ইসলামে শ্রমিকের পরিচয়: শ্রমিকের আরবি শব্দ “আল–আমিল” এর অর্থ কার্য সম্পাদনকারী, শ্রমিক, কর্মচারী । ইসলামী চিন্তাবিদ ড. ইবরাহীম আনীস এর মতে কোন কিছু তৈরী করা, অথবা বিনিময়ে কাজ করা, মালিকের সম্পদে তার রাজত্বে তার কর্মে মেহনত করা। (মু’জামুল ওয়াসীত, পৃ: ৬২৮)
ইসলামে শ্রমের প্রকার ভেদ: একজন শ্রমিক যিনি শারীরিক পরিশ্রম করেন এ শ্রমের বিভিন্ন স্তর ও প্রকার রয়েছে। ১. শারীরিক বা কায়িক শ্রম: যেমন রিক্সাচালক, দিন মুজুর ও শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন শ্রম। ২. শৈল্পিক শ্রম: যেমন অঙ্কন, হস্তশিল্প, স্থাপনা। ৩. বুদ্ধিবৃক্তিক শ্রম: শিক্ষকতার মহান পেশা, ডাক্তারী পেশা, আইন পেশা ইত্যাদি প্রশাসনিক বিভিন্ন স্তরে অর্জিত শিক্ষার আলোকে দায়িত্ব পালনে শ্রম দেয়া।
পবিত্র কুরআনের আলোকে শ্রমিকের অধিকার: শান্তিপূর্ণ সুন্দর সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণে শ্রমের মূল্যায়ন ও শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম ইসলাম বিশ্ববাসীর জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কল্যাণধর্মী শ্রমনীতি উপহার দিয়েছে। ইসলাম প্রদত্ত শ্রমিকের অধিকার যথাযথ মর্যাদা কার্যকর ও প্রতিষ্ঠিত হলে মালিক শ্রমিকের পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণ ও উন্নয়ন অগ্রগতি তরান্বিত হবে। উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। শ্রম নির্ভর মানুষ মর্যাদাবান ও সম্মানী। অন্যজনের আয়ের উপর নির্ভরশীল মানুষ সামাজিকভাবেও ঘৃণিত। ভূপৃষ্টে বিচরণ করে শ্রমের বিনিময়ে জীবিকা অন্বেষনের প্রয়োজনে মেহনত ও পরিশ্রম করতে ইসলাম সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, অত:পর নামায শেষ করে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো, আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ করো এবং অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করো যাতে সফলকাম হতে পার। (সূরা: জুমআহ, ৬২:১০)
শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা তার অধিকার: পুজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা ও সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা মানব রচিত কোনো মতবাদই শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি। ইসলামই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। যে ধর্মে পৃথিবীর সকল শ্রেণির পেশার মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছে শ্রমিককে তার যোগ্যতা ও পরিশ্রম অনুযায়ী তার মজুরী বা সম্মানী নির্ধারণ করা অপরিহার্য। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, প্রত্যেকের জন্য তাদের কাজ অনুসারে মর্যাদার স্তর। তাদের কাজের প্রতিফল তাদের দিয়ে দেয়া হবে। এবং তাদের প্রতি অবিচার করা হবেনা। (সূরা: আহকাফ, ৪৬:১৯)
শ্রমিককে হতে হবে বিশ্বস্ত ও আমানতদার: পৃথিবীতে প্রেরিত আল্লাহর সকল সম্মানিত নবীগন ছিলেন পরিশ্রমী। মহান আল্লাহ তাঁদের শ্রমের প্রশংসা করেছেন। তাদের আদর্শকে বিশ্ববাসীর জন্য মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আপনি যাদেরকে শ্রমিক নিযুক্ত করবেন সে শ্রমিক সর্বোত্তম, যিনি দৈহিকভাবে শক্তিশালী ও আমানতদার। (সূরা: কাসাস: ২৮:২৬)
উপর্যূক্ত আয়াতে করীমায় শ্রমিকের বৈশিষ্ট্য আলোকপাত হয়েছে। বিশেষত শ্রমিকের বিশেষ দুটিগুণ থাকা অপরিহার্য। ১: তিনি হবেন দৈহিকভাবে শক্ত, কাজে উদ্যেমী, কর্মট, দৈহিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী। ২: তিনি হবেন বিশ্বস্ত আমানতদার। মালিকের শিল্প কর্মে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনে, তিনি হবেন সততা ও ন্যায় পরায়নাতার মূর্ত প্রতীক। মালিকের সম্পদ রক্ষনাবেক্ষন, তত্ত্বাবধান, পরিচালনা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা লেনদেনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মানদন্ডে পরম বিশ্বস্ত আমানতদার। তিনি সর্বদা মালিকের কল্যাণ কামনায় সচেষ্ট থাকবেন। মালিক পক্ষও শ্রমিকের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক ও মানবিক উদার ও তার মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষায় নীতিমান ও সচেষ্ট থাকবেন। এতে মালিক শ্রমিক উভয়ই লাভবান হবে। উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, পারস্পরিক আস্থা বিশ্বাস ও ভ্রাতৃত্ববোধ গভীর হবে, উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে। উৎপাদিত দ্রব্য দিয়ে দেশের চাহিদা পূর্ণ হবে উপরন্ত উৎপাদিত দ্রব্য বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা লাভের পথ সুগম হবে। দেশের উন্নয়নের চাকা সর্বদা সচল ও গতিশীল থাকবে। এতে দেশের মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
হাদীস শরীফের আলোকে শ্রমের মূল্যায়ন ও শ্রমিকের অধিকার: নিজের ও পরিবারের জন্য নিজ হাতে উপার্জন করাকে উত্তম উপার্জন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রমিককে শ্রর্মের প্রতি উৎসাহিত করেছেন। পরিবারের কারো উপর বোঝা না হয়ে উৎপাদন ও কর্মমুখী জীবনে পদার্পন করে অর্থ উপার্জনে সচেষ্ট হলে ব্যক্তিত্ব বাড়ে, সম্মান বৃদ্ধি পায়। কারো মুখাপেক্ষী হতে হয় না। স্বনির্ভরতার মনোভাব জাগ্রত হয়। নিজস্ব আঙ্গিকে স্বাধীনভাবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজতর হয়। আয় রোজগারে কর্মঠ ও সক্রিয় থাকলে সুন্দর ও আদর্শ পরিবার গঠনের পথ সুগম হয়। অন্ন, বস্ত্র, খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, মৌলিক চাহিদা পূরণে স্বকীয়তা বোধ সৃষ্টি হয়। হযরত মিকদাম ইবন মাজদী আযযুবায়দী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “মানুষের নিকট তার চেয়ে কোনো উত্তম উপার্জন নেই যা সে নিজের হাতে উপার্জন করে খায়। সে যা কিছু নিজের জন্য পরিবার পরিজনের জন্য ও নিজ কর্মচারীদের জন্য ব্যয় করবে সবই সাদকা হিসেবে গণ্য হবে। (সুনানু ইবন মাযাহ, হাদীস: ২১৩৮)
সম্মানিত নবী রাসূলগন প্রত্যেকে পরিশ্রম করে উপার্জন করেছেন: মু’মিন মুসলমানের ইবাদত বন্দেগী নাময রোজা হজ্ব যাকাত আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার জন্য হালাল পন্থায় উপার্জন করা ফরজ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে মানব জাতি পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র বস্তু রয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কর এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না, নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা: বাকারা, ২:১৬৮)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হালাল রুজি সন্ধান করা ফরজের পর আরেকটি ফরজ। (মিশকাত শরীফ, পৃ: ২৪২)
শরীয়ত সম্মত হালাল পণ্যের ব্যবসা বাণিজ্য করে আয় উপার্জন করার গুরুত্ব আপরিসীম। রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, উত্তম উপার্জন হচ্ছে কল্যাণকর পূন্যময় বেচাকেনা এবং ব্যক্তির স্বহস্তের উপার্জন। (মুসনাদে ইমাম আহমদ)
শ্রমিকের পারিশ্রমিক যথাসময়ে পরিশোধ করা অপরিহার্য: যে কোনো পেশার ব্যক্তিকে নিয়োগের পূর্বে তাঁর বেতন নির্ধারণ ও যথাসময়ে বেতন পরিশোধ জরুরি। কাজের ধরণ, স্তর, পরিধি মাত্রা অনুপাতে বেতন কাঠামো নির্ধারণ, স্কেল নির্ধারণ করা, ন্যায় সঙ্গত ভাবে লিখিত বা অলিখিতভাবে বেতন ভাতা বা সম্মানি পরিশোধ করা ইসলামী শ্রমনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যদি তুমি কোনো শ্রমিক কে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিয়োগ দিতে চাও তাকে প্রথমেই পারিশ্রমিক সম্পর্কে অবহিত করবে। (সুনানু নাসাঈ, হাদীস: ৩৮৫৭)- শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিয়োগ করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। (বায়হাকী শরীফ)
যথা সময়ে শ্রমিকের পারিশ্রমিক পরিশোধ করতে ইসলাম বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছে। বেতন পরিশোধে বিলম্ব করা, হয়রানি করা, গড়িমসি করা, ইসলাম মোটেই সমর্থন করেনা। এতে শ্রমিকের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি হয় শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যের কারণে ক্ষোভ বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। হরতাল অবরোধ ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, এতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে দেশের সুনাম ও ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়। বিদেশী বিনোয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। দেশ অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ে। শ্রমিক আন্দোলনের কারণে উৎপাদন বিঘ্নিত হয়। শ্রমিকের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত কল্পে তার ন্যায্য পাওনা যথাসময়ে পরিশোধে কোন প্রকার টালবাহানা করা অমার্জনীয় অপরাধ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, শ্রমিকের পারিশ্রমিক মজুরি তার ঘাম শুকানোর আগেই দিয়ে দাও। (সুনানু ইবনে মাযাহ: হাদীস: ১৪৪৩)
ইসলামে মালিক শ্রমিক সম্পর্কে নির্দেশনা: মালিক শ্রমিক উভয়ই আল্লাহর বান্দা। কেউ কারো প্রতি অবিচার করা, জুলুম নির্যাতন করা, অমানবিক আচরণ করা, টুনকো অজুহাতে শ্রমিক ছাড়াই করা, সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা অথবা অনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে মালিকের ক্ষতি করা কোনোটি ইসলাম সমর্থন করেনা। ইসলামের দৃষ্টিতে একে অপরের পরিপূরক, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ পরস্পর কল্যাণ কামনায় সহযোগী। শ্রমিকের প্রতি সদ্ধব্যবহার করা, অসুস্থ হলে তার সুচিকিৎসা দেয়া, চিকিৎসা ভাতা দেয়া, তার প্রতি মানবিক সহযোগিতা প্রদর্শন করা, নৈতিক দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তারা (তোমাদের অধীন ব্যক্তিবর্গ) তোমাদেরই ভাই, আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা কারো ভাইকে তার অধীনস্থ করে দিলে সে যা খাবে তাকে তা থেকে খাওয়াবে এবং সে যা পরিধান করবে তাকে তা থেকে পরিধান করতে দিবে। আর যে কাজ তার জন্য কষ্টকর ও সাধ্যাতীত তা করার জন্য তাকে বাধ্য করবেনা। আর সে কাজ যদি তার দ্বারাই সম্পন্ন করতে হয় তবে সে তাকে অবশ্যই সাহায্য করবে। (সহীহ বুখারী, হাদীষ: ৬০৫০)
শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা না দিলে কিয়ামত দিবসে লাঞ্ছিত হবে: যে ব্যক্তি শ্রমিকের অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করবে শ্রমিকের হক আদায় করে না পরকালে সে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন, কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির সাথে আমার বিতর্ক হবে। ১. ঐ ব্যক্তি যে আমার নামে কোনো চুক্তি করে তা ভঙ্গ করেছে, ২. সেই ব্যক্তি যে কোনো স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করেছে, ৩. সেই ব্যক্তি যে শ্রমিককে খাটিয়ে নিজের পুরোপুরি কাজ করে নিয়েছে কিন্তু তার উচিত পারিশ্রমিক দেয়নি। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ২২৭০)
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় কুরআন সুন্নাহর নির্দেশনা অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।