হযরত আবদুল কাদের জিলানী (র.)’র জীবন–কর্ম ও বিশ্বজুড়ে ইসলামের প্রচার প্রসারে কাদেরিয়া তরিক্বার অবদান
হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানির শুভ জন্ম: হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানি (র.) ৪৭০ মতান্তরে ৪৭১ হিজরিতে ইরান ও তুর্কমেনিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চল তাবারিস্থান শহরের পেছনে ভিন্ন একটি নগরী জিলান শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। এটি কিলান নামেও প্রসিদ্ধ ছিল, ওই নগরীর দিকে সম্বন্ধযুক্ত করে তাঁকে জিলানি বা কিলানি বলা হয়।(বাহজাতুল আসরার, পৃ: ৮৮)
তাঁর বংশ পরিচয়: গাউসে পাকের বংশধারা এক বর্ণনামতে নিম্নরূপ: আবদুল কাদের ইবনু আবু সালিহ মুসা জঙ্গী দোস্ত, ইবনু আবু আবদুল্লাহ ইবনু ইয়াহইয়া জাহিদ ইবনু মুহাম্মদ ইবনু দাউদ ইবনু মুসা ইবনু আবদুল্লাহ ইবনু মুসা আল জোন ইবনু আবদুল্লাহ আল মাহদ এভাবেও বর্ণনা পাওয়া যায়, মুজিল ইবনু হাসান মুসান্না ইবনু হাসান ইবনু আলী ইবনু আবি তালিব। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ২০/৪৩৯)
উপনাম ও উপাধি: পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন এলাকায় তিনি বিভিন্ন উপনাম ও উপাধিতে ভূষিত, তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন ভাষায় লিখিত জীবনীগ্রন্থে এতদসংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়, তাঁর উপনাম আবু মুহাম্মদ। বিশ্বের খ্যাতিমান বুজুর্গ ব্যক্তিবর্গ ও প্রখ্যাত ওলামা মাশায়েখ তাঁর সম্মানে বিভিন্ন গুণবাচক উপাধি ব্যবহার করেছেন। আল্লামা সামআনি (রহ.) তাঁকে “ইমাম” শব্দে সম্বোধন করেছেন। ইবনু রজব হাম্বলি (রাহ.) তাঁকে হাম্বলি মাজহাবের ইমাম ও “শায়খুল মাশায়েখ” বলে অভিহিত করেছেন, আল্লামা হাফিজ জাহাবি (রাহ.) তাঁকে “শায়খুল ইসলাম” উপাধিতে ভূষিত করেছেন এ ছাড়াও তিনি গাউসুল আ’যম, গাউসুস সাক্বালাঈন সাইয়্যেদুল আউলিয়া, ইমামুল আউলিয়া, ইমামুত তরীকত, মুহিউস সুন্নাহ, কামিউল বিদআত, জামিউল কামালাত, মাহবুবে সুবহানী, কুতুবে রাব্বানী, শয়েখ মুহিউদ্দিন আবু মুহাম্মদ সৈয়্যদ আবদুল কাদের জিলানি আল হাসানি ওয়াল হোসাইনী ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত। (খযীনাতুল আসফিয়া, ১ম খন্ড, পৃ: ৯৪ কৃত মুফতি গোলাম সরওয়ার লাহোরী)
ইলম অর্জনের অদম্য সাধনা: শায়খ আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) ৪৮৮ হিজরিতে ১৮ বছর বয়সে জিলান ছেড়ে বাগদাদ শহরে জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য গমন করেন। ৪৮৮ থেকে ৪৯৫ হিজরি পর্যন্ত একাধারে ৮ বছর বাগদাদের নিযামিয়া মাদরাসায় যুগ শ্রেষ্ঠ তাফসিরকার, হাদিস বিশারদ ও ফিকহবিদ ও খ্যাতিমান বিজ্ঞ আলিমদের সংস্পর্শে ইসলামের প্রায় সব বিষয়ে জাহিরী ও বাতিনি বিষয়ে অগাধ পান্ডিত্য ও প্রজ্ঞা অর্জন করেন। ইমাম শামসুদ্দিন জাহাবী (রাহ.)’র বর্ণনামতে গাউসে পাক ছিলেন প্রাজ্ঞ আলিম, অনুসরণীয় শায়খুল ইসলাম ওলীদের শিরোরত্ন ও দ্বীনের সংশোধনকারী। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ২০/৪৩৯)। অন্য এক বর্ণনায় তিনি ইলমেদ্বীন অর্জনে দীর্ঘ ৩২ বছর অক্লান্ত সাধনা করেন।
শিক্ষক মন্ডলী: শায়খ আবদুল কাদরে জিলানীর শিক্ষাগুরুদের প্রত্যেকে ছিলেন জাহেরী বাতেনী ইলমের অধিকারী অতুলনীয় গুনাবলীর অধিকারী অনুস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। যাঁদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে তিনি জ্ঞান সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন তাঁদের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন যথাক্রমে হযরত শায়খ আবু সাঈদ ইবনে মুবারক মাখযুমী (রহ.) তিনি হাম্বলি মাজহাবের অনুসারী শীর্ষ আলিম। তিনি প্রচুর অর্থ বিত্তের মালিক ছিলেন বাগদাদের বাবুল আজাজ মাদরাসা তিনিই প্রতিষ্ঠান করেন। উস্তাদের অবর্তমানে শয়েখ আবদুল কাদির (র.) ওই মাদরাসায় শিক্ষকতার খিদমত আঞ্জম দেন, তিনি ৫১৩ হিজরিতে ইন্তিকাল করেন। শায়খ আবুল ওয়াফা আলি ইবনু আকিল বাগদাদি তিনি ৪৩১ হিজরতে জন্ম গ্রহণ করেন, তিনিও ৫১৩ হিজরিতে ইন্তিকাল করেন, তিনি অসংখ্য কিতাব রচনা করেন সার্বক্ষনিক জ্ঞান সাধনা ছিল তাঁর অদম্য স্পৃহা।
ওয়াজ নসীহত ও দাওয়াতি কার্যক্রমের সূচনা: ওলামা মাশায়েখ ও সুফিয়ায়ে কেরামের শিক্ষা দীক্ষা ওয়াজ নসীহত ও তাবলীগে দ্বীনের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে ইসলামি দাওয়াত বিস্তৃত ও সম্প্রসারিত হয়। শায়খ জিলানি ৫২১ হিজরি ১১২৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর দাওয়াতি কার্যক্রম ওয়াজ নসীহতের মাধ্যমে সূচনা করেন। প্রথম পর্যায়ে দুই তিনজন লোক নিয়ে মজলিসের সূচনা করেন, পর্যায়ক্রমে উপস্থিতির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে, এক পর্যায়ে তা বিশাল জমায়েতে পরিণত হতো, লোক সংখ্যা ৭০ হাজার অতিক্রম করতো, তিনি সপ্তাহে তিনদিন ওয়াজের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন। ৫২১ হিজরি থেকে ৫৬১ হিজরি পর্যন্ত বিরতিহীন ও দায়িত্ব পালনে ওয়াজের মজলিসে তাঁর প্রদত্ত বক্তব্য লিখে রাখতে চার শতাধিক দোয়াত ব্যবহার করতে হয়েছিল। (বাহজাতুল আসরার, পৃ: ৯৫)।
একটি জটিল মাসআলার সমাধান: শায়খ জিলানি ছিলেন জটিল কঠিন মাসআলার শরয়ী সমাধান প্রদানে অত্যন্ত দুরদর্শী পারঙ্গম তাঁর বুদ্ধিমত্তা ইলমী গভীরতা ও উপস্থিত প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তা ছিল অসাধারণ। তাঁর সন্তান হযরত শায়খ আবদুর রাজ্জাক বর্ণনা করেন, দূরদেশ থেকে বাগদাদে একটি ফাতওয়া জানতে চাইলে সমকালীন বিজ্ঞ মুফতি ও আলিমদের কেউ এর সঠিক সমাধান দিতে পারছিলেন না, আলোচ্য প্রশ্নটি ছিল এরূপ যে, কোন ব্যক্তি কসম করেছে তার স্ত্রী তিন তালাক যদি না সে আল্লাহর এমন ইবাদত করে যা শুধু সে–ই করবে, সে সময়ে অন্য কেউ সেই ইবাদত করবেন না। এমতাবস্থায় সে কীরবে? তাকে আমার পিতার কাছে নিয়ে আসা হলো, আমার পিতার তাৎক্ষনিক এ মাসআলার সমাধান দেন, সে মক্কায় যাবে এবং মাতাফ তার জন্য খালি করা হবে, এর পর সে একাই সাতবার তাওয়াফ করবে এভাবে তার কসম পূর্ণ হয়ে যাবে। সমাধান পেয়ে ফাতওয়া প্রার্থী বাগদাদ ছেড়ে চলে যায়। (তাবকাতুল হানাবিলা, খন্ড: ১, পৃ: ২৯৪)
শায়খ জিলানী কর্তৃক সমকালীন শাসকের অনৈসলামিক কর্মের জোরালো প্রতিবাদ:
শায়খ জিলানি দ্বীনি মজলিসে কুরআন সুন্নাহর আলোকে মানুষের মাঝে হেদায়তের বানী, তাকাওয়া ভিত্তিক জীবন পদ্ধতি গঠন ও ইনসাফ ভিত্তিক আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে ক্ষান্ত হননি। রাষ্ট্র পরিচালনার দাায়িত্বে অধিষ্টিত কর্তা ব্যক্তিরা যখনই শরয়ী বিধি–বিধান লংঘন করতেন প্রজা সাধারণের উপর অন্যায়ভাবে জুলুম নির্যাতন চালাতেন রাষ্ট্রের কোথাও যখন অনৈতিক লেনদেন ও সুদ ঘুষের বিষয়ে কোনো সংবাদ তাঁর কর্ণগোচর হতো তখনই তিনি প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করতেন উল্লেখ্য যে, ৫৪১ হিজরি ১১৪৬ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের খলিফা মুকতাফির শাসনকালে ইয়াহিয়া ইবনু সায়িদকে বিচারকের দায়িত্ব দেয়া হয়। বিচারকের পদে বসে তিনি সুবিচার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষকে ন্যায় বিচার ও প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। তাঁর অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারো সাহস ছিলোনা। এমতাবস্থায় খলিফা একদিন মসজিদে বসা ছিলেন গউসুল আযম শায়খ আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) এ সুযোগে মসজিদের মিম্বর থেকে খলিফাকে সম্বোধন করে সতর্ক করলেন একজন জালিমকে কেন বিচারকের দায়িত্ব দিয়েছেন তীব্র প্রতিবাদ করনে। খলিফা গাউসে পাকের সতর্কবানী শুনামাত্র বিলম্ব না করে ওই অত্যাচারী বিচারককে বরখাস্ত করেন। হযরত শায়খ জিলানি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সোচ্চার কণ্ঠ। (মিরআতুজ জামান, খন্ড: ৮, পৃ: ২৬৫)।
বিশ্বজুড়ে ইসলাম প্রচারে কাদেরিয়া তরীক্বর ভূমিকা: অলীকুল শিরোমনি হযরত শায়খ সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানি (র.) কাদেরিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা, তিনি এ তরিকার ইমাম ও সর্ব শ্রেষ্ঠ কুতুব তাঁকে গাউসুল আজম বলা হয়। বাংলাদেশে তিনি বড়পীর বলেও সুপ্রসিদ্ধ। অলীকুল সম্রাট হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানি (র.) ৫৬১ হি. সনে ১১ রাবিউস সানি সোমবার ৯১ বৎসর বয়সে ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ নগরীতে ইন্তিকাল করেন। তাঁর নামানুসারেই তাঁর উদ্ভাবিত ও প্রচারিত তরিকার নাম হলো কাদেরিয়া তরীকা। গাউসে পাকের শিষ্য খলিফা ও কাদেরিয়া সিলসিলার মাশায়েখগণ হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানি (রা.)’র রুহানি ফয়েজ প্রাপ্ত হয়ে আরবে আজমে সমগ্র ভারত বর্ষ ইরাক ইরান মিশর মরক্কো সিরিয়া দামেস্ক বাংলাদেশ বার্মা প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইসলামের প্রচার প্রসার ও কাদেরিয়া তরিকার বিস্তারে অনবদ্য অবদান রাখেন। গাউসে পাক ৫০৯ হিজরি সনে প্রথমবার হজ্বব্রত পালন করেন তখন তাঁর বয়স ছিল ৩৮ বছর। (বাহজাতুল আসরার, পৃ: ১৮৮)
গাউসে পাক দ্বিতীয়বার হজ্ব পালন কালীন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সুফী সাধক ওলামা মাশায়েখ তাঁর সান্নিধ্যে ও ফয়েজ লাভে ধন্য হন, মিশরের শায়খ উসমান ইবনু মারজুক কারশি মরক্কোর সুফী সাধক শায়খ আবু মাদিন মাগরিবি, সিরিয়ার আধ্যাতিক সাধক শায়খ আর সালান দিমাশকি তাসাউফ চর্চা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেন। অপর আরেকটি বর্ণনামতে কাদেরিয়া তরিকা থেকে সৃষ্ট নয়টি তরিকা। তাসাউফ চর্চা ও বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
চারটি তরীকা প্রসিদ্ধি লাভ করেছে কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দীয়া ও সুহরাওয়ার্দীয়া। অনেকে মোজাদ্দেদীয়া এর স্থলে সুহরাওয়ার্দীয়া তরিকার নাম উল্লেখ করেন, এ ছাড়া অন্যান্য সিলসিলা উপরোক্ত চারটি সিলসিলার শাখা সিলাসিলা, তবে একথা অনস্বীকার্য যে সমগ্র মুসলিম বিশ্বে সর্বাধিক প্রভাবশালী সুফী তরিকা হচ্ছে কাদেরিয়া সিলাসিলা বা কাদেরীয়া তরীকা। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে হযরত শায়খ আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)’র আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।