পাহাড়ে লেগেছে সোনালী রঙ। পাহাড়ে আদিপদ্ধতিতে চাষ করা জুমের পাকা ধানের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে পাহাড়ি জনপদগুলোতে। চিম্বুক–নীলগিরি সড়কসহ অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোর দুপাশে শোভা পাচ্ছে সবুজ পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে জুম চাষের পাকা ধানের সোনালী রঙ, যেন সোনালী রঙ লেগেছে পাহাড়গুলোতে।
গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে রোয়াংছড়ি উপজেলা আলেক্ষ্যং ইউনিয়নে দেখা গেছে, বটতলী পাড়ার বাসিন্দা জুমচাষি ভালু কুমার তঞ্চঙ্গ্যা পাহাড়ে লাগানো জুমের পাকা ধান কাটা শুরু করেছেন। পরিবারের ছোট–বড় সবাই এবং কয়েকজন নারী শ্রমিক জুমে উৎপাদিত পাকা ধান কাটছেন। জুমে ধানের পাশাপাশি সাথী ফসল হিসেবে বেগুন, ঢেড়স, কাকন, বিন্নি ধান, মরিচ, চালকুমড়া, মিস্টি কুমড়া, ভুট্টা, যব, মারফা’সহ বিভিন্ন প্রজাতির সবজিও চাষ করা হয়েছে।
জুমচাষি ভালু কুমার তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, জুমে উৎপাদিত ফসল খুবই ভালো হয়েছে এবার। ধানের পাশাপাশি সাথী ফসল হিসেবে ৩০–৩৫ প্রকারের বিভিন্ন ধরনের ফল–সবজির চাষ করেছি। সময়মতো বৃষ্টি এবং রোদ্র দেয়ায় জুমের ফসল ভালো হয়েছে। এবার জুম থেকে দেড়শ আড়ি ধান পাওয়ার আশা করছেন এ চাষি।
এদিকে রুমা, থানচি এবং রোয়াংছড়ি উপজেলা অভ্যন্তরীণ সড়কের কয়েকটি স্থানেও জুমে উৎপাদিত ফসল ঘরে তোলতে ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখা গেছে জুমিয়াদের। বাগান পাড়ায় আদিপদ্ধতিতে পাহাড়ের ঝারঝাড় পুড়িয়ে পাহাড়ের ঢালুতে চাষ করা জুম খেতের পাকা ধান কাটছেন ১১ জনের একটা দল। শ্রমিকের সঙ্গে পরিবারের ছোট–বড়, নারী সবাই জুমের ফসল ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আশপাশের পাহাড়গুলোতে দূর–দূরান্তে শোভা পাচ্ছে জুমের পাকা ধানের সোনালী রঙ। চাষিদের অনেকেই আগে জুমে উৎপাদিত সাথী ফসল মিষ্টি কুমড়া, ভুট্টা, মারফা ও চিনাল সংগ্রহ শুরু করেছেন।
স্থানীয় চাষি মেনরথ ম্রো বলেন, জুমচাষিদের এখন দম ফেলার ফুসরত নেই, জুম চাষ ঘিরে বর্তমানে ফসল গড়ে তোলার বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে সবখানে। একই জায়গায় প্রতিবছর জুম চাষ করা যায় না। একটি পাহাড়ে জুম চাষ করার পর কমপক্ষে তিন চার বছর অপেক্ষা করতে হয় জায়গাটি দ্বিতীয়বার জুম চাষের জন্য উর্বর উপযোগী হয়ে উঠার জন্য।
জুমচাষি উৎসবলতা তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষায় মঙ্গোয় ধান এবং মারমাদের ভাষায় মংটং ধান এ বছর পাহাড়ে জুমে চাষে লাগানো হয়েছিল। গত বছর ৭৫ আড়ি দান উৎপাদিত হয়েছিল, আবাহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফসল ভালো হওয়ায় এ বছর ১৫০ আড়ি ধান আশা করছেন।
কৃষি বিভাগ ও জুম চাষিদের তথ্যমতে, প্রতিবছর নভেম্বর–ডিসেম্বর মাসে জুমের জায়গা নির্ধারণ করে জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারি মাসে চাষের জন্য নির্ধারিত জায়গায় পাহাড়ের ঝাড়–জঙ্গল কেটে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। মার্চ–এপ্রিল মাসে প্রথমে ফায়ারিং লাইন করে জঙ্গল পোড়ানো হয়। এপ্রিল মাস জুড়েই জুমের জায়গা পরিষ্কার করে ধান বপনের জন্য প্রস্তুত করে বৃষ্টি হলেই এপ্রিল–মে মাসে পাহাড়ে জুমের ধানসহ সাথী ফসল বপন করা হয়। যারা বৈশাখ মাসের প্রথম বৃষ্টির পর জুমে ধানসহ সাথী ফসল বপন করতে পারেন তাদের ধান আগে পাকা শুরু করে। প্রতিবছর আগস্ট মাসের শেষে অথবা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে জুমের ধান কাটা শুরু হয় এবং সেপ্টেম্বর–অক্টোবর পযর্ন্ত জুমের ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানো প্রক্রিয়া চলে। ধান শুকানো শেষে জুমঘর থেকে মূলঘরে ধান স্থানান্তর করার পর ডিসেম্বর–জানুয়ারি মাসে চলে ঘরে ঘরে জুম ধানের নবান্ন উৎসব।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় ২০২৩ সালে জুম চাষ হয়েছিল ৮ হাজার ৫৪০ হেক্টর জমিতে, উৎপাদন হয়েছিল ১০ হাজার ৪৮৯.৭১ মেট্রিক টন চাল, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে জুম চাষ হয়েছিল ৮ হাজার ২৬৭ হেক্টর এবং চাল উৎপাদন হয় ১২ হাজার ৪৯৯ মেট্রিক টন, ২০২৫–২৬ অর্থবছরে জুম চাষ হয়েছে ৭ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে, চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৬৬ মেট্রিক টন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বান্দরবান কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ–পরিচালক কৃষিবিদ এমএম শাহ নেয়াজ জানান, জেলায় চলতি বছর প্রায় সাড়ে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে আউসের আবাদ হয়েছে। তারমধ্যে শুধু জুমের আবাদই বেশী প্রায় সাড়ে সাত হাজার হেক্টর। জুমে ইদানিং উপসি জাতের ধানও চাষ করা হচ্ছে, সেটাও কম নয়। প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমিতে। এবার যখন কৃষকেরা এপ্রিল–মাসে জুমে বীজ বপন করে তখন সময়মতো বৃষ্টি পেয়েছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকাতে পাহাড়ে জুমের আবাদ ভালো হওয়াতে ফলনও ভালো হয়েছে জুমের ধান পাকা শুরু হয়েছে। সবাই জানে মাইক্রো ক্লাইমেটের ভ্যারিয়েশন থাকার কারণে কোনো এলাকায় আগে কোনো এলাকায় পরে জুমের ধান পাকে। জুমে অনেক ধরনের স্থানীয় ধানের চাষ হয় যেমন বড় ধান, মংটং, গেলন ধান, কালো বিন্নি, লাল বিন্নি, সাদা বিন্নি, নাটং প্রু ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ধানের আবাদ হয় জুমে। স্থানীয় জুমচাষিরা এধরনের বীজ সংরক্ষণ করে থাকেন আর গতবছরের তুলনায় এবছর জুমে ভালো ফলন হওয়ার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।