জুমাবারের সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব

অধ্যক্ষ শামসুজ্জামান হেলালী | শুক্রবার , ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৭:১৭ পূর্বাহ্ণ

হে ঈমানদারগণ! জুমু’আর দিনে যখন সালাতের জন্য ডাকা হয় তখন তোমারা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং বেচাকেনা বন্ধ কর, এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমারা জানতে’।

এই আয়াতে ‘নোদি’ অর্থ যখন ডাকা হয়। এখানে খোতবার আযান বোঝানো হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর, বাগভী] সায়েব ইবনে ইয়াযীদ বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ, আবু বকর এবং উমরের যুগে জুমআর দিনে ইমাম যখন মিম্বরে বসত তখন প্রথম আযান দেয়া হত। তারপর যখন উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগে যখন মানুষ বেড়ে গেল তখন তৃতীয় আহবানটি তিনি বাড়িয়ে দেয়া হল’ [বুখারী: ৯১২]

আরেকটু এগিয়ে গেলে দেখুন, আয়াতে বর্ণিত ‘ফাসাউয়া’ শব্দের এক অর্থ দৌঁড়ানো এবং অপর অর্থ কোনো কাজ গুরুত্ব সহকারে করা। এখানে এই অর্থ উদ্দেশ্য। কারণ, সালাতের জন্যে দৌড়ে আসতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রশান্তি ও গাম্ভীর্য সহকারে সালাতের জন্যে গমন কর’। [বুখারী: ৬৩৬, মুসলিম: ৬০২] অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে আয়াতের অর্থ এই যে, জুমআর দিনে জুমআর আযান দেয়া হলে আল্লাহর যিকিরের দিকে গুরুত্বসহকারে যাও। অর্থাৎ সালাত ও খুতবার জন্যে মসজিদে যেতে যত্নবান হও। যে ব্যক্তি দৌড় দেয়, সে যেমন অন্য কোনো কাজের প্রতি মনোযোগ দেয় না, তোমরাও তেমনি আযানের পর সালাত ও খুতবা ব্যতীত অন্য কাজের দিকে মনোযোগ দিও না। এখানে যিকার’ বলে জুমআর সালাত এবং এই সালাতের অন্যতম শর্ত খুতবাও বোঝানো হয়েছে। বহু হাদীসে জুমআর দিনে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মসজিদে হাযির হওয়ার গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে জুমআর দিনে জানাবত তথা অপবিত্র অবস্থা থেকে পবিত্র হওয়ার মত গোসল করবে, তারপর (প্রথম ঘণ্টায়) মসজিদে হাজির হবে সে যেন একটি উট কুরবানী করল। আর যে ব্যক্তি দ্বিতীয় ঘণ্টায় গেল সে যেন গরু কুরবানী করল। যে তৃতীয় ঘন্টায় গেল সে যেন শিংওয়ালা ছাগল কুরবানী করল। যে চতুর্থ ঘন্টায় গেল সে যেন মুরগী উৎসর্গ করল। যে পঞ্চম ঘন্টায় গেল সে যেন ডিম উৎসর্গ করল। তারপর যখন ইমাম বের হয়ে যায় তখন ফেরেশতারা (লিখা বন্ধ করে) ইমামের কাছে হাযির হয়ে যিকর (খুতবা) শুনতে থাকে।’ [বুখারী: ৮৮১]

তাছাড়া এটা অনেকের নিকট দোআ কবুল হওয়ার সময়। এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জুমআর দিনে এমন একটি সময় আছে কোন মুসলিম যদি সে সময়ে আল্লাহর কাছে কোন কল্যাণ চায় তবে অবশ্যই তিনি তাকে সেটা দিবেন”। [বুখারী: ৬৪০০]

ইসলামি শরিয়তের বিধানে জুমার দিনের মাহাত্ম্য সীমাহীন। রয়েছে সামাজিক গুরুত্ব ও রাজনৈতিক তাৎপর্য। ইসলামী রাজনীতির পীঠস্থান ও সামাজিক শৃঙ্খলা বিধানের সংসদ হচ্ছে মসজিদ। সমাজের সদস্যদের পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে উপস্থিত হয়ে কিছু আনুষ্ঠানিক ইবাদাতের মাধ্যমে যে মুলাকাত, মুআমালাত, মুআশারাত ও মুহাব্বাত অর্জিত হয়। অর্জিত এই সামাজিক সুসম্পর্ককে ঐক্যশক্তিতে রূপান্তরিত করে সামাজিক শৃঙ্খলা বিধান ও রাজনৈতিক নির্দেশনা দেয়ার জন্যই মূলত জুমার সালাতের প্রচলন। সুতরাং জুমাবার দিনটি মুসলিমদের সমাবেশের দিন। এই দিন মসজিদে খতিব সাহেব তার খুতবায় সারা সপ্তাহে ঘটে যাওয়া যত বিকৃতি, বিশৃংখলা ও রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে সমাজ ও রাষ্ট্রের ঐক্যসংহতি বজায় রাখতে সুনীতির সুনাম ও সম্ভাবনার দিক নির্দেশনা দেবেন। সমাজের সংহতি রক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসনের বিকৃতি ঠেকানো এবং রাষ্ট্রের শৃংখলা প্রতিষ্ঠায় এই সাপ্তাহিক সমাবেশ ও সংশ্লিষ্ট খুতবা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হলে আল্লাহ তায়ালা নিজেই সুরা জুমআর উপরোক্ত আয়াতে সে সময় ব্যবসাবাণিজ্য না করার নির্দেশ দিয়েছেন। তা মুসলমানদের অনুধাবন করতে হবে। আমরা শরিয়তের নির্দেশনাগুলোকে দ্বীনে স্প্রীট অনুযায়ী বুঝার চেষ্টা করি না বলে আমাদের ঐক্য সংহতির আজ বড়ই অভাব।

এই ‘ইয়াওমুল জুমআ’র এই দিনের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন হাদীসে এসেছে; যেমন, ‘আল্লাহ তাআলা নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও সমস্ত জগৎকে ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। এই ছয়দিনের শেষদিন ছিল জুমআর দিন [মুসলিম: ২৭৮৯]

আরও এসেছে, ‘যে দিনগুলোতে সূর্য উদিত হয় তন্মধ্যে সবচেয়ে উত্তম দিন হচ্ছে, জুমআর দিন। এই দিনেই আদম আলাইহিস সালাম সৃজিত হন, এই দিনেই তাকে জান্নাতে দাখিল করা হয় এবং এই দিনেই জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামানো হয়। আর কেয়ামত এই দিনেই সংঘটিত হবে।’ [মুসলিম: ৮৫৪] আরও এসেছে, ‘এই দিনে এমন একটি মুহূর্ত আছে, যাতে মানুষ যে দোআই করে, তাই কবুল হয় [বুখারী:১৯৩৫, মুসলিম: ৮৫২]

আল্লাহ তাআলা প্রতি সপ্তাহে মানবজাতিকে আসমানি নির্দেশনা মতে সামাজিক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এই সমাবেশ ও বড়ছোট, সাদাকালো, গরিবধনী সবাই এক কাতারে খুশি উদযাপনের জন্যে এই দিন রেখেছিলেন। কিন্তু পূর্ববতীর্ণ উম্মতরা তা পালন করতে ব্যর্থ হয়। ইয়াহুদীরা ‘ইয়াওমুস সাব্‌ত’ তথা শনিবারকে নিজেদের সমাবেশের দিন নির্ধারিত করে নেয় এবং নাসারারা রবিবারকে। আল্লাহ তাআলা এই উম্মতকে তওফীক দিয়েছেন যে, তারা শুক্রবারকে মনোনীত করেছে। অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমরা সবশেষে এসেও কিয়ামতের দিন অগ্রণী হব। আমরাই প্রথম জান্নাতে প্রবেশ করব। যদিও তাদেরকে আমাদের আগে কিতাব দেয়া হয়েছিল, আর আমাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদের পরে। কিন্তু তারা এতে মতভেদে লিপ্ত হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ আমাদেরকে তাদের মতভেদপূর্ণ বিষয়ে সঠিক পথ দিয়েছেন। এই যে দিনটি, তারা এতে মতভেদ করেছে। অত:পর আল্লাহ আমাদেরকে এ দিনের সঠিক হেদায়াত করেছেন। তা হলো, জুমআর দিন। সুতরাং আজ আমাদের, কাল ইয়াহুদীদের। আর পরশু নাসারাদের।’ [বুখারী: ৮৭৬, মুসলিম: ৮৫৫]

সম্ভবত ইয়াহুদীদের আলোচনার পর পবিত্র কুরআনের জুমআর আলোচনার কারণ এটাই যে, তাদের ইবাদতের যুগ শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন কেবল মুসলিমদের ইবাদতের দিনের প্রতি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে জুমআর দিন।

জুমাবার যেভাবে এলো

প্রথম হিজরি সন। নবী (সা.) মক্কা ছেড়ে মদিনা গেলেন। নবী (সা.) এর মদিনায় পৌঁছার দিনটি ছিল ইয়াওমুল আরুবা (শুক্রবার)। সেদিন তিনি বনি সালেম গোত্রের উপত্যকায় গেলে জোহর নামাজের সময় হয়। সেখানে তিনি জোহর নামাজের পরিবর্তে জুমার নামাজ আদায় করেন। এটাই ইতিহাসের প্রথম জুমার সালাত ।

তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মদিনায় যাওয়ার পর একবার মদিনার আনসার সাহাবিরা আলোচনায় বসেন। তারা বললেন, ইহুদিদের জন্য সপ্তাহে একটি দিন নির্দিষ্ট রয়েছে, যে দিনে তারা সবাই একত্রিত হয়। নাসারারাও সপ্তাহে একদিন একত্রিত হয়। সুতরাং আমাদের জন্য সপ্তাহে একটি দিন নির্দিষ্ট হওয়া প্রয়োজন, যে দিনে আমরা সবাই সমবেত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করব, সংশোধনমূলক আলোচনা ও সালাত আদায় করব। অতঃপর তারা আলোচনায় বললেন, শনিবার ইহুদিদের আর রোববার নাসারাদের জন্য নির্ধারিত। অবশেষে তারা ইয়াওমুল আরুবা শুক্রবারকে গ্রহণ করলেন (সীরাতুল মুস্তাফা ও দারসে তিরমিজি)

আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমরা শেষে এসেছি কিন্তু কেয়ামতের দিন সকলের আগে থাকবো। যদিও অন্য সব জাতিকে (ইহুদি ও খ্রিস্টান) গ্রন্থ দেয়া হয়েছে আমাদের পূর্বে, আমাদের গ্রন্থ দেয়া হয়েছে তাদের পরে। অতঃপর জেনে রাখো এ দিনটি আল্লাহ আমাদের দান করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে আমাদের সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। আর অন্য লোকেরা এ ব্যাপারে আমাদের পেছনে আছে। ইহুদিরা জুমার পরের দিন (শনিবার) উদযাপন করে আর খ্রিস্টানেরা তার পরের দিন (রোববার) উদযাপন করে।’ (সহিহ মুসলিম : ৮৫৬)

এদিনের আমল সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে, এককভাবে অন্য কোনো দিন বা সেদিনের সালাত বা সমবেত হওয়া নিয়ে এত বর্ণনা আর পাওয়া যায় না। যেমন: আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যার ওপর সূর্য উদিত হয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হল জুমার দিন। এই দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তাঁকে জান্নাতে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং এই দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম : ১৪১০)

আরেক বর্ণনায় রয়েছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘জুমার দিন যে ব্যক্তি গোসল করায়, নিজেও ফরজ গোসল করে এবং প্রথম ভাগে মসজিদে গমন করে, পায়ে হেঁটে মসজিদে যায় (অর্থাৎ কোনো কিছুতে আরোহণ করে নয়), ইমামের কাছাকাছি গিয়ে বসে, মনোযোগ দিয়ে খুৎবা শোনে, কোনো কিছু নিয়ে খেল তামাশা করে না; সে ব্যক্তির প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য রয়েছে বছরব্যাপী রোজা পালন ও সারা বছর রাত জেগে ইবাদত করার সমতুল্য সওয়াব।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৬৯৫৪)

সুতরাং জুমআর আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে বর্ণিত আয়াত ও হাদীসগুলোর স্প্রীট বিবেচনা করলে উপসংহারে এটাই বলতে হয় যে, মুসলমানদের সাপ্তাহিক এই সমাবেশ বার্ষিক দুই ঈদে দুই সমাবেশ এবং হজ্জের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সবগুলোর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বে প্রতিটি কোণায় অবস্থানরত মুসলমানরা যেন অখণ্ড, অবিকৃত ইসলামী অনুশাসন মেনে চলে। ইসলামী ঐক্যের ভিত্তি কুরআন সুন্নাহকে আকড়ে ধরে মুসলিম ঐক্য সংহতি বজায় রেখে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত রাখে। মুসলমানদের ব্যক্তিগত জীবন, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও আন্তর্জাতিক জীবনধারায় অভিন্ন ইসলামী সাংস্কৃতিক স্টান্ডার্ড বজায় রাখে তার চেষ্টায় চালানো হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আজ ইসলামী অনুশাসনগুলো অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন পরিলক্ষিত হয়। ইসলামী ঐক্য সংহতি রক্ষা করা ফরজ। কিন্তু আমরা তা ভুলে কতগুলো মুস্তাহাবী বিষয়ে ইজতিহাদ করে আকিদার ধুয়া তুলে উহাবী, সুন্নী, আহলে হাদিস, আহলে কুরআন, ইসমাইলী, ইসহাকী ইত্যাদি দল উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। আল্লাহ যদি আমাদের ক্ষমা না করেন বাঁচার কোনো উপায় নাই। আল্লাহ সবাইকে সঠিক সমজাতীয় দান করুন আমিন।

লেখক: সাবেক কাউন্সিলর, চসিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধমুমিন মুসলমানের গুনাহ মাফের উপায়