জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৭ অক্টোবর, ২০২৫ at ৯:২১ পূর্বাহ্ণ

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! জেনে রাখুন, আল্লাহ তা’আলা সমগ্র মানব জাতিকে হেদায়ত ও পথ নির্দেশনা দানের জন্য এ ধরাধামে অসংখ্য নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন, নবী রাসূলগণ এ পৃথিবীতে মানবজাতির ইহকালীন শান্তি সাফল্য ও পরকীলীন মুক্তি ও কল্যাণের নিমিত্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত দায়িত্ব পূর্ণ সফলতার সাথে পালন করেছেন। নবী রাসূলগণের শিক্ষাদীক্ষা সকল প্রকার অপূর্ণতা ভুলভ্রান্তি ও সন্দেহ সংশয় থেকে মুক্ত ও পূত:পবিত্র।

নবী রাসূল গণের সংখ্যা:

হাদীস বিশারদগণের বর্ণনা মতে নবী রাসূলগণের সংখ্যা এক লক্ষ চব্বিশহাজার তন্মধ্যে তিনশত তের বা পনের জন রাসূল। (মিশকাত)

পবিত্র কুরআনুল করীমে পঁচিশ জন নবী রাসূলগণের নাম উল্লেখ হয়েছে, . হযরত আদম (.), . হযরত ইদরীস (.), . হযরত নূহ (.), .হযরত হুদ (.), . হযরত সালেহ (.), . হযরত ইব্রাহীম (.), . হযরত ইসমাঈল (.), . হযরত লুত (.), . হযরত ইসহাক (.), ১০. হযরত ইয়াকুব (.), ১১. হযরত ইউসূফ (.), ১২. হযরত মুসা (.), ১৩. হযরত শু’আইব (.), ১৪. হযরত মুসা (.), ১৫. হযরত হারুন (.), ১৬. হযরত আইয়ুব (.), ১৭. হযরত ইউনুস (.), ১৮.হযরত দাউদ (.), ১৯. হযরত সুলায়মান (.), ২০. হযরত যাকারিয়া (.), ২১. হযরত ইয়াহইয়া (.), ২২. হযরত আল ইয়াস (.), ২৩. হযরত যুল কিফল (.), ২৪. হযতর ঈসা (.), ২৫. হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

হযরত আদম (.) পৃথিবীতে প্রথম মানব ও নবী:

মানব জাতির আদি পিতা (আবুল বাশর) আদম (.) তিনি পৃথিবীতে প্রথম মানব ও নবী। তিনি ছফিউল্লাহ (আল্লাহর মনোনীত) উপাধিতে ভূষিত। তিনি খলীফাতুল্লাহ ফিল আরদ (পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি) পবিত্র কুরআনে “আদম” শব্দটি ২৫ বার এসেছে।

আদম নামকরণ:

ভাষা বিদগন ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগ বা ভূমিকেও আদম বলেছেন। যেহেতু আদম (.) কে ভূপৃষ্ঠের মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে তাই তাঁকে আদম বলা হয়। আল্লাহ তা’আলা মানব জাতি সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নিলে হযরত জিবরাঈল (.) কে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাটি সংগ্রহের নির্দেশ দেন, হযরত জিবরাঈল (.) আদিষ্ট হয়ে বিভিন্ন রং এর মাটি সংগ্রহ করে আল্লাহর নিকট পেশ করেন। নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় আদম (.)’র শারীরিক কাঠামো তৈরী করা হয় এবং তাঁর দেহে রূহ রূপ প্রদানের মাধ্যমে তাঁকে জীবন্ত মানবরূপে সৃজন করা হয়। আদম শব্দটি “উদমাতুন” থেকে নির্গত, প্রখ্যাত তাফসীরকার আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) বলেন এর অর্থ হলো বাদামী রং বিশিষ্ট।

আদম (.) সৃষ্টি প্রসঙ্গে ফেরেস্তাদের সাথে আল্লাহর পরামর্শ:

আল্লাহ তা’আলা হযরত আদম (.) কে সৃষ্টির পূর্বে ফেরেস্তা ও জ্বিন জাতিকে সৃষ্টি করেন, তারপর আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেন, যেন মানুষ আল্লাহর ইবাদত তথা দাসত্ব করে এবং পৃথিবীকে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে। মহান আল্লাহ ফেরেস্তাদের লক্ষ্য করে বলেন, “এবং স্মরণ করুন! যখন আপনার রব ফিরিশতাদেরকে বললেন, “আমি পৃথিবীতে আপন প্রতিনিধি সৃষ্টিকারী। (তারা) বললো, আপনি কি এমন কোন সৃষ্টিকে প্রতিনিধি করবেন, যে তাতে ফ্যাসাদ ছড়াবে ও রক্তপাত ঘটাবে, আর আমরা আপনার প্রশংসা পূর্বক আপনার তাসবীহ (স্তুতিগান) করি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করি তিনি বললেন, আমার জানা আছে যা তোমরা জানো না। (সূরা: বাক্বারা, আয়াত: ৩০)

আয়াত সংশ্লিষ্ট তাফসীর: বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় উপমহাদেশের প্রখ্যাত তাফসীরকার হাকীমুল উম্মত মুফাতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (রা.) বলেন, ফিরিস্তাদের কে অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে, ফেরেস্তারা মানব জাতি সৃষ্টির পূর্বে তাদের কার্যকলাপ কিরূপ হবে তা বলে দিয়েছেন, মানব জাতি যে পৃথিবীতে ফিতনা ফাসাদ ছড়াবে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে নৈরাজ্য বিশৃংখলা ও রক্তপাত করবে তা ফেরেস্তারা মানব সৃষ্টির পূর্বেই বলে দিয়েছেন, এ কথাও প্রতীয়মান হলো পরামর্শ করা আল্লাহর সুন্নাত, আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ মহান তিনি কারো পরামর্শের মুখাপেক্ষী নন, তবুও তিনি ফেরেস্তাদের পরামর্শ গ্রহণ করলেন, পরামর্শের ক্ষেত্রে আপন মতামত অভিমত প্রকাশ করার অধিকার প্রত্যেকের থাকে ফেরেস্তারাও নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছেন। (তাফসীরে নূরুল ইরফান, সূরা: বাক্বারা, আয়াত: ৬৩, পৃ:১২)

মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম সকল ভাষায় কথা বলেন হযরত আদম (.):

আল্লাহ তা’আলা নবী রাসূলগনকে পরিপূর্ণ জ্ঞানে জ্ঞানী করেছেন। তাঁদের জ্ঞান পূর্ণাঙ্গ নিখুঁত নির্ভূল। আল্লাহ তা’আলা হযরত আদম এর জ্ঞানের বর্ণনা প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, এবং আল্লাহ তা’আলা আদমকে যাবতীয় (বস্তুর) নাম শিক্ষা দিলেন অত:পর সমুদয় বস্তু ফিরিস্তাদের সামনে উপস্থাপন করে এরশাদ করলেন সত্যবাদী হলে এসব বস্তুর নাম বলো তো। (তারা) বললো পবিত্রতা আপনারই আমাদের কোন জ্ঞান নেই, কিন্তু (ততটুকুই) যতটুকু আপনি আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, নিশ্চয় আপনিই জ্ঞানময়, প্রজ্ঞাময়। (সূরা: বাক্বারা, আয়াত: ৩১.৩২)

ইমাম কুরতুবী (.) বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, মানুষের মধ্যে যিনি সর্বপ্রথম সকল ভাষায় কথা বলেন, তিনি হযরত আদম (.)। আর সে সব ভাষার মধ্যে আরবি ভাষাও শামিল। (কুরতুবী, খন্ড ১ম, পৃ: ২৮৪)

উপরোক্ত আয়াতে করীমার ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত তাফসীরকার আল্লামা মুহাম্মদ আলী সাবুনী বলেন, পৃথিবীতে আদম সন্তানেরা যে সব ভাষায় কথা বলবে সব ভাষা ও সব বস্তুর নাম এমনকি প্রত্যেক বস্তুর গুনাগুন ও প্রকৃতি কিরূপ হবে তাও হযরত আদম (.) কে আল্লাহ তা’আলা শিক্ষা দিয়েছেন। (মুখতাসার তাফসীরে ইবনে কাসীর, ১ম খন্ড, পৃ: ৫১)

হযরত আবদুল মালেক বিন হাবীর (.)’র মতে হযরত আদম (.) আরবি ভাষাসহ জান্নাত থেকে পৃথিবীতে অবতরন করেন। ইবনু ফারেস বর্ণনা করেন, হযরত আদম (.) ইন্তিকালের তিনশত বছর পূর্বে আরবি ভাষায় মাটির উপর কিতাব লিখেছেন। (আহমদ ইবনু ফারেস আসসাহাবী)

হাদীস শরীফের আলোকে হযরত আদম (.)’র বয়স:

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন আল্লাহ তা’আলা হযরত আদম (.)কে সৃষ্টি করলেন তখন তাঁর পিঠের উপর কুদরতের হাত বুলিয়ে দিলেন, তখন তাঁর পিঠ হতে কিয়ামত পর্যন্ত তার সন্তানদের রূহ সমূহ বের হলো তাঁর সন্তানদের মধ্যে কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহ যাদেরকে সৃষ্টি করবেন এবং তাদের মধ্যে প্রত্যেক মানুষকে দু’চোখের মধ্যখানে নূরের চমক দিলেন অতঃপর তাদেরকে হযরত আদম (.)’র নিকট পেশ করলেন, তিনি বললেন হে প্রতিপালক এরা কারা? বললেন, তোমার সন্তানগন, তিনি তাদের মধ্যে একজনকে দেখলেন এতে তার চোখের মধ্যভাগের চমক পছন্দ হলো, তিনি বললেন হে রব? ইনি কে? বললেন, হযরত দাউদ, বললেন, হে রব? তাঁর বয়স কত নির্ধারণ করেছেন, বললেন, ষাট বছর, তিনি আরজ করলেন হে রব! আমার বয়স হতে চল্লিশ বছর নিয়ে তাকে বৃদ্ধি করে দিন। (তিরমিযী শরীফ)

বর্ণিত হাদীসের ব্যাখ্যায় হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার নাঈমী (রহ) বলেন, হযরত আদম (.) এর বয়স এক হাজার বছর নির্ধারিত ছিলো, তিনি আরয করলেন আমার হায়াত নয়শত ষাট বছর করে, দাউদ (.)’র হায়াত পূর্ণ একশ বছর করে দিন। আল্লাহ তা’আলা এ দুআ কবুল করে নিলেন। প্রতীয়মান হলো সম্মানিত নবীর দুআর বরকতে হায়াতে হ্রাস বৃদ্ধি হয়। হযরত ঈসা (.) মৃতদের জীবিত করতেন। তাঁর দুআর বরকতে তাদের নতুন হায়াত অর্জিত হতো। (মিরআতুল মানাজীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, ১ম খন্ড, পৃ: ১১৯)

আদম (.)’র প্রথম পুত্রের নাম কাবিল, প্রথমা কন্যা সন্তানের নাম আকলিমা। আদম (.)’র উচ্চতা ছিল ৬০ হাত এবং প্রস্থে ৭ হাত। আদম ও হাওয়া (.) সাড়ে তিনশত বছর পর মক্কার সন্নিকটস্থ আরাফাতের ময়দানে মিলিত হয়। সপ্তাহের সর্বোত্তম দিন জুমাবার আদম (.) কে সৃষ্টি করা হয়। এ দিনেই তিনি জান্নাতে প্রবেশ করেন, এ দিনেই পৃথিবীতে অবতরণ করেন, এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। (তাফসীরে ইবেন কাসীর, খন্ড:১ম, পৃ: ১২৭)

এক বর্ণনামতে হযরত আদম (.) বেহেস্তে একশত বছর ছিলেন, হযরত আদম (.) প্রথম কাবার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। জুমাবার দিনেই তিনি ওফাত বরণ করেছিলেন, ওফাতের সময় তাঁর সন্তান সন্তুতির সংখ্যা ছিল চল্লিশ হাজার। (তাফসীরে ইবেন কাসীর, খন্ড:১ম, পৃ: ৯৬)

হযরত শীষ (.) হযরত আদম (.)’র জানাযা পড়ান। তাঁর জানাযায় তাঁর মর্যাদা প্রকাশের জন্য ত্রিশটি তাকবীর দেওয়া হয়েছিল। (তাবকাতে ইবনে সাআদ, খন্ড:১ম, পৃ: ১৫), হযরত আদম (.) শ্রীলংকার “নুয” নামক পাহাড়ে ওফাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। আল্লাহ তা’আলা আমাদের আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালাম’র ওসীলায় আমাদের ক্ষমা করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচুনতি অভয়ারণ্যে ছড়া থেকে উত্তোলিত বালু জব্দ
পরবর্তী নিবন্ধকাল ব্যাংক খোলা থাকবে