প্রিয় ইসলামী ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! আহলে বাইত তথা নবীজির আদর্শের অনুসারী তাঁর পরিবার বর্গের সুমহান মর্যাদা অনুধাবন করুন। বিভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ মুসলিম উম্মাহর নাজুক সন্ধিক্ষণে ঈমান আক্বিদা সংরক্ষণে কুরআন মজীদ ও আহলে বাইতের আদর্শ দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরুন। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর আহলে বাইতের ওসীলায় মহান আল্লাহর অফুরন্ত রহমত বরকত নিয়ামত ও কল্যাণ প্রার্থনা করুন।
আহলে বাইত অর্থ: আহল ও বাইত শব্দ দুটি আরবি “আহল” শব্দটি এক বচন, “আহলুন” বহুবচন শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। পবিত্র কুরআনে “আহল” শব্দটি পরিবার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে মহান আল্লাহ হযরত নুহ আলাইহিস সালাম’র অবাধ্য সন্তান প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, হে নুহ! সে তোমার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয়, সেতো এক অসৎকর্ম পরায়ণ ব্যক্তি। (সূরা: হুদ, আয়াত: ৪৬)
আহলে বাইত দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত: আহল শব্দটি পরিবার, অধিবাসী, বাসিন্দা, ধারক ও অনুসারী বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়। যেমন কুরআনে আহলে বাইত দ্বারা নবীর পরিবারবর্গ উদ্দ্যেশ্য। এভাবে আহলে কুরআন অর্থ কুরআনের অনুসারী, আহলুস সুন্নাহ দ্বারা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাদের আদর্শের অনুসারী ও বিশ্ববাসীদেরকে আহলে সুন্নাহ বলা হয়। আহলে মদীনা অর্থ মদীনাবাসী।
কুরআনের আলোকে আহলে বাইতের মর্যাদা: পবিত্র কুরআনের সূরা আহযাব ও সূরা হুদে দুটি স্থানে শব্দটি উল্লেখ হয়েছে। মহান আল্লাহ আহলে বাইতকে সম্পূর্ণরূপে পূত: পবিত্র করেছেন। তাঁরা কুফরি, শির্ক ও মুর্তিপূজা থেকে পূত: পবিত্র। আল্লাহ তাঁদের থেকে কলুষতা ও অপবিত্রতা দুরীভূত করেছেন, তাঁরা সকলেই মর্যাদামন্ডিত পুত: পবিত্র ও সম্মানিত গুনাহ থেকে সুরক্ষিত। মহান আল্লাহ তাঁদের মর্যাদা বর্ণনায় এরশাদ করেছেন, “হে নবীর পরিবার বর্গ! আল্লাহ তো এটাই চান যে, তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূরীভূত করে দেবেন এবং তোমাদেরকে পবিত্র করে অতীব পরিচ্ছন্ন করে দেবেন। (সূরা: আহযাব, পারা: ২২, আয়াত: ৩৩)
আহলে বাইত কারা? সূরা আহ্যাবে “আহলে বাইত” দ্বারা কারা উদ্দ্যেশ্য? এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন মত রয়েছে, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, ও একদল তাফসীরকারদের মতে আহলে বাইত দ্বারা হযরত মাওলা আলী, হযরত ফাতেমা, হযরত ইমাম হাসান, হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম উদ্দ্যেশ্য। তাফসীরকারদের দ্বিতীয় অভিমত হলো আহলে বাইত দ্বারা নবীজির পবিত্র স্ত্রীগণ আহলে বাইতের অর্ন্তভূক্ত। (বরকাতে আলে রাসূল, পৃ: ৩২)
আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর নবীজি আহলে বাইতকে চাদরে আবৃত করে নিলেন। সূরা আহযাবের আয়াতে তাত্বহীর অবতীর্ণ হওয়ার পর নবীজি আহলে বাইতের সদস্যদের কে চাদরে আবৃত করে নিলেন, এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত ওমর ইবনে আবু সালমা (র.) থেকে বর্ণিত, যখন হযরত উম্মে সালমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার গৃহে রাসূলুল্লাহর উপর এ আয়াত “হে আহ্লে বাইত! আল্লাহ তো এটাই চান যে, তোমাদের থেকে সকল প্রকার কলুষতা দূরীভূত করে দেবেন এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপ পুত: পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে দেবেন।” অবর্তীণ হল, তখন নবীজি ফাতেমা এবং হযরত হাসান ও হোসাইন (রা.) কে ডাকলেন এবং তাদেরকে একটি চাদরের মধ্যে আবৃত করে নিলেন, হযরত আলী (রা.) তাঁর পিছনে ছিলেন, অত:পর বললেন হে আল্লাহ! এরা আমার আহলে বাইত, সুতরাং এদের থেকে সকল প্রকারের কলুষতা দূর কর এবং এদেরকে সম্পূর্ণরূপে পুত: পবিত্র করো। (তিরমিযী, খন্ড: ৫, হাদীস: ৩৫১)
আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর আহলে বাইতের জন্য শান্তি রহমত কামনা: প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন সূরা আহযাবের ৩৩ নং আয়াত নাযিল হওয়ার পর নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘ চল্লিশ দিন ফজরের সময় হযরত ফাতেমাতুজ যাহরা (রা.)’র ঘরের দরজার সন্নিকট তাশরীফ নিতেন এবং বলতেন হে আহলে বাইত! তোমাদের উপর আল্লাহর শান্তি করুণা বর্ষিত হোক, রহমত ও বরকত অবতীর্ণ হোক, নামায পড়ো! আল্লাহ তোমাদের উপর রহমত বর্ষণ করবেন। অত:পর সূরা আহযাবের ৩৩নং আয়াত তিলাওয়াত করতেন। হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, ছয়মাস পর্যন্ত উপরোক্ত আমল অব্যাহত ছিল। অপর বর্ণনায় আট মাস উল্লেখ হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে পাক পঞ্জেতন দ্বারা আহলে বাইত উদ্দেশ্য। (বরকাতে আলে রাসূল, পৃ: ২৫)
আহলে বাইতের মধ্যে হযরত ইমাম হাসান ও হোসাইন (রা.) সর্বোত্তম মর্যাদা সম্পন্ন: কুরআন ও হাদীসের অসংখ্য বর্ণনার আলোকে প্রমানিত যে, আহলে বাইতের মর্যাদা অনন্য ও অসাধারণ। তাঁরা গুণে জ্ঞানে চরিত্রে নৈতিকতায় তাকওয়া খোদাভীতি আমল ও আখলাকে অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তাঁদের জীবনাদর্শ বিশ্ববাসীর জন্য অনুসরণীয় অনুকরণীয়। একটি সুন্দর ও আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে তাঁদের অনুপম চারিত্রিক গুণাবলী সত্যান্বেষী বিশ্ব মানব জাতির জন্য মুক্তির পাথেয়। হযরত ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসাইন (রা.)’র মর্যাদা প্রসঙ্গে একথা প্রণিধান যোগ্য যে, তাঁরা ছিলেন গৌরবোজ্জ্বল বংশের উত্তরাধিকার। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হে মানব জাতি! আমি কি তোমাদের কে তাঁদের ব্যাপারে বলব না যারা চাচা চাচী ও ফুফুর দিক থেকে সকল মানুষের উত্তম? আমি কি তোমাদের কে তাঁদের ব্যাপারে বলবনা? যারা মামা ও খালার দিক থেকে সব মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম, আমি কি তোমাদেরকে তাঁদের ব্যাপারে সংবাদ দেব না? যারা পিতা–মাতার দিক দিয়ে সব মানুষের চেয়ে উত্তম। তাঁরা হলেন, হযরত হাসান ও হযরত হোসাইন। তাঁদের নানা হলেন আল্লাহর রাসূল। তাঁদের নানী খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ। তাঁদের মাতা আল্লাহর রাসূলের প্রিয়তমা কন্যা ফাতেমা, তাদের পিতা আলী ইবনে আবু তালিব, তাদের চাচা, জাফর ইবনে আবু তালিব, তাদের ফুফু হলেন উম্মেহানী বিনতে আবু তালিব, তাঁদের মামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পুত্র হযরত কাসেম এবং খালা হলেন রাসূলুল্লাহর কন্যাগণ যয়নব, রোকেয়া ও উম্মে কুলসুম। তাদের নানা, পিতা, মাতা, চাচা, ফুফু, মামা ও খালা সকলেই জান্নাতী এবং এরা দু’জন (হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হোসাইন) ও জান্নাতে থাকবে। (মু’জামুল কবীর, হাদীস: ২৬৮২)
নামাযে আহলে বাইতের প্রতি দরুদ সালাম পাঠ না করলে নামায হয় না: হে মুমীনগণ! আপনারা অবগত আছেন যে, নামাযের মধ্যে তাশাহুদ শেষে আহলে বাইতে রাসুলের প্রতি দরুদ সালাম পাঠ করা না হলে নামায পরিপূর্ণ হয় না। যেজন্য আমরা দরুদ শরীফ পাঠ করে থাকি। হে আল্লাহ করুণা বর্ষণ কর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং তাঁর বংশধরগনের প্রতি যেভাবে তুমি করুণা বর্ষণ করেছো ইবরাহীম (আ.)’র প্রতি ও ইবরাহীম (আ.)’র বংশধরদের প্রতি, হে আল্লাহ তুমি বরকত দান কর, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং তাঁর বংশধরদের প্রতি, যেভাবে তুমি বরকত দান করেছো ইবরাহীম (আ.)’র প্রতি এবং ইবরাহীম (আ.)’র বংশধরদের প্রতি, নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসিত, মর্যাদাবান। হে আল্লাহ তুমি সু–পথ প্রাপ্ত চার খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) হযরত ওমর ফারুক (রা.) হযরত ওসমান জিন্নুরাইন (রা.) ও হযরত আলী কাররামাহুল্লাহু ওয়াজহাহু রাদ্বিআল্লাহু আনহুম এর প্রতি করুণা বর্ষণ কর। বিশ্বের রমনীকুলের সর্দারণী, জান্নাতবাসী রমনীদের সর্দারণী, হযরত ফাতেমা যাহরা (রা.)’র প্রতি, এবং দুই মহান ইমাম জান্নাতবাসী যুবকদের সর্দার, হযরত ইমাম হাসান (রা.) ও হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) প্রতি, সকল সম্মানিত সাহাবাদের প্রতি, সকল সম্মানিত নবী রসূলগনের প্রতি, তোমার নৈকট্যধন্য সকল আউলিয়াগনের প্রতি তুমি করুণা বর্ষণ কর। হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস। আল্লাহর প্রতি ভালবাসার কারণে আমাকে ভালবাস। আমার প্রতি ভালবাসার কারণে আমার আহলে বাইতকে ভালবাস। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং: ৩৭৮৯)- আমি নিজের ও সকল মুসলমানের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি হে আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন! আমাদের মাতা–পিতাকে ক্ষমা করুন। কিয়ামত দিবসে সকল মুমীনদের ক্ষমা করুন। আমিন।
লেখক: মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।