মু’জিযা শব্দের অর্থ:
মু’জিযা শব্দটি আরবি। এর শব্দগত অর্থ অভিভূতকারী, পরাভূতকারী, অক্ষমকারী। সম্মানিত নবী রাসূলগণের পক্ষ থেকে নবুওয়তের সত্যতা প্রকাশ করার জন্য এমন আশ্চর্যজনক বিষয় প্রকাশ পাওয়া যা সাধারণত ঘটে না। স্বাভাবিকতার বিপরীত কিছু সংঘটিত হওয়ার নাম মু’জিযা। পবিত্র কুরআনে মু’জিযাকে “বুরহান” বলা হয়েছে।
মু’জিযার পারিভাষিক সংজ্ঞা: প্রসিদ্ধ আকাঈদ বিশেষজ্ঞ আল্লামা তাফতাযানী (র.) মুজিযার পরিভাষিক অর্থ বর্ণনা করেছেন এভাবে যে, “মু’জিযা এমন একটা বিষয় যা প্রচলিত সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম, যা নবুওয়তের দাবীদারদের দ্বারা প্রকাশিত হয়, নবুওয়ত অস্বীকারকারীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় মহান আল্লাহ পাক নবীদের দ্বারা এ কাজ সংঘটিত করেন। বিষয়টি এমন যে, এর মুকাবিলা করা অবিশ্বাসী এবং অস্বীকারকারী লোকদের পক্ষে অসম্ভব। (শরহুল আকাঈদ আন–নাসাফিয়া, পৃ: ১২৪)
মু’জিযার সংখ্যা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মু’জিযার সংখ্যা গণনা করা অসম্ভব। নবীজির পবিত্র সত্তা পূর্ববর্তী সকল সম্মানিত নবীগণের মু’জিযার সমষ্টি। আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় হাবীব আমাদের মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন অসংখ্য মু’জিযা দান করেছেন, যা অন্য কোনো নবী ও রাসূলকে দান করা হয়নি, এ কথা কোনো নবী ও রাসূলকে দান করা হয়নি। এ কথা উজ্জ্বল দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট যে, নবীজির পবিত্র নুরানী জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মু’জিযা ও আল্লাহ কুদরতের নিদর্শন। রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মু’জিযার সংখ্যা অগণিত। তবে যে গুলো প্রামাণ্য নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলির আলোকে দেদীপ্যমান সেগুলোর সংখ্যাও দশ সহস্রাধিক। আল্লামা কাযী আয়ায (র.)’র বর্ণনামতে পবিত্র কুরআনের মু’জিযার সংখ্যা হলো সত হাজার সাত’শ, ইমাম বায়হাকী (র.)’র বর্ণনা মতে রাসূলুল্লাহর মু’জিযার সংখ্যা এক হাজার। ইমাম নববী (র.)’র মতে মু’জিযার সংখ্যা এক হাজার দু’শ। ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ুতি (র.) প্রণীত “খাসায়েসে কুবরা” কিতাবে এক হাজার মু’জিযার বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন। এক বর্ণনা মতে মু’জিযার সংখ্যা তিন হাজার, ইমাম আবু নু’আঈম (র.) প্রণীত “দলাইলে নবুওয়াত” কিতাবটিও মু’জিযা সংক্রান্ত উল্লেখ্যযোগ্য দলীল।
নবী রাসূলদের মু’জিযা: নবী রাসূলগণ মু’জিযা প্রদর্শনের মাধ্যমে একদিকে আল্লাহর কুদরত প্রকাশ ঘটিয়েছেন অপরদিকে নবুয়ত রিসালতের সত্যতা প্রমাণ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা নিম্নোক্ত ঘটনাবলী দ্বারা স্বীয় কুদরতের প্রকাশ ঘটিয়েছেন, যেমন পিতা মাতা ছাড়াই আদম (আ) কে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর বাঁদিকের পাঁজর হতে হযরত হাওয়া (আ.)কে সৃষ্টি করেছেন। আদম (আ) কে জান্নাত থেকে জমিনে অবতরণ করিয়েছেন, হযরত ইদরিস (আ)কে আসমানে উত্তোলন করেছেন, হযরত ইবরাহীম (আ’)র জন্য অগ্নিকুন্ডকে শীতল ও আরামদায়ক করে দিয়েছেন। হযরত মুসা (আ.) এর জন্য সমূদ্রের মাঝপথে রাস্তা করে দিয়েছেন। হযরত ঈসা (আ.) কে পিতা ছাড়া সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর হাবীব কে সাতাশ রজব রাতের সংক্ষিপ্ত সময়ে সপ্ত আকাশ পরিভ্রমণ করিয়ে নিজ দিদার দানে ধন্য করেন। সর্ব নিয়ন্তা সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর পক্ষে এসব কিছু অসম্ভব নয়। এ সব বিষয়াদি তার কুদরতী শক্তির বহি:প্রকাশ।
পূর্ববর্তী নবীদের মু’জিযা: হযরত মুসা (আ.)’র লাঠি সাপ হয়ে যাওয়া এটা ছিল মুসা (আ.)’র মু’জিযা, মু’জিযার মুকাবিলা করা আদৌ সম্ভব নয়, মুসা (আ.)’র মুজিযার সামনে ফিরআউনের আনীত দেড়লক্ষ যাদুকর ব্যর্থ হতে বাধ্য হয়। হযরত ঈসা (আ)’র যুগে চিকিৎসাবিদ্যার প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে রোগী সুস্থ করা, মৃতকে জীবিত করার, মু’জিযা দান করেছেন। কুষ্ট রোগ ও অন্ধকে দৃষ্টি শক্তি দান করা, হযরত ঈসা (আ)’র মুজিযা যা ছিল তাঁর নবুওয়তের সুস্পষ্ট প্রমাণ ও অভ্রান্ত দলীল। হযরত সালেহ (আ)’র যুগে পাথর খোদাই করা ও মূর্তি তৈরী করার ব্যাপক প্রচলন ছিল, এমন সময়ে আল্লাহ তা’আলা হযরত সালেহ (আ) কে এরূপ মু’জিযা দান করলেন যে, তিনি একটি পাহাড়ের দিকে ইশারা করার সাথে সাথে পাহাড়ের একটি বড় পাথর ফেটে দু’ টুকরো হয়ে পাথরের ভেতর থেকে একটি চমৎকার সুন্দর ও স্বাস্থ্যবর্তী উষ্ঠী এবং তার একটি বাচ্চা বেরিয়ে এলো তখন হযরত সালেহ (আ) বলেন, আল্লাহর এই উষ্ঠী তোমাদের জন্য নিদর্শন স্বরূপ। (সূরা: আরাফ, আয়াত: ৭৩)
এ দৃশ্য দেখে হযরত সালেহ (আ.)’র গোত্রের লোকেরা মূর্তি পুজা ত্যাগ করে আল্লাহর উপর ঈমান এনেছিল। (সীরাত–এ মুস্তাফা, পৃ: ৫০৪)
মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী সকল নবীদের মু’জিযা, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবীর সত্বার মধ্যে একীভূত করেছেন। আল্লাহ তা’আলা কোনো নবীকে একটি, কোনো নবীকে দুটি, কোনো নবীকে একাধিক, মু’জিযা দান করেছেন কিন্তু সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ইমামুল আম্বিয়া, সৈয়্যদুল মুরসালীন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্র সত্বার মধ্যে পূর্ববর্তী সকল নবী রাসূল আলাইহিমুস সালাম এর সকল মু’জিযা একীভূত করে তাঁকে অসংখ্য অগনিত মু’জিযা দিয়ে সম্মানিত করেছেন ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। তাঁর মু’জিযার পরিধি উর্ধ্বজগতে নিম্নজগতে পৃথিবী থেকে আরশ মুআল্লাহ পর্যন্ত সর্বত্র বিস্তৃত। নবীজি আঙ্গুল মুবারকের ইশারায় চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা, অস্তমিত সূর্য পূনরায় উদিত করা, আঙ্গুল মুবারক থেকে পানির ঝর্ণা প্রবাহিত করা, এক মুহূর্তেই জমিন থেকে সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করে আরশে মুয়াল্লা পরিভ্রমন করে মুহূর্তের মধ্যে ফিরে আসা, একমুষ্টি খেজুর দিয়ে সাহাবা কেরামের বিশাল কাফেলাকে তৃপ্তিসহকারে আহার করানো ছিল নি:সন্দেহে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মু’জিযার বহি: প্রকাশ। (সীরাত–এ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কৃত: আল্লামা আবদুল মুস্তফা আযমী, পৃ: ৫০৫)
চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা পবিত্র কুরআনের আলোকে প্রমাণিত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার ঘটনা কুরআন ও হাদীসের আলোকে প্রমাণিত সুপ্রসিদ্ধ ঘটনা। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, কিয়ামত সন্নিকটে এসেছে এবং চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়েছে এবং কাফিররা যদি কোন নিদর্শন দেখে তখন মূখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলতে থাকে এ টাতো চিরাচরিত কোনো যাদু। (সূরা: ক্বাসার, আয়াত: ১–২)
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, মক্কার কাফিররা রাসূলুল্লাহর নবুওয়তের সত্যতা প্রমানের জন্য দলীল স্বরূপ মু’জিযা প্রদর্শন করার দাবী করেন, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করণের মু’জিযা প্রদর্শন করেন। বুখারী, মুসলিম তিরমিযীসহ হাদীসের অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এ ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন, তিনি এ মুজিযা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন, চাঁদের এক টুকরা পাহাড়ের ওপর আরেক টুকরা পাহাড়ের নীচে দেখা যাচ্ছিল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাফিরদেরকে এই দৃশ্য দেখানোর পর এরশাদ করেন তোমরা সাক্ষী থাকো, তোমরা সাক্ষী থাকো। (বুখারী, ২য় খন্ড, পৃ: ৭২১)
অস্তমিত সূর্য উদিত হওয়ার মু’জিযা: আল্লাহর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র খোদা প্রদত্ত ক্ষমতা জমীন থেকে আরশে মুয়াল্লা পর্যন্ত সর্বত্র কার্যকর। অস্তমিত সূর্য নবীজির নির্দেশে পূনরায় উদিত হলো। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আসমা বিনতে উমাইস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম’র উপর ওহী অবতীর্ণ হচ্ছিল এমতাবস্থায় তাঁর মাথা মোবারক হযরত আলী (রা.)’র কোলে, হযরত আলী (রা.) তখনও আসর নামায আদায় করেননি, এমনকি সূর্য অস্তমিত হয়ে গেল, নবীজি এরশাদ করলেন, হে আল্লাহ! হযরত আলী (রা.) তোমার এবং তোমার রাসূলের আনুগত্যের মধ্যে আছেন। হে আল্লাহ তাঁর জন্য সূর্য ফিরিয়ে দাও, হযরত আসমা বলেন, আমি সূর্য অস্ত যেতে দেখলাম আবার অস্ত যাওয়ার পর উদিত হতেও দেখলাম। (তাবরানী, আল মুজামুল কবীর, হাদীস: ৩৯০)
হাদীস শরীফের আলেকে মু’জিযা: বিষ মিশ্রিত খাদ্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাথে কথা বলেছেন, বিষ মিশ্রিত খাদ্য নবীজির ক্ষতি করতে পারেননি। এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু সালমা (রাদ্বি.) বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীয়া গ্রহণ করতেন, (আহার করতেন) কিন্তু সাদকা আহার করতেন না। খায়বরের এক মহিলা নারী নবীজিকে হাদীয়া হিসেবে ভুনা ছাগল পেশ করেন তিনি আহার শুরু করলেন সাথে সাথে তাঁর সঙ্গী হযরত বিশর ইবন বারা (রাদ্বি.) ও আহার শুরু করলেন, অত:পর নবীজি খাবার থেকে নিজ হাত মুবারক তুলে নিলেন এবং বললেন, এ মাংস আমাকে বলেছে “ আমি বিষ মিশ্রিত” হযরত বিশির খাদ্যের বিষক্রিয়ায় সাথে সাথে শহীদ হয়ে গেল। নবীজি মহিলার নিকট সংবাদ পাঠালেন তুমি এ কাজ কেন করলে? মহিলা উত্তর দিল, যদি আপনি নবী হন তাহলে কোন কিছুই আপনার ক্ষতি করতে পারবেনা। (ইমাম বায়হাকী, সুনানুল কুবরা, হাদীস: ১৫৭৮৪)
হে আল্লাহ আমাদের মহান রাসূলের শানমান ও অনুপম মর্যাদা বুঝার ও রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।











