জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৯:৩১ পূর্বাহ্ণ

কুরআন ও হাদীসের আলোকে পর্দার বিধান

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা!

আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, জেনে রাখুন, পর্দা নারী জাতির ভূষণ, নারী জাতির মর্যাদার প্রতীক পর্দা নারী জাতির আদর্শিক পরিচয়, পর্দা লজ্জাশীলতা ও উত্তম চারিত্রিক গুণাবলীর নিদর্শন। পর্দা মহান আল্লাহর অকাট্য বিধান, নামায রোযার মতো অবশ্য পালনীয় নির্দেশ। পর্দাহীনতা অজ্ঞতার নিদর্শন। নারী পুরুষের শালীন পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করা শিষ্টাচারিতার পরিচায়ক। ইসলামী মূল্যবোধের প্রতিফলন।

ইসলামে হিজাব’র বিধান: হিজাব আরবি শব্দ, এর আরবি সমার্থক শব্দ রয়েছে আওরাত ও সতর। ফার্সী ভাষায় ও বাংলায় ব্যবহার হয় পর্দা। হিজাব বা পর্দা অর্থ হলো আবরণ, আচ্ছাদন, অন্তরাল বা গোপনীয়তা। নারী পূরুষের দেহের এমন কিছু অঙ্গ প্রত্যঙ্গ রয়েছে যা আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক ঢেকে রাখা আবশ্যক। সতর অর্থ: ঢেকে রাখা বা গোপন করা। সমষ্টিগত ভাবে বিশেষ অঙ্গ সমূহকে ঢেকে রাখতে হয় বলে এ কারণে সতর বলা হয়। লোকদের সামনে হোক অথবা নামাযের মধ্যে হোক সতর ঢেকে রাখা সর্বসম্মতিক্রমে ফরজ। (বাহারে শরীয়ত ১ম ও ৩য় অংশ, পৃ: ৪৭৯)

মেয়েদের জন্য মুখমন্ডল হাত পা ব্যতীত দেহের বাকী অংশ ঢেকে রাখা ফরজ। ইসলাম নারী পুরুষের শরীর আবৃত রাখার সীমারেখাও নির্ধারিত করে দিয়েছে। শরীরের যে অংশ ঢেকে রাখা ফরজ শরীয়তের পরিভাষায় তাকে সতর বলা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষের সতর প্রসঙ্গে বলেছেন, “পুরুষের জন্য নাভী হতে হাঁটুদ্বয় পর্যন্ত আওরাত বা ঢেকে রাখার স্থান” (নাসবুর রায়াহ, ১ম খন্ড)

নারীর সতর প্রসঙ্গে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “নারীর সমগ্র দেহই ঢেকে বা গোপন রাখার জিনিস। এ কারণে সে যখন ঘরের বাইরে যায় তখন শয়তান তার সাথী হয়ে পিছু নেয়।

পবিত্র কুরআনের আলোকে পর্দার বিধান: আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় হাবীবের ‘সাহাবায়ে কেরামদের নির্দেশ করেছেন তাঁরা যখন নবীর পত্নীগণের নিকট কিছু চাইবে তারা যেন পর্দার আড়াল থেকে চায়। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “এবং যখন তোমরা তাদের কাছে কিছু চাইবে তখন তা পর্দার আড়াল থেকে চাইবে, এটাই তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য পবিত্রতার কারণ।” (সূরা: আহযাব, আয়াত, ৫৩)

মহিলাদের জন্য ঘরই নিরাপদ, বিনা প্রয়োজনে বাইরে যাবেনা: নারীরা গৃহের ভেতরেই অবস্থান করবে। বিনা প্রয়োজনে বাইরে যাবেনা আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তোমরা নিজেদের বাড়ির ভেতরে অবস্থান কর, জাহিলিয়াতের প্রাথমিক যুগের নারীদের মত সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বাইরে বের হয়োনা। (সূরা, আহযাব, আয়াত: ৩২)

ইসলাম মহিলাদেরকে অনিবার্য কারণবশত বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে বের হওয়ারও অনুমতি দিয়েছে। উপরোক্ত আয়াত তার সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। আয়াতের দ্বিতীয়াংশে বলা হয়েছে যে, জাহিলী যুগের প্রথম দিকে নারীরা তাদের রূপ সৌন্দর্য প্রকাশ করে অত্যন্ত অশালীনভাবে বাইরে যেভাবে বের হতো চলা ফেরা করত মুসলিম নারীরা যেন সেভাবে বের না হয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, আয়াতে নারীদের কে ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়নি, নিষেধ করা হয়েছে নির্লজ্জভাবে বেহায়া বেপর্দা ও অশালীনভাবে চলাফেরা করতে। পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের সম্বোধন করে বলেছিলেন, “তোমাদের কে প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হওয়ার জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে।” (সহীহ বুখারী ৪র্থ খন্ড)

ইসলাম নারী পুরুষ উভয়কে পর্দা করার নির্দেশ দিয়েছে: ইসলাম নারী পুরুষ উভয়কে স্বাধীনতা দিয়েছে তবে ইসলাম লাগামহীন স্বাধীনতা স্বীকার করেনা। আধুনিক যুগের অনেক নারীবাদী বুদ্ধিজীবিরা অভিযোগ করে থাকে যে, ইসলাম নারীকে ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছে। নারীর মানবিক সত্তাকে বিকশিত হতে দিচ্ছেনা। তাদের এ অভিযোগ ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা বা বিদ্বেষ প্রসূত। বাস্তবতা হলো নারী পূরুষ উভয়ের পৃথিবীতে ভ্রমণ করার, চলাফেরা করার স্রষ্টার সৃষ্টির সৌন্দর্য উপভোগ করার অধিকার আছে। প্রয়োজনে নারী পুরুষ উভয়ে বাইরে যাবে এবং উভয়কে পর্দা করতে হবে। নারীকে পর্দা করে পুরুষকে নগ্ন থাকার কথা বলা হয়নি। চোখের দৃষ্টি উভয়কেই সংযত করতে নির্দেশ করা হয়েছে মু’মিন পুরুষদের পর্দা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “মুমিনদের কে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান হিফাজত করে এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ সে বিষয়ে অবহিত আছেন। (সূরা: নূর, আয়াত: ৩০)

ঘরের বাইরে বের হলে স্বভাবতই মহিলারা পুরুষদের মুখোমুখী হবে এ অবস্থায় তাদের করণীয় প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আর মু’মিন মহিলাদেরকে আপনি বলে দিন, তারা যেন দৃষ্টি অবনত রাখে, এবং তাদের লজ্জাস্থান হিফাজত করে আর স্বাভাবিকভাবে যা প্রকাশ হয়ে পড়ে তাছাড়া যেন নিজেদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে। (সূরা: নূর, আয়াত:৩১)

পর্দা বিরোধীরা নারীদেরকে ভোগের সামগ্রী বানাতে চায়: নারী স্বাধীনতার নামে যারা নারীর জন্য পর্দা করাকে মধ্যযুগীয় বর্বরতা আখ্যা দিতে চায় নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা তাদের উদ্দেশ্য নয়। প্রকৃত পক্ষে তারা নারীকে ভোগের সামগ্রী, নারীর নগ্নদেহকে ব্যবসায়ের উপকরণ বানাতে চায়। তারা নারীর ইসলাম প্রদত্ত শাশ্বত সৌন্দর্য ও নারীত্বের মর্যাদাকে ভুলুন্ঠিত করে অবৈধ প্রেম লীলায় মত্ত রাখতে চায়। আধুনিকতার নামে পশ্চিমারা নারী জাতিকে যে অবস্থায় নামিয়ে এনেছে নৈতিকতার অবক্ষয়ের ক্রান্তিকালে নারীবাদীরা আজকে সেই অবস্থাকেই স্বাগত জানাচ্ছে। তারা নারীর জন্য পর্দা করাকে নারী স্বাধীনতার অন্তরায় মনে করে।

মুসলিম রাষ্ট্রে নারীদের গৌরবময় সাফল্য: পর্দার বিধান মেনে চলে আজকে পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশে নারীরা কর্মক্ষেত্রে সাফল্য ও কৃতিত্বের সাথে এগিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের উন্নয়নে পুরুষের পাশাপাশি তারাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। নারীরা যে কোনো পেশায় প্রয়োজনে অংশ নিতে পারবে সেক্ষেত্রে তাদের অবশ্যই হিজাব পর্দা বজায় রাখতে হবে। মালয়েশিয়া একটি মুসলিম রাষ্ট্র দেশটি উন্নয়নের সোনালী শিখরে এগিয়ে যাচ্ছে এ দেশের মুসলিম মেয়েরা পর্দা বজায় রেখে দেশের উৎপাদন কাজে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহাথির মোহাম্মদ গর্ব করে বলেছেন “আমাদের মেয়েরা ফুলহাতা জামা ও হিজাব পরে যে পণ্য সামগ্রী উৎপাদন করেছে তার গুণগত মান কি পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশের পণ্যের গুণগত মানের সমতুল্য নয়?

যিনি প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি একজন নারী তাঁর নাম হযরত খাদীজাতুল কুবরা। ইসলাম প্রচারে যিনি প্রথম নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন শহীদ হয়েছেন তিনিও ছিলেন একজন নারী। তাঁর নাম সুমাইয়া। ইসলামের প্রথম যুগে নারীরা যুদ্ধের ময়দানে আহত মুজাহিদদের সেবা শুশ্রুষাও করেছেন। (সহীহ বুখারী)

বেপর্দা নারীরা অভিশপ্ত: নগ্নতা অশ্লীলতা ও লজ্জাহীনতার বিষাক্ত ব্যাধিতে আক্রান্ত বেপর্দা মহিলারা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত অভিশপ্ত। রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ধ্বংসাত্মক পরিণতির কথা বর্ণনা করেছেন, “অচিরেই শেষ জমানায় আমার উম্মতের মাঝে এমন কিছু নারীর আগমন ঘটবে, যারা পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করে উলঙ্গ থাকবে এবং তাদের মাথার উপর উটের মতো জুটি থাকবে। তোমরা তাদের অভিশাপ করো। যেহেতু তারা অভিশপ্ত (মুজামুল আওসাত, আত্‌ তাবরানী হাদীস: ৯৩৩১)

রাসূূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম আরো এরশাদ করেছেন, “যে মহিলা তার স্বামীর ঘর ব্যতীত পোশাক পরিচ্ছদ ছেড়ে বেপর্দা হয় সে যেন আল্লাহ ও তার মধ্যকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলল। (সুনানে ইবনে মাযাহ, হাদীস: ৩৭৫০)

পীরের সাথে মহিলা মুরিদনীর পর্দার বিধান: ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভি (.) বর্ণনা করেন, পর্দার ব্যাপারে পীর ও পীর নয় এমন প্রত্যেক পর পুরুষের সাথে পর্দার হুকুম সমান। (ফতোওয়ায়ে রজভীয়া ২২তম খন্ড, পৃ: ২০৫)

পীর সাহেবের সাথে কথা বলার যদি প্রয়োজন হয় সে ক্ষেত্রে ফিতনার আশংকা না থাকলে ও একাকীত্বে না হলে পর্দার মধ্যে থেকে কথা বলার অনুমতি রয়েছে। (ফতোওয়ায়ে রজভীয়া ২২৩ম খন্ড, পৃ: ২৪৩)

নামাহরাম আত্মীয়ের সাথে চেহারা, হাতের তালু, কব্জি পা গোড়ালী ব্যাতীত সব অঙ্গ পর্দা করা আবশ্যক। সৌন্দর্যতা ও সাজসজ্জা যেন তাদের সামনে প্রকাশ করা না হয়। (ওয়াকারুল ফতোয়া, ৩য় খন্ড, পৃ: ১৫১)

শ্বশুর বাড়ীতে দেবর ভাসুর ইত্যাদির সাথে পর্দার বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “দেবর মৃত্যু সমতুল্য।” (বুখারী ৩য় খন্ড, হাদীস ৫২৩২)

অন্ধ লোকের সামনে পর্দা করা: উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালমা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা হতে বর্ণিত, একদা তিনি এবং হযরত মায়মুনা (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের নিকট বসা ছিলেন হঠাৎ সেখানে আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মকতুম প্রবেশ করলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম উম্মে মায়মুনা (রা.) কে বললেন তোমরা (আগন্তুক) লোকটি থেকে পর্দা করো, আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! লোকটি তো অন্ধ, আমাদেরকে দেখতে পাচ্ছেনা, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা দু’জনও কি অন্ধ যে, তাকে দেখতে পাচ্ছনা। (তিরমিযী, হাদীস: ২৭৭৮)

আল্লাহ তা’আলা মুসলিম নরনারীদেরকে পর্দার বিধান মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগৃহকর্মী নির্যাতন নয়, প্রয়োজন সুরক্ষা
পরবর্তী নিবন্ধছায়ামানুষ, ছায়াসময়