ্বারা দুনিয়ার সম্পদ ও খ্যাতি অর্জনের প্রতিযোগিতায় নিমজ্জিত হবে তখনই একজন অন্যজনের প্রতি হিংসা করতে থাকবে। (এয়াহিয়াউল উলুম, খন্ড: ০৩, পৃ: ৪৪০)
হিংসার প্রতিষেধক: হযরত ইমাম গাজ্জালী (র.) বর্ণনা করেন, হিংসা অন্তরের এক মারাত্নক ব্যাধি। সত্যিকার ইলমে দ্বীন ও তদানুযায়ী আমলই এর একমাত্র প্রতিষেধক। তিনি আরো বলেন, হিংসুক ইহকাল এ পরকালে চুড়ান্ত ক্ষতির সম্মুখীন হবে। যাকে হিংসা করা হয়, দুনিয়া ও আখিরাতে মূলত তার কোন ক্ষতি নেই, বরং উভয় জগতে সে সফলকাম ও লাভবানই হবেন। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ১ম, পৃ: ৬২৬)
সূরার আমল: উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়িশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বিছানায় যেতেন তখন হস্তদ্বয় খুলে ধরতেন এবং তাতে ফুঁ দিতেন উভয় হাতের মাঝে কুরআনের শেষের তিনটি সূরা পড়তেন সূরা ইহলাস, ফালাক্ব ও নাস, পড়তেন। অত:পর উভয় হাত দিয়ে দেহ মুবারকে মোসেহ করতেন, দেহের অন্যান্য অংশেও মোসেহ করতেন, এভাবে তিনি তিনবার করতেন। (বুখারী শরীফ, তাফসীরে ফুয়ুজুর রহমান, পারা: ৩০, পৃ: ১১২৫, কৃত: আল্লামা ফয়েজ আহমদ ওয়েসি)
হে আল্লাহ! আমাদেরকে পবিত্র কুরআনের হিদায়ত দান করুন। এ সূরার বাস্তব শিক্ষা আমাদের জীবনে আমল করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।