জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২৫ at ৮:০৭ পূর্বাহ্ণ

প্রিয় মুসলিম ভাইয়রা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, জেনে রাখুন! আল্লাহ তা’আলা মানব জাতিকে সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে পরিচালিত করার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধরাধামে প্রেরণের পূর্বে যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসূল প্রেরণ করে মানব জাতির উপর বড় অনুগ্রহ করেছেন, নবী রাসূলগণ খোদা প্রদত্ত ওহীর আলোকে মানবজাতির সর্বাঙ্গীন কল্যাণ হিদায়াত ও সফলতার পথ প্রদর্শন করেছেন। নবী রাসূলগণের প্রদর্শিত পথ মত অনুসরণ করে যারা আনুগত্য প্রকাশ করেছে তারা হিদায়াত প্রাপ্ত হয়েছে। যারা নবী রাসূলগণের দ্বীনি দাওয়াত ও হেদায়াতকে প্রত্যাখান করেছে তারা পথভ্রষ্ট ও ধ্বংস প্রাপ্ত হয়েছে।

পূর্ববর্তী সকল নবী রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা অপরিহার্য:

উম্মতে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, পূর্বেকার সকল নবী রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। আমরা সকল নবী রাসূলদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে পূর্ববর্তী নবী রাসূলদের জীবন কর্ম আলোকপাত হয়েছে, নবীদের দ্বীনি দাওয়াতের পদ্ধতি কৌশল পন্থা সমকালীন প্রেক্ষাপট প্রতিকুল পরিবেশ পরিস্থিতিতে ধৈর্য, ত্যাগ, তীতিক্ষা ও অবর্ণনীয় কষ্ট স্বীকারের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, রাসূল (হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর প্রতি তাঁর প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যা নাযিল হয়েছে তাতে ঈমান এনেছে এবং মু’মিনগণও, তাদের সকলে আল্লাহর প্রতি তাঁর ফেরেস্তাগণের প্রতি তার কিতাব সমূহের প্রতি এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান এনেছে তারা বলে আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোন তারতম্য করিনা। (সূরা: আল বাকারা, আয়াত: ২৮৫)

সকল নবীদের দ্বীনি দাওয়াতের লক্ষ্য ছিল এক ও অভিন্ন:

সকল নবী রাসূলগন সত্য প্রচারে অটল অবিচল ও আপোষহীন ছিলেন। কোন প্রকার জুলম নির্যাতন ভয় ভীতি তাঁদেরকে মহান আল্লাহর একত্ববাদ তথা তাওহীদের দাওয়াত প্রচার থেকে বিরত রাখতে পারেনি। বিভ্রান্ত দিশেহারা পথভ্রষ্ট মানুষগুলোকে সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে পরিচালিত করাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আমি আপনার পূর্বে এমন কোন রাসূল প্রেরণ করিনি তার প্রতি এই ওহী ব্যাতীত যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই, সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত করো। (সূরা: আম্বিয়া, আয়াত: ২৫)

কাফির মুশরিকদের সাথে সর্ব প্রকার সম্পর্ক পরিত্যজ্য। শান্তি ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একত্ববাদে বিশ্বাসী মু’মিনদের সাথে ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে আল্লাহর উপর পূর্ণ আনুগত্য ও সুদৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন অপরিহার্য। খোদাদ্রোহী কুফরি শক্তির সাথে সামগ্রিকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা ঈমানের অপরিহার্য দাবী। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি এজন্য যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো। (সূরা, নাহল, আয়াত: ১৬)

হযরত ইদরীস (.)’র পরিচয়:

হযরত ইদরীস (.) একজন মহান নবী যার নাম মুবারক পবিত্র কুরআনের ২টি সূরার ২টি আয়াতে মোট ২ বার উল্লেখ হয়েছে, তাঁর নাম মুবারক “আখনূখ” তিনি হযরত শীষ (.)’র বংশধর। অধিকাংশ সাহাবীর মতে তিনি হযরত নূহ (.)’র পরের নবী ছিলেন, ইদরীস শব্দ “দরসুন” থেকে নির্গত, দরস তাদরীস অর্থ পাঠদান, শিক্ষাদান, তিনি সর্বপ্রথম তাঁর জাতিকে কিতাবের পাঠদান, শিক্ষাদান করেছেন এ জন্য তিনি ইদরীস নামে প্রসিদ্ধ। (তাফসীর সাবী, খন্ড: , পৃ: ৪১)

তিনি মিশরে দ্বীনি দাওয়াত প্রচার করেন, তাঁর সময়ে ৭২টি ভাষা প্রচলিত ছিল, তাঁর উপর নাযিলকৃত সহীফার সংখ্যা ৩০, তিনি লিখার জন্য সর্বপ্রথম কলম ব্যবহার করেছেন। তাঁর বয়স ছিল ৩৬৫ বছর। (তাফসীর নূরুল ইরফান, পৃ: ৮২০)

আল কুরআনে কলমের বর্ণনা:

কলম শিক্ষার উপকরণ ‘কলম’ শব্দটি আরবি। পবিত্র কুরআনে “কলম” নামে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা রয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “কলম ও তাদের লিখার শপথ। আয়াতে বর্ণিত কলম দ্বারা ঔই কলম উদ্দেশ্য যা লওহ মাহফুজ এর উপর কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা লিখে দিয়েছে। যার দৈর্ঘ্য আসমান ও জমীনের সমান। অথবা এ কলম দ্বারা কেরামান কাতেবীন এর কলম যা দ্বারা তাঁরা মানুষের কৃত কর্মগুলো লিপিবদ্ধ করেন। অথবা জ্ঞানীদের কলম যা দ্বারা আল্লাহর গুণগান প্রশংসা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র না’ত তথা শানমান প্রশংসা ও ধর্মীয় বিষয়াদি লিখা হয়। (তাফসীর নূরুল ইরফান, পৃ: ১৫৩০)

হযরত ইদরীস (.) একজন ইনসানে কামিল:

নবী ইদরীস (.) পরিপূর্ণ গুণাবলীর অধিকারী মানব। যাঁকে আল্লাহ তা’আলা মু’জিযা হিসেবে জ্যোতিবিজ্ঞান ও গণিত শাস্ত্রের জ্ঞান দান করেছেন। (বাহরে মুহীত)

তিনিই প্রথম বস্ত্র কাপড় সেলাই পদ্ধতি আবিস্কার করেন, জিনিসপত্র মালামাল ওজন করার পদ্ধতি সর্বপ্রথম তিনিই উদ্ভাবন করেন। যুদ্ধাস্ত্র তাঁর আমলেই আবিস্কার হয়। তিনি লৌহ দ্বারা অস্ত্র আবিস্কার করে কাবিল গোত্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। (তাফসীর কুরতুবী, মাযহাবী, রুহুল মা’আনী, তাফসীর নূরুল ইরফান)

আল্লাহ তা’আলা নবীদেরকে শিল্পকর্মের জ্ঞান দান করেছেন:

পবিত্র কুরআনে কঠিন পদার্থ লৌহের বহুবিধ ব্যবহার ও উপকারিতার কথা এসেছে “হাদীদ” অর্থ লৌহ, পবিত্র কুরআনে “আল হাদীদ” বা লৌহ শিল্পের বর্ণনা সংক্রান্ত একটি সূরা রয়েছে, লৌহ একটি মূল্যবান গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ঘর বাড়ী রাস্তাঘাট সেতু কালভার্ট নির্মাণ কাজে লৌহের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা অনস্বীকার্য। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি। যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে আর আমি নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড রণ শক্তি এবং মানুষের বহুবিধ কল্যাণ। এটা এ জন্য যে আল্লাহ জেনে নেবেন কে না দেখে তাঁকে ও তাঁর রাসূলগণকে সাহায্য করে আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী”। (সূরা: আল হাদীদ ২৫)

আল কুরআনে হযরত ইদরীস (.)’র স্মরণ:

নবী রাসূলদের জীবন বৃত্তান্ত আলোচনা করা। তাঁদের জীবনাদর্শ অনুস্মরণ করা আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির মাধ্যম। তাঁরা আল্লাহ কর্তৃক নির্বাচিত প্রিয় বান্দা। হযরত ইদরীস (.) পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত ২৫ জন নবী রাসূলগণের একজন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “এবং কিতাবের মধ্যে ইদরীসকে স্মরণ করুন। নিশ্চয় তিনি ছিলেন সত্যবাদী অদৃশ্যের সংবাদসমূহ বর্ণনাকারী, এবং আমি তাকে উচ্চস্থানের উপর উঠিয়ে নিয়েছি। (সূরা: মরিয়ম, আয়াত, ৫৬৫৭)

বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাকীমূল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (রহ.) তাফসীরে নূরুল ইরফানে বর্ণনা করেন, চারজন নবী জীবিত রয়েছেন, দু জন ভূপৃষ্ঠে হযরত ইলিয়াছ (.), হযরত খাযির (.), হযরত ঈসা (.) আসমানে এবং হযরত ইদরীস (.) জান্নাতে রয়েছেন। সূরা: আম্বিয়াতে আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, এবং ইসমাঈল ইদরীস ও যুল কিফলকে স্মরণ (করুন) তারা প্রত্যেকেই ছিলেন, ধৈর্যশীল। আমি তাঁদেরকে আমার রহমত প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলাম। (সূরা: আম্বিয়া, আয়াত, ৮৫৮৬)

ধৈর্য সফলতার চাবিকাটি:

দ্বীনি দাওয়াত, আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার, খোদাদ্রোহীতা, কুফর, শির্ক ও অনৈসলামিক কাজ থেকে নিজের জাতি গোষ্ঠীকে হেদায়তের পথে ফিরিয়ে আনতে হযরত ইদরীস (.) যে ধৈর্য অবলম্বন করেছেন, তা ছিল এক অনুপম ও অনুসরণীয় আদর্শ।

মিরাজ রজনীতে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ইদরীস (.)’র সাথে সাক্ষাৎ:

মিরাজ রজনীতে হযরত আদম আলাইহিস সালাম’র সাথে প্রথম আসমানে প্রিয় নবীর সাক্ষাৎ হলো। আদম (.) নবীজিকে দেখে সালাম দিলেন, অত:পর নবীজি তাঁকে সালাম দিলেন তিনি সালামের উত্তর দিলেন, বললেন, খোশ আমদেদ সুস্বাগতম ওহে সুসন্তান ওহে নেককার নবী। দ্বিতীয় আসমানে হযরত ইয়াহিয়া ও হযরত ঈসা (.)’র সাথে সাক্ষাৎ হলো, তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসূফ (.)’র সাথে সাক্ষাৎ হলো, চতুর্থ আসমানে হযরত ইদরীস (.) সালামের উত্তর দিয়ে বললেন সুস্বাগতম ওহে নেককার নবী, পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (.)’র সাক্ষৎ হল, সপ্তম আসমানে হযরত ইবরাহীম (.)’র সাথে সাক্ষাৎ হল। (সহীহ মুসলিম, খন্ড: , পৃ: ৯১, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: , পৃ: ৪২৯)

নবী রাসূল আলাইহিমুস সালাম আল্লাহর দেওয়া দ্বীনের পবিত্র আমানত ও দায়িত্ব নিষ্ঠার সথে পালন করেছেন, মহান আল্লাহ তাঁদেরকে সম্মানিত ও মহিমান্বিত করেছেন। মহান আল্লাহ আমাদেরকে নবী রাসূলগণের আদর্শ ও শিক্ষা অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএক বছরেই ‘ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি সিটি’র পথে চট্টগ্রাম
পরবর্তী নিবন্ধহালদা থেকে আরো একটি মৃত কাতলা উদ্ধার