জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভী | শুক্রবার , ১৫ আগস্ট, ২০২৫ at ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ

প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা!

আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন। আল্লাহর নির্দেশিত ও প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র অনুসৃত পুণ্যময় আমলের মাধ্যমে জান্নাতের পথ সুগম করুন। সকল প্রকার কবীরা গুনাহ থেকে নিজকে রক্ষা করুন।

কবীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকলে সগীরা গুনাহ ক্ষমা করা হবে:

কবীরা গুনাহ অর্থ বড় গুনাহ্‌, ইসলামী শরীয়তে যে গুনাহে লিপ্ত হলে কঠোর ও ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত, কবীরাহ্‌ গুনাহ্‌ তাওবা ছাড়া ক্ষমা হয়না, তাওবা করা আবশ্যক। নেক আমলসমূহ দ্বারা সগীরাহ্‌ গুনাহ্‌ আল্লাহ্‌ ক্ষমা করেন। তবে সগীরাহ্‌ গুনাহ্‌ যদি লাগামহীন ঔদ্ধত্যের সাথে বারবার করা হয় সেক্ষেত্রে তা কবীরার পর্যায়ভুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, যদি তোমরা কবীরা গুনাহসমুহ বর্জন কর যা করতে তোমাদের নিষেধ করা হয়েছে তবে আমি তোমাদের সগীরা গুনাহ্‌সমূহ ক্ষমা করে দেব। (:৩১)

হাদীস শরীফের আলোকে সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজের বর্ণনা:

. আল্লাহর সাথে শিরক করা: আকাইদ বিশেষজ্ঞদের বর্ণনা মতে ইসলামী পরিভাষায় শিরক অর্থ হচ্ছে আল্লাহর উলুহিয়্যাত তথা একত্ববাদের মধ্যে শরীক স্থির করা। যিনি ইলাহ, তিনি শাশ্বত চিরঞ্জীব যার অস্তিত্ব অপরিহার্য। যেমন অগ্নিপূজারীরা এ অর্থে আগুনকে আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করে অথবা অন্য কাউকে ইবাদতের উপযোগী মনে করা। যেমন মূর্তিপূজারীরা তাদের মূর্তিগুলোকে তাদের উপাসনার উপযোগী বিশ্বাস করা। (শারহুল আকাইদ লিন নাসাফী, পৃ: ২১)

শিরক অমার্জনীয় অপরাধ: শিরক প্রধানত দু’ প্রকার, . শিরকে আকবার, ও ২. শিরকে আসগর। শিরকে আকবর হলো আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বলে বিশ্বাস করা, কোনো সৃষ্টিকে আল্লাহ তা’আলার মত আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর সমকক্ষ বা সম মর্যাদা সম্পন্ন মনে করা। শিরকে আসগর হলো, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যের সাথে সৃষ্টির অন্য কারো সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যকে নিয়্যত রাখা। যেমন ইবাদতে লৌকিকতা, লোক দেখানো, লোক শুনানোর নিয়্যতে ইবাদত করা, সুনাম ও খ্যাতি অর্জনের লক্ষ্যে জনসেবা করা, দান সাদকা করা। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে এরশাদ করেছেন, রিয়া তথা লোক দেখানো হচ্ছে শিরকে খফী অপ্রকাশ্য শিরক।

শিরক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করনে না। এটি ব্যতীত যা সবকিছু যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করেন। (আল কুরআন:১১৬)

শিরককারীর জন্য জান্নাতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই যে আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন, তার ঠিকানা হচ্ছে জাহান্নাম। (আল কুরআন, :৭২)

. যাদু করা: যাদুতে যদি কুফরি শব্দাবলি থাকে তাহলে যাদুকর মুরতাদ হয়ে যায়। নিছক বিপর্যয় সৃষ্টি করার জন্য যাদু চর্চা করা হলে উভয় অবস্থায় যাদকরকে হত্যা করা ওয়াজিব। তবে যাদুর প্রভাব বিনষ্ট করার জন্য যাদু বিদ্যা শেখা জায়েয।

অবৈধ হত্যা জঘন্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। আল কুরআনে এরশাদ হয়েছে, আল্লাহ্‌ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করো না। (সূরা বনী ইসরাঈল: আয়াত:৬৩)

. বৈধ কারণে হত্যা আইনের চূড়ান্ত বিচারে ছয়টি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। ১. ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যার অপরাধীকে কিসাস স্বরূপ হত্যা করা, . জিহাদের ময়দানে দ্বীনের পথে বাধা সৃষ্টিকারীদের হত্যা করা, . ইসলামের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার বিদ্রোহীদের হত্যা করা, .বিবাহিত নারী পুরুষকে ব্যভিচারের অপরাধে হত্যা করা, . ডাকাতির অপরাধে হত্যা করা, এবং ৬. মুরতাদ্দ বা ধর্মত্যাগী হওয়ার কারণে হত্যা করা। (বিধিবদ্ধ ইসলামী আইন, খন্ড, পৃ: ৭৭১)

আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত কোনো মু’মিনকে হত্যা করবে তার শাস্তি জাহান্নাম। তাতেই সে অনন্তকাল থাকবে। আল্লাহ তার উপর ক্রোধান্বিত হন, তাকে অভিসম্পাত করেন এবং তার জন্য ভয়াবহ স্বস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন। (সূরা: নিসা: ৯৩)

মানব হত্যা করা পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার চেয়ে মারাত্মক: মানব হত্যা জগন্যতম অপরাধ। ইসলাম শান্তি ও মানবতার ধর্ম। সন্ত্রাসী হত্যা কান্ড ও মানব হত্যা গুরুতর অপরাধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহর নিকট সারা দুনিয়ার ধ্বংশ হওয়ার চাইতেও গুরুতর বিষয় হচ্ছে কোনো মুসলিমকে হত্যা করা। (তিরমিযী)

. সুদ খাওয়া:

ইসলামে সুদকে সুস্পষ্টরূপে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সুদের গুনাহের ভয়াবহতা বর্ণনা দিতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, সুদের সত্তর প্রকার গুনাহ্‌ রয়েছে, এর সর্বনিম্নটি হলো নিজের মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার সমপর্যায়ের গুনাহ। (মিশকাত)

. ইয়াতীমের মাল গ্রাস করা: যেসব শিশু কিশোর পিতৃহারা বা মাতৃহারা হবার কারণে তাদের ঠকিয়ে তাদের সম্পদ গ্রাস করা বা আত্মসাৎ করা জঘন্যতম অপরাধ। অন্যায়ভাবে যারা ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করে তাদের পরিণতির কথা আল কুরআনে বিঘোষিত হয়েছে, যারা ইয়াতীমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে তারা তো তাদের উদরে আগুন ভক্ষণ করে। তারা অচিরেই দোযখের আগুনে জ্বলবে। (আল কুরআন:১০), এতিমদের প্রতি অবহেলা করা তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ করা ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আপনি সেই ব্যক্তিকে দেখেছেন কি? যে বিচার দিবসের ব্যাপারে মিথ্যাচার করে বেড়ায়, এরা তো তারা যারা ইয়াতীমকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়, আর মিসকিনকে খাদ্য দানে উৎসাহ দেয় না। (সূরা: মাউন: )

. জিহাদ থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা: তিন অবস্থায় জিহাদ থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা হারাম। ইমাম ইবনে কুদামা মাকদিসি রহ. (৬২০ হি.) বলেন, তিন অবস্থায় জিহাদ ফরজে আইন হয়ে যায়। ১. যখন মু’মিনকাফির উভয় বাহিনী লড়াইয়ের জন্য কাতারবন্দি হয়ে মুখোমুখি দাঁড়ায় তখন উপস্থিত প্রত্যেক মুসলমানের জন্য পলায়ন করা হারাম এবং ময়দানে অটল থেকে যুদ্ধ করা ফরজে আইন। ২. কাফিররা কোন এলাকায় আক্রমণ চালালে তাদের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর প্রতিরোধ গড়ে তোলা ফরজে আইন। ৩. ইমাম যদি কোন সম্প্রদায়কে জিহাদে বের হওয়ার আহ্বান জানায় সকলের জন্য জিহাদে বের হওয়া ফরজে আইন। (আল মুগনী ১২/৪২৩, রদ্দুল মুহতার ৪/১২৭)

ইসলামী শরীয়তে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ইসলাম বিরোধী সকল প্রকার তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে জান মাল প্রভাব প্রতিপত্তি শক্তি সামর্থ্য উৎসর্গ করে সর্বাত্মক চেষ্টা সাধনা উৎসর্গ করার নামই জিহাদ। জিহাদকে ইসলামে উত্তম আমলের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো সর্বোত্তম আমল কী? নবীজি এরশাদ করেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনায়ন করা। জিজ্ঞেস করা হলো তারপর কোন আমল? তিনি এরশাদ করেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। জিজ্ঞেস করা হলো তারপর কোনটি? নবীজি বললেন, মকবুল হজ্ব। (সহীহ বুখারী)

. সতীসাধ্বী নারীদের ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়া: পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, নিশ্চয় যারা সতীসাধ্বী, সহজসরল, মু’মিন মহিলাদেরকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয় তারা দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। অপবাদকারীদের জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান। (সূরা, নূর: ২৩)। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, যারা সতীসাধ্বী কোন মহিলাকে ব্যভিচারের অপবাদ দিলো অথচ চারজন সাক্ষীর মাধ্যমে তা প্রমাণ করতে পারেনি তাহলে তোমরা ওদেরকে আশিটি করে বেত্রাঘাত করো। (সূরা: নূর: আয়াত: )। হে আল্লাহ আমাদেরকে এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজগুলো থেকে হেফাযত করুন। আমিন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী); খতীব,

কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকর্নেল জিয়াউদ্দিন বীর উত্তম : নির্মোহ এক স্বপ্নযোদ্ধা
পরবর্তী নিবন্ধঋষিণ দস্তিদারের দুটি কবিতা