প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, জেনে রাখুন! হালাল উপায়ে অর্থ উপার্জনের যতগুলো পন্থা ও মাধ্যম রয়েছে ব্যবসা বাণিজ্য তন্মধ্যে অন্যতম। অন্যের উপর বোঝা না হয়ে স্বনির্ভর জীবন গঠনের লক্ষ্যে হালাল পন্থায় জীবিকা অর্জনের জন্য ব্যবসা বাণিজ্যকে সম্মানিত নবী রাসূলগণের সুন্নাত হিসেবে গ্রহণে সচেষ্ট হোন।
বাই: ও তিজারত প্রসঙ্গ:
“বাই” আরবি শব্দ পবিত্র কুরআনের শব্দ। এর অর্থ ক্রয়–বিক্রয় বা ব্যবসা বাণিজ্য। পবিত্র কুরআনে ব্যবসা বাণিজ্যের অর্থে “তিজারত” শব্দটিও উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী শরীয়তে “বাই” তথা ব্যবসা হলো পারস্পরিক সম্মতিক্রমে কোনো সম্পদের বিনিময়ে সম্পদের পরিবর্তন অথবা বিক্রয় যোগ্য কোনো সম্পদের বিনিময়ে কোনো বস্তুর মালিকানা হস্তান্তর করা। “তিজারতের” শরয়ী অর্থ বর্ণনায় ইমাম রাগিব বর্ণনা করেন, মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে মূলধন, বিনিয়োগ ও ব্যবহার করা। (মুফারাদাতে রাগিব, পৃ: ৭২)
প্রখ্যাত তাফসীরকার ইমাম কুরতুবী (র.)’র বর্ণনা মতে, তিজারত হলো, ক্রয় বিক্রয় করা, সম্পদের বিনিময়ে সম্পদের পরিবর্তনের নাম হলো তিজারত।
পবিত্র কুরআনের আলোকে ব্যবসা বাণিজ্য:
ব্যবসা বাণিজ্য হলো অর্থনীতির চালিকাশক্তি। মানব জীবনে অর্থ সম্পদ অর্জনে ব্যবসা বানিজ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামী জীবন বিধানে অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতি, আমদানী নীতি, রপ্তনী নীতি, প্রতিটি বিষয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ইসলাম ব্যবসা বানিজ্যের মাধ্যমে সৎ পন্থায় হালাল উপার্জনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছে। ব্যবসা বাণিজ্য হলো ইসলামী অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইসলামে আয়ের যতগুলো বৈধপন্থা রয়েছে তন্মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য অন্যতম। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা ব্যবসা বাণিজ্য হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ২৭৫)
আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছেন, হে মু’মিনগন তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষন করোনা। তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। (সূরা: নিসা, ৪:২৯)
ব্যবসায়িক পণ্য সঠিকভাবে ওজন দেয়ার নির্দেশনা:
ব্যবসার ক্ষেত্রে সততা ও আমানতদারিতা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। একজন আদর্শ ব্যবসায়ী সর্বদা পরিমাপে সঠিক পন্থা অবলম্বন করবে। কোনোভাবেই শঠতা কপটতা ও প্রতারণার আশ্রয় নেবেনা। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আর মাপে পরিপূর্ণ দাও যখন তোমরা পরিমাপ কর এবং সঠিক দাঁড়িপাল্লায় পরিমাপ কর। এটা কল্যাণকর ও পরিণামে সুন্দরতম। (সুরা: বনী ইসরাইল, ১৭:৩৫)
অসৎ ব্যবসায়ীর ভয়াবহ পরিণতি:
অসৎ ও অসাধু ব্যবসায়ীরা বিভিন্নভাবে ক্রেতাদেরকে প্রতারিত করে। খাদ্যে ভেজাল, ওজনে কম দেওয়া, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা, নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করা, ক্রেতার সাথে মিথ্যাচার করা, পণ্যের প্রতি ক্রেতার আকর্ষন বৃদ্ধির জন্য শপথের আশ্রয় নেয়া। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের গুদাম জাতের মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা, দ্রব্যমূল্য নিম্নবিও ও মধ্যবিত্ত মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া ইত্যাদি অপকর্মের মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের প্রতি মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। ইসলাম এসব গর্হিত আচরণ প্রসঙ্গে কঠোর সতর্ক বার্তা আরোপ করেছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, ধ্বংস যারা পরিমাপে কম দেয় তাদের জন্য যারা লোকদের নিকট থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে। আর যখন তাদেরকে মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়। (সূরা: মুতাফফিফীন, ৮৩:১–৩)
হাদীস শরীফের আলোকে হালাল পন্থায় ব্যবসার নির্দেশ:
মহান আল্লাহ মানব জাতিকে তাঁরই ইবাদত ও দাসত্বের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে করা বান্দার প্রতিটি কাজই ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে। একজন মানুষের জীবনকে ইসলামী আদর্শ ভিত্তিক পরিচালনার ক্ষেত্রে দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামযের গুরুত্ব অপরিসীম। নামায অস্বীকারকারী কাফির। অনাদায়ী কবিরা গুনাহকারী। বান্দার ইবাদত বন্দেগী, নামায রোজা হজ্ব যাকাত, দান সাদকা, মানব সেবা, সমাজ সেবা সব কিছু তখনই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে। যদি বান্দার উপার্জন হালাল পন্থায় অর্জিত হয়। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হালাল উপার্জন অন্বেষণ করা ফরজের পর ফরজ। (বায়হাকী, হাদীস: ৬৬৪৫)
সততা ও আমানতদারীতার সাথে ব্যবসা করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের সুন্নত:
ব্যবসায়ীদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন এক অনুকরণীয় আদর্শ। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সততা ও বিশ্বস্ততার সংবাদ শুনে আরবের সম্ভ্রান্ত ধনাঢ্য মহিলা হযরত খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে তাঁর ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পন করেছিলেন। (ইবন কাসীর, আস সীরাতুন নববীয়া, পৃ: ৪২৯)
শীর্ষ ও প্রসিদ্ধ সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে অধিকাংশই জীবিকার জন্য ব্যবসা করতেন। ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খলীফাতুল মুসলিমীন হওয়ার পরও কিছুদিন ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। একদা হযরত ওমর (রা.) ও হযরত আবু উবায়দাহ ইবনুল জাররাহ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আমিরুল মুমেনীন আপনার উপর মুসলমানদের খিলাফতের গুরুদায়িত্ব অর্পিত। আপনি কেন এ কাজ করছেন? হযরত সিদ্দিক আকবার (রা.) বললেন, আমি কোথা থেকে আমার পরিবারের ভরণ পোষনের ব্যবস্থা করবো? অত:পর তাঁরা খলীফার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভাতার ব্যবস্থা করলেন। (ফাতুহুল বারী, খন্ড: ৪, পৃ: ৩০৫)
ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান জিন্নুরাইন (রা.) তিনিও একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। আমাদের মাযহাবের ইমাম হযরত ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তিনিও একজন কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন।
সৎ ব্যবসায়ীদের জন্য পরকালীন সুসংবাদ:
একজন সৎ ব্যবসায়ী যেভবে পার্থিব জীবনে সম্মানিত মানুষের সুনাম ও ভালোবাসা অর্জনে গৌরবান্বিত হন, তেমনিভাবে পরকালেও তিনি হবেন সম্মানিত ও প্রশংসিত। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত আমানতদার ব্যবসায়ীদের হাশর নবীগন, সিদ্দিকগন ও শহীদদের সাথে হবে। (তাফসীর দুররুল মানসুর, খন্ড: ৬, পৃ: ২২০)
অসাধু ও অসৎ ব্যবসায়ীদের প্রতি সতর্ক বার্তা:
ব্যবসার নামে যারা প্রতারণা করে, ক্রেতাকে ঠকিয়ে অধিক মুনাফা লাভের নেশায় যারা অসৎ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তারা প্রবঞ্চক ও লোভী। তাদের অপকর্ম মানব সমাজে নিন্দিত ও ঘৃণিত। পরকালেও পাপিষ্ট হিসেবে তারা বিবেচিত হবে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত রাফি ইবনে রাফি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা ফাসিক ও পাপী হিসেবে উঠবে। অবশ্য যারা খোদাভীরু, পুণ্যবান ও সততার সাথে ব্যবসা করেছে তারা নয়। (তিরমিযী)
ব্যবসায়িক পণ্য গুদামজাত করণে নিষেধাজ্ঞা:
শরয়ী পরিভাষায় গুদামজাত করাকে ইহতিকার বলা হয়। ইহতিকার অর্থ হলো, নিত্য প্রয়োজনীয় খাবার সামগ্রী মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্য মজুদ করে রাখা। ইসলামে এর জন্য কঠোর শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন পর্যন্ত মূল্য বৃদ্ধির জন্য খাদ্য জাতীয় জিনিস মজুদ করে রাখবে মহান আল্লাহ তাকে কুষ্ঠরোগ ও দারিদ্রতায় নিমজ্জিত করবেন। হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে তার উপর আল্লাহ তা’আলা ফেরেস্তাগণ এবং সকল মানুষের অভিসম্পাত। আল্লাহ তা’আলা তার নফল ও ফরজ ইবাদত কবুল করবেন না। (রদ্দুল মুহতার, খন্ড:৯, পৃ: ৬৫৭)
এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা বাজারে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সংকট সৃষ্টি করার জন্য গুদামজাত করে। প্রয়োজনীয় দ্রব্য নাগালের বাইরে চলে গেলে মানুষের মাঝে ক্ষোভ ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। ধনাঢ্য বিত্তবানরা অনায়াসে অধিক মূল্য দিয়ে ক্রয় করবে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা ভোগান্তির শিকার হবে সীমাহীন কষ্টে নিমজ্জিত হবে। এসব গর্হিত কাজে লিপ্ত, মানবতা বিরোধী, অপকর্মের হোতারা, অভিশপ্ত ও মানবতার শত্রু। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি চল্লিশদিন খাদ্য শস্য মজুদ রাখে সে ব্যক্তি আল্লাহর দায়িত্ব থেকে মুক্ত আল্লাহও তার দায়িত্ব থেকে মুক্ত। (মুসনাদে আহমদ)
ব্যবসায় রায়েছে বরকত, এতে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়:
ব্যবসার মাধ্যমে মানুষ স্বাবলম্বী হয়। স্বনির্ভর হয়। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়। দেশের উন্নতি অগ্রগতি তরান্বিত হয়। অভাব অনটন দূরীভূত হয়। বেকারত্বের অবসান হয়। দেশে উৎপাদিত পণ্য দেশের অভাব ও চাহিদা পূরণের পর বিদেশে রপ্তানী করা হলে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সহজ হয়। ব্যবসা বাণিজ্যে রয়েছে সীমাহীন বরকত ও সমৃদ্ধি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, রিযকের দশ ভাগের নয় ভাগই রয়েছে ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্যে। (ইবনে মাযাহ) সৎ ব্যবসায়ীরা হালাল উপার্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট থাকেন। হে আল্লাহ! আমাদের ব্যবসায়ী ভাইদেরকে ইসলামী আদর্শ ও শিক্ষার অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম।
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।