জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ১ নভেম্বর, ২০২৪ at ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

তাওবা’র অর্থ:

আভিধানিক ভাবে তাওবা অর্থ গুনাহ থেকে ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা। ড. মুহাম্মদ রাওয়াশ ও ড. হামিদ সাদিক বলেন, পাপ থেকে ফিরে আসা কৃত পাপের কারণে অনুশোচনা করা, পুনরায় পাপ না করার দৃঢ় সংকল্প করা এবং ক্ষমা লাভের জন্য প্রভূর কাছে ফিরে যাওয়া।

তাওবার শরয়ী অর্থ:

উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আইনজ্ঞ মুফতি আমীমুল ইহসান (.) বলেন, তাওবা হলো অন্তর থেকে গুনাহ না করার সংকল্পের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করা, অত:পর প্রতিপালকের যাবতীয় বিধি বিধান পালন করা।

তাওবার শর্ত তিনটি:

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে তাওবার শর্ত তিনটি ১. তাৎক্ষণিকভাবে গুনাহ ছেড়ে দেওয়া, . ভবিষ্যতে গুনাহ না করার সংকল্প করা, . অতীত কর্মের জন্য অনুশোচনা করা।

আল কুরআনের আলোকে তাওবার গুরুত্ব:

বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ দয়া অনুগ্রহ হলো মহান আল্লাহ গুনাহগার বান্দাদের কে পাপ মুক্ত করার জন্য তাদের অন্তরকে পরিষ্কার ও পরিশুদ্ধ করার জন্য তাদের জন্য তাওবার ব্যবস্থা রেখেছেন। আমাদের জীবনে প্রতি মুহুর্তে আমরা আল্লাহর বিধান অমান্য করে চলছি, শরীয়তের সীমা লংগন করছি। ইসলামের দৃষ্টিতে ছোট বড় যে কোনো প্রকার গুনাহ থেকে সাথে সাথে তাওবা করা ওয়াজিব। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে মু’মিনগন, তোমরা সকলেই আল্লাহর কাছে তাওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। (আল কুরআন, সূরা: আন্‌নূর, আয়াত: ৩১)

বান্দা যখন অবাধ্যতা পরিহার করে আল্লাহর আনুগত্যে ফিরে আসে তিনি বান্দার অপরাধ ক্ষমা করেন, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তিনিই তাঁর বান্দাদের তাওবা কবুল করেন এবং পাপ মোচন করেন, এবং তোমরা যা করো তিনি তা জানেন। (আল কুরআন, ৪২:২৫)

তাওবায়ে নাসুহা:

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এরশাদ করেছেন, তাওবায়ে নাসুহা হলো অন্তরের গভীর থেকে লজ্জিত হওয়া, মুখে ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং আর কখনো গুনাহ না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা। (আত্‌ তারিফাত)

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে মু’মিনগণ! আল্লাহর নিকট পরিচ্ছন্ন অন্তরে বিশুদ্ধ চিত্তে তাওবা কর। (সূরা: আত্‌ তাহরীম, আয়াত: )

হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানি (.) বলেন, তাওবা হলো দুনিয়া আখেরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রথম দরজা। তোমরা তাওবার দরজাকে গনীমত মনে করো এবং যতক্ষণ তা উন্মূক্ত থাকে তা দিয়ে প্রবেশ করো। (আল ফাতহুর রব্বানি, পৃ: ১৮)

তিনি আরো বলেন, তাওবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো তাওবার উপর অটলঅবিচল থাকা। তাওবা হলো পানির মতো, যা দ্বারা পাপের অপবিত্রতা ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যায়, গুনাহের দুর্গন্ধ দূর হয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, হে যুবক তুমি তোমরা কৃত পাপের কারণে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, বরং তুমি তোমার দ্বীনের কাপড়ের ময়লা তাওবার পানি দিয়ে খাঁটি অন্তরে বিশুদ্ধ চিত্তে তওবা করো, তাওবার উপর অটল থাক। (আল ফাতহুর রাব্বানি, পৃ: ৪৮)

হাদীস শরীফের আলোকে তাওবার গুরুত্ব:

মুমিন মুত্তাকী নেক্কার বান্দাদের তাওবা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও আল্লাহর সমীপে তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য হয়ে থাকে। গুনাহগারদের তাওবা পাপ থেকে বেঁচে থাকা ও ক্ষমা লাভের জন্য হয়ে থাকে। তাওবার মুল কথা হলো গুনাহের উপর লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া, অনুশোচনা করা। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি আল্লাহর শপথ আমি প্রতিদিন সওর বারের বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই ও তাওবা করি। (বুখারী শরীফ, খন্ড:, পৃ: ৯৯৩)

আল্লাহ তা’আলা মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাওবা কবুল করেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মৃত্যু শয্যায় উপনীত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহ তাঁর বান্দার তাওবা কবুল করেন। (মুসনাদে আহমদ)

হযরত লোকমান (.) তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন, প্রিয় বৎস: তাওবা করতে বিলম্ব করোনা, কারণ মৃত্যু যে কোন মুহূর্তেই এসে যেতে পারে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে হাবীব (রা.) বলেন, প্রতিবার গুনাহের সময় আল্লাহ যে ক্রোধান্বিত হন তা কখনোই তুমি সহ্য করতে পারবে না, তাই সকাল সন্ধ্যা তাওবা করো।

সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হবার আগ পর্যন্ত তাওবা কবুল করা হবে:

বান্দার তাওবা আল্লাহর কাছে প্রিয় আমল। যে নিজের কৃত গুনাহের কারণে অনুতপ্ত হয় ক্ষমাপ্রার্থী হয় ও লজ্জিত হয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হবার আগ পর্যন্ত যে ব্যক্তিই তাওবা করবে আল্লাহ তাআলা তার তাওবা কবুল করবেন। (মুসনাদে আহমদ)

হযরত আদম (.)’র তাওবা কবুল হলো:

আমাদের পিতা হযরত আদম (.)’র তাওবা কবুল হওয়া প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “অত:পর আদম তাঁর রবের কাছে কতগুলো (তাওবা করার) কথা শিখে নিলেন এবং তাওবা করলেন, আল্লাহ তাঁর তাওবা কবুল করলেন, নিশ্চয়ই তিনি তাওবা কবুলকারী ও অসীম দয়ালু। (সূরা, বাক্বারা, আয়াত: ৩৭)

হযরত আদম () যখন জান্নাত থেকে পৃথিবীতে তাশরীফ আনলেন তিনশত বৎসর পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলার দরবারে ক্রন্দন করেছেন এবং তাওবা করেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাওবা কবুল হওয়ার সুসংবাদ প্রাপ্ত হননি কিন্তু যখনই আদম () আল্লাহর সমীপে আরজ করলেন, ওহে প্রতিপালক! আপনার মাহবুব নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ওসীলায় আমার তাওবা কবুল করুন তখনই হযরত আদম (.) ক্ষমার সুসংবাদ প্রাপ্ত হন এবং আল্লাহ তাঁর তাওবা কবুল করলেন। (দালায়েলুন নবুওয়ত, কৃত: ইমাম বায়হাকী, রহুল বয়ান, পৃ: ২৩০, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড:, পৃ: ২৫৫)

তাওবাকারীর সমালোচনা করা বড় গুনাহ:

হযরত বড়পীর শায়খ আবদুল কাদের জিলানি (.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি বিগত জীবনের কৃত পাপের কারণে তাওবাকারীর সমালোচনা করেন, সেই সমালোচনাকারীর ততক্ষণ পর্যন্ত মত্যু হবেনা যতক্ষণ না তিনি এ প্রকার পাপ কাজে লিপ্ত হবেন এবং লাঞ্চিত ও অপমানিত হবেন। (সারসংক্ষেপ গুনীয়াতুত তালেবীন, পৃ: ২৬৫)

তাওবা করলে আল্লাহ অধিক সন্তুষ্ট হন:

বান্দা গুনাহ করার পর ক্ষমা ভিক্ষার জন্য যখন আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করেন, এতে আল্লাহ অধিক খুশী হন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের কোনো ব্যক্তি হারানো পশু ফিরে পাওয়ার পর যে পরিমাণ খুশী হয় তোমাদের তাওবার পর আল্লাহ তা’আলা এর চেয়েও অধিক খুশী হন। (মুসলিম, তাওবা অধ্যায়, হাদীস১৩৭)

হযরত আবু লুবাবার তাওবা:

হযরত আবু লুবাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র” এক গোপন কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন, এতে আল্লাহর রাসূল অসন্তষ্ট হলেন, আবু লুবাবা অনুতপ্ত হয়ে বললেন, আমি আল্লাহ ও রাসূলের আমানত খিয়ানত করেছি। অর্থাৎ ইয়াহুদীদেরকে হত্যা করা সংক্রান্ত রাসূলুল্লাহর গোপন সংবাদটি তিনি ইয়াহুদীদের নিকট প্রকাশ করে দিলেন, এ পাপ কাজের অনুশোচনায় নিজ অপরাধ স্বীকার করে লজ্জিত হয়ে তিনি মদীনা তৈয়্যবায় উপস্থিত হলেন, এবং স্বেচ্ছায় শাস্তি স্বরূপ মদীনা শরীফের একটি পিলারে রশি দিয়ে নিজকে বেঁধে নিলেন এবং এ মর্মে শপথ করলেন, আল্লাহ তা’আলা যতক্ষণ আমার তাওবা কবুল না করবেন এবং রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ দস্ত মুবারকে আমার রশির বন্ধন খুলে না দেয়া পর্যন্ত আমি পানাহার করবনা, এভাবে তিনি ছয়দিন ছয় রাত নিজকে মসজিদের পিলারে বেঁধে রাখেন, কেবল মাত্র নামাযের সময় এবং মানবীয় হাজত সারতে তাঁর স্ত্রী তাঁকে খুলে দিতেন, পূনরায় একই স্থানে বেঁেধ দিতেন, ক্ষুধা পিপাসার তীব্রতায় তাঁর শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টি শক্তি হ্রাস পেতে শুরু করল এ অবস্থায় এক রাতে রসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উম্মে সালমার ঘরে তাশরীফ নিলেন, সুবহি সাদিক প্রত্যুষে এ দৃশ্য দেখে নবীজি হেসে দিলেন, হযরত উম্মে সালমা আরজ করলেন, এয়া রাসূলুল্লাহ! এ অবস্থায় আপনার হাসি পাচ্ছে, নবীজি বললেন, হে উম্মে সালমা! খুশীতে আমার হাসি আসছে এ কারণে যে, আল্লাহ তা’আলা হযরত আবু লুবাবার তাওবা কবুল করেছেন, হযরত উম্মে সালমা অনুমতিক্রমে হুজুরা শরীফের দরজায় দাঁড়িয়ে উচ্চ আওয়াজে ঘোষণা দিলেন হে আবু লুবাবা! আপনার জন্য সুসংবাদ! আপনার তাওবা কবুল হয়েছে। উম্মুল মু’মিনীন উম্মে সালমার আওয়াজ শুনে লোকেরা খুশী আনন্দে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, হযরত আবু লুবাবার রশির বাঁধ খুলে দিতে মসজিদে নববী শরীফের দিকে সকলে দ্রুত এগিয়ে গেল, হযরত আবু লুবাবা কান্নারত ব্যথিত আওয়াজে সকলকে সাবধান করলেন, কেউ আমার বন্ধন খুলবেননা আল্লাহর শপথ! যতক্ষণ না রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় দস্ত মুবারকে আমাকে বন্ধন মুক্ত করবেন আমার আত্না শান্তি পাবেনা, আল্লাহ যে আমাকে ক্ষমা করেছেন ও আমার তাওবা কবুল করেছেন, রাসূলুল্লাহ খুলে না দেয়া পর্যন্ত আমি নিশ্চিত হবনা। লোকেরা সরে পড়লো, তিনি ফজরের নামাযের সময় পর্যন্ত আবদ্ধ ছিলেন, তাঁর চতুর্দিকে সাহাবায়ে কেরাম দন্ডায়মান সকলে সরকারে দোআলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের জন্য অপেক্ষমান। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববী শরীফে ফজরের নামাযের জন্য তাশরীফ আনলেন আবু লুবাবার (রা.)’র প্রতি অপলক মায়াবী দৃষ্টিতে দেখলেন, মুছকি হাসলেন হযরত আবু লুবাবা (রা.)’র রশি খুলে দিলেন। (তাফসীর সাভী, খন্ড:, পৃ: ১২২, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড:, পৃ: ২৫৭), হযরত আবু লুবাবা (রা.)’র তাওবা আল্লাহর দরবারে এমনভাবে কবুল হলো আজো যত বড় পাপী হোক মসজিদে নববী শরীফের সতুনে লুবাবার নিকট উপস্থিত হয়ে তাওবা করলে আল্লাহ তা’আলা হযরত আবু লুবাবার মকবুল তাওবার বরকতে বান্দার তাওবা কবুল করেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ওসীলায় আমাদের গুনাহ ক্ষমা করুন ও সকলের তাওবা কবুল করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম, খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আত্মার শুদ্ধতা
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারী সরকারি কলেজ প্লাটুন পরিদর্শন