জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৯:০৯ পূর্বাহ্ণ

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা’আলার জন্য একনিষ্ঠভাবে সম্পন্ন করুন। কুফর ও শির্কের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করুন। নবীদের আদর্শ এ শিক্ষার অনুসরণে মুমিনদের সাথে সম্পর্ক সুসংহত করুন। নবীদের বিরুদ্ধাচারণকারীদের সর্বোতভাবে ঘৃণা করুন, নবী রাসূলগণ একত্ববাদের দাওয়াত প্রতিষ্ঠা করেছেন, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দ্ধারণ করে দিয়েছেন। তাঁরা আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যকারী হিসেবে দ্বীন বিরোধী সকল ফিতনাকে মূল্যেৎপাটন করেছেন। দ্বীনের সঠিক পথ থেকে তাঁরা চুল পরিমাণও বিচ্যুৎ হননি, দ্বীনি দাওয়াত প্রচারে বিপদাপদ ও কষ্টে ধৈর্যধারণ করা ছিল নবী রাসূলগণের অনুপম বৈশিষ্ট।

হযরত ইসহাক (.) এর পরিচিতি:

হযরত ইসহাক (.) ছিলেন ইবরাহীম (.) এর প্রথম স্ত্রী হযরত সারাহ এর গর্ভজাত একমাত্র পুত্র। তিনি ছিলেন ইসমাঈল (.) এর চেয়ে চৌদ্দ বছরের ছোট। এ সময় পিতা ইবরাহীম (.) এর বয়স ছিল ১০০ বছর, মাতা সারাহ এর বয়স ছিল ৯০ বছর। পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত ২৫ জন নবীগণের মধ্যে হযরত ইসহাক (.) ছিলেন অন্যতম। পবিত্র কুরআনের ১৭ জায়গায় তাঁর নাম উল্লেখ রয়েছে। হযরত ইসহাক (.) এর স্ত্রীর নাম “রাফকাহ” তাঁর গর্ভে দুজন জমজ পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। একজনের নাম ঈসু অন্যজন হযরত ইয়াকুব (.) নবী ছিলেন।

আল কুরআনে হযরত ইসহাক (.) এর জন্মের সুসংবাদ:

মহান আল্লাহ হযরত ইবরাহীম (.) কে ফেরেস্তার মধ্যমে হযরত ইসহাক (.) এর জন্মের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আমি তাঁকে সুসংবাদ দিয়েছি ইসহাকের, যে অদৃশ্যের সংবাদদাতা নবী আমার বিশেষ নৈকট্যের উপযোগীদের অন্যতম। এবং আমি বরকত অবতীর্ণ করেছি তাঁর উপর এবং ইসহাকের উপর আর উভয়ের বংশধরদের মধ্যে কেউ নেককার আবার কেউ নিজের উপর সুস্পষ্ট যুলুমকারী। (সূরা: সাফফাত: ১১২১২৩)

বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যা হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী (রহ.) প্রণীত “তাফসীরে নূরুল ইরফানে” বর্ণিত হয়েছে, হযরত ইবরাহীম (.) আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে যবেহ করার নির্দেশ প্রাপ্ত হলেন ইসমাঈল (.) কে, হযরত ইসহাক (.) কে নয়। কেননা ইসহাক (.) এর জন্মের সুসংবাদ ইসমাঈল (.) এর জন্মের ১৪ বছর পর দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা হযরত ইসহাক (.) এর পবিত্র বংশ থেকে বহু নবী প্রেরণ করেছেন। হযরত ঈসা (.) পর্যন্ত সমস্ত নবী হযরত ইসহাক আলাইহিস সালাম এর বংশধরদের মধ্যে হয়েছেন। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম এর আওলাদ থেকে আবির্ভূত হয়েছেন। আরো প্রতীয়মান হলো আল্লাহ তা’আলা কখনো আপন নবীকে কানুনের বিপরীত নির্দেশও দেন যেমন ইবরাহীম (.) কে তদীয় পুত্র যবেহ করার নির্দেশ কানুন বহির্ভূত ছিলো হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ আলাইহিস সালাম তা মেনে নিয়েছেন। (আয়াত সংশ্লিষ্ট তাফসীর, পৃ: ১২০৪)

হযরত ইসহাক (.) জাতির ইমাম হিসেবে দ্বীনি দাওয়াত দিয়েছেন:

আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট হয়ে নবী ও জাতির পথ প্রদর্শক হিসেবে হযরত ইসহাক (.) শাম এর বিস্তীর্ণ এলাকা আবাদ করেছিলেন। নিজ জাতির লোকদেরকে তাওহীদের আলোকে উদ্ভাসিত করেছেন। তিনি ১০০ বছর হায়াত লাভ করেছিলেন। তিনি কেনআনে ফিলিস্তিন অঞ্চলে ইন্তিকাল করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১/১৮৪)

হযরত ইসহাক (.) ও সাম ইবনে নুহ () এর মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল এক হাজার বৎসরের অধিক। (মুহাম্মদ আলী আসসাবুনী, আন নুবুওয়াত ওয়া আম্বিয়া, পৃ: ১৪৬)

কানআনের হেবরন অপর নাম আল খলীল এলাকায় হযরত ইসহাক (.) জন্ম গ্রহণ করেছেন মর্মে অনুমান করা হয়। হযরত ইব্রাহীম (.) মিসর হতে প্রত্যাবর্তনের পর সেখানে বসবাস শুরু করেন। (তারীখ ইবনে খালদুন, ১ম খন্ড, পৃ: ৫২)

আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, এবং আমি তাঁকে দান করেছি ইসহাক কে আর ইয়াকুবকে পৌত্ররূপে এবং আমি তাদের সবাইকে আমার বিশেষ নৈকট্যের উপযোগী করেছি। এবং আমি তাদেরকে “ইমাম” করেছি। যারা আমার নির্দেশে আহবান করে আর আমি তাদের প্রতি ওহী প্রেরণ করেছি, সৎকর্ম করতে নামায প্রতিষ্ঠা করতে এবং যাকাত প্রদান করতে আর তাঁরা আমার ইবাদত করতো। (সূরা: আম্বিয়া, আয়াত: ৭২,৭৩)

বর্ণিত আয়াত সমূহের ব্যাখ্যায় “তাফসীরে নূরুল ইরাফানে” উল্লেখ হয়েছে, নেককার সন্তান আল্লাহর রহমত যা উভয় জগতে কল্যাণে আসে, নবীগণ হলেন জাতির ইমাম। তাঁদের আনুগত্য করা সবার উপর অপরিহার্য ছিলো। নবীগণের মাধ্যমে তাদের উপর ঈমান আনো সবার উপর ফরজ করা হয়েছে। এটাও প্রতীয়মান হলো সম্মানিত নবীগণ প্রথম থেকেই নেককার ও সৎকর্মপরায়ণ হন।

নবীগণ আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত:

আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত হয়ে থাকেন তাঁরা খোদা প্রদত্ত মর্যাদা ও ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, এবং স্মরণ করুন! আমার বান্দাগণ ইবরাহীম ইসহাক ও ইয়াকুব ক্ষমতা ও জ্ঞান সম্পন্নদেরকে নিশ্চয় আমি তাঁদেরকে এক খাঁটি বাণী দ্বারা স্বতন্ত্র (বিশেষত্ব) দান করেছি। তা হচ্ছে এ জগতের স্মরণ এবং নিশ্চয় তাঁরা আমার নিকট মনোনীত পছন্দনীয়। (সুরা: সাফফাত, আয়াত: ৪৫৪৭)

বর্ণিত আয়াতের তাফসীরে হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান (রহ.) বর্ণনা করেন, মহান রব তাঁর মকবুল বান্দাদেরকে তাঁর কুদরত ক্ষমতা ও তাঁর জ্ঞান দান করেন। যার মাধ্যমে তাঁরা পৃথিবীর খবরা খবর রাখেন এবং বিশ্বে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। তাদের অন্তর দুনিয়ার মুখাপেক্ষী নয়, তাঁদের হৃদয়ে পরকালের স্মরণ ও আল্লাহর যিকরে সমৃদ্ধ। তাঁরা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর প্রতি নিবেদিত এবং আল্লাহও তাদের জন্য। আল্লাহর নৈকট্য পেতে আগ্রহী বান্দারা নবীদের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্যলাভের মর্যাদা অর্জন করেন প্রতীয়মান হলো আল্লাহর প্রিয় ভাজন মকবুল বান্দাদের প্রতিটি কথা ও কাজ রবের নিকট পছন্দনীয়। এ কারণে নবী রাসূলদের কোন কাজের প্রতি অসম্মান ও তিরস্কার করা কুফরী।

সকল নবীর উপর ঈমান আনা ফরজ:

মহান আল্লাহ মানব জাতির হেদায়তের জন্য যত নবী রাসূল আলাইহিমুস সালাম পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন সকলের উপর ঈমান আনা ফরজ। কারো প্রতি অবজ্ঞা, অসম্মান, কারো শান মান ও মর্যাদার প্রতি কটূক্তি করা, কাউকে গালমন্দ করা, সমালোচনা করা, কারো দোষক্রটি বর্ণনা করা, সম্পূর্ণরূপে কুফরী। নবীগণের মর্যাদা সমূহে ব্যবধান রয়েছে কিন্তু নবুয়তে কোন পার্থক্য নেই। একজন অপরজন থেকে উত্তম। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, তাঁরা হলেন রাসূল, আমি তাঁদের একজনকে অপর জনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি। কোন নবী অন্য কোন নবী থেকে নিকৃষ্ট নন, সবাই হলেন উৎকৃষ্ট। নবী রাসূলদের প্রতি মু’মিনের আক্বিদা বিশ্বাস সাহাবায়ে কেরামের মতো হওয়া বাঞ্ছনীয়, যে ব্যক্তি তাঁদের বিরোধী হয় সে কাফির। সাহাবায়ে কেরাম হলেন ঈমানের মানদন্ড (কষ্টি পাথর) স্বরূপ। নবী রাসূলগণের উপর ঈমান আনা দ্বীনের মৌলিক বিষয়। দ্বীনি বিষয়ের উপর ঈমান রাখা অপরিহার্য। অস্বীকার করা কুফরী। দ্বীনের মহত্ব দেখানো ও প্রকাশের জন্য দ্বীনের কান্ডারী, দ্বীনের প্রবর্তক, নবী রাসূল আলাইহিমুস সালামদের মহত্বের প্রতি সতর্ক থাকা ও তাঁদের যথার্থ মযাদার প্রতি লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। নবী রাসূলগন দ্বীনি দাওয়াত ও তাবলীগে দ্বীনের মহান দায়িত্ব পালন ও ইসলামের খিদমত আঞ্জাম দানে তাঁদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। প্রকৃত মু’মিন নবী রাসূলগণের মর্যাদার প্রতি প্রতিনিয়ত সর্বদা শ্রদ্ধাশীল। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তোমরা এভাবে বলো, ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা আমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে আর যা অবতরণ করা হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব এবং তাঁর বংশধরদের উপর আর যা দান করা হয়েছে মুসা ও ঈসাকে এবং যা দান কা হয়েছে অন্যান্য নবীগণকে আমরা তাঁদের কারো উপর ঈমান আনার ক্ষেত্রে পার্থক্য করিনা এবং আমরা আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণকারী। (সূরা: বাক্বারা, আয়াত: ১৩৬) হে আল্লাহ! আমাদেরকে নবী রাসূল আলাইহিমুস সালামের আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানবাধিকার এসোসিয়েট এন্ড ফাউন্ডেশনের শীতবস্ত্র বিতরণ
পরবর্তী নিবন্ধমাটির লড়াই