পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফের আলোকে কুরবানির ফযীলত ও মাসায়েল
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিজের ও পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী পেশ করুন। জেনে রাখুন কুরবানী একটি আর্থিক ইবাদত, যা সামর্থবান মুসলমানদের উপর ওয়াজিব।
আল কুরআনের আলোকে কুরবানীর নির্দেশনা:
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম’র কুরবানীর অবিস্মরনীয় ঘটনাকে জীবন্ত করে রাখার জন্যই উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর আল্লাহ কুরবানীর বিধান ওয়াজিব করেছেন। দ্বিতীয় হিজরীতে ঈদুল আযহার বিধান, কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার বিধান নাযিল করেন। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “সুতরাং আপনি আপনার প্রতি পালকের জন্য নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন। [তরজমা কানযুল ঈমান, সূরা: কাউসার, ১০৮:২]
কুরবান শব্দের আভিধানিক ও শরয়ী অর্থ:
কুরবানুন শব্দটি আরবি, কুরবুন শব্দ থেকে নির্গত, এর আভিধানিক অর্থ নৈকট্য লাভ, ত্যাগ, উৎসর্গ, বিসর্জন ইত্যাদি।
ইসলামী ফিকহ শাস্ত্রের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ “শরহে বেকায়াতে” উল্লেখ আছে, শরয়ী পরিভাষায় কুরবানীর দিন সমূহের কোনো একটি দিনে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নিদ্দিষ্ট প্রাণী জবাই করাকে উদ্বহিয়া তথা কুরবানী বলা হয়। অনুরূপ ভাবে বিশ্ববিখ্যাত ফাতওয়া গ্রন্থ “আল ফিকহ আলাল মাযাহিবিল আরবাআ” কিতাবে উল্লেখ আছে, কুরবানীর নির্দিষ্ট দিনগুলোতে চতুস্পদ জন্তু জবেহ বা নহর করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নাম হলো কুরবানী। [আল ফিকহু আলালা মাযাহিবিল আরবাআ, খন্ড ১ম, পৃ: ৭১৫ কৃত: আল্লামা আবদুর রহমান জাযিরী (র.)]
কুরবানীর বিধান কুরআন সুন্নাহ দ্বারা নির্ধারিত। এটা ইসলামের একটি বিশেষ ইবাদত। কুরবানী না করে এর বিনিময় মূল্য ইত্যাদি দেওয়া যাবেনা। [তাফসীরে নূরুল ইরফান, কৃত: হাকিমূল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী (র)]
কুরবানী আল্লাহর নিকট প্রিয় আমল:
পশুর রক্ত প্রবাহিত করা বা মাংস খাওয়ার নাম কুরবানী নয়। মহান আল্লাহর প্রেমে অন্তরাত্নাকে বিশুদ্ধচিত্তে তাকওয়া অর্জনের মধ্য দিয়ে নিজেকে আল্লাহর নিকট উৎসর্গ করা পশুবৃত্তি ও কুপ্রবৃত্তির তাড়না থেকে নিজকে পরিশুদ্ধ করাই কুরবানীর মর্মকথা। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আল্লাহর নিকট পৌছায়না এর মাংস ও রক্ত, পৌছায় তোমাদের তাকওয়া।” [সূরা: হজ্ব ২২:৩৭]
খোদাভীতি ও তাকওয়া শূন্য ইবাদত আল্লাহর নিকট গুরুত্বহীন ও অর্থহীন। কে কত বড় পশু কুরবানী দিল তা মূখ্য নয়। আল্লাহর কাছে লৌকিকতা ও পশু ক্রয়ের প্রতিযোগিতা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা মুত্তাকীদের কুরবানী কবুল করেন।” [সূরা: মায়িদা ৫:২৭]
হাদীস শরীফের আলোকে কুরবানীর ফযীলত:
হাদীস শরীফে কুরবানীর গুরুত্ব ও ফযীলত সংক্রান্ত অসংখ্য বর্ণনা এসেছে, এরশাদ হয়েছে, উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আদম সন্তান কুরবানীর দিন যেসব নেক আমল করেন তম্মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল হলো কুরবানীর পশুর রক্ত প্রবাহিত করা। কিয়ামতের দিবসে কুরবানীর পশু তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ উপস্থিত হবে। তার কুরবানীর রক্ত জমীনে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর নিকট তা কবুল হয়ে যায়। অতএব তোমরা আন্তরিকভাবে সন্তুষ্টিচিত্তে কুরবানী করো। [তিরমিযী শরীফ, ১ম খন্ড, পৃ: ২৭৫, ইবনে মাযাহ শরীফ, পৃ: ২২৬]
হাদীস শরীফে আরো এরশাদ হয়েছে, তোমরা মোটা তাজা পশু কুরবানী করো, কেননা কুরবানীর পশু পুলসিরাতে তোমাদের বাহন হবে। [কানযুল উম্মাল, খন্ড ৫ম, পৃ: ৩৫, আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড ৩য়, পৃ: ৩৭৬, ফয়যুল কদীর, খন্ড ১ম, পৃ: ৪৯৬]
সামর্থ থাকা সত্বেও কুরবানী বর্জনকারীর জন্য সতর্কতা:
কুরবানী একটি পুণ্যময় ইবাদত ও সওয়াবের কাজ। হিজরতের পর মদীনা মনোওয়ারায় অবস্থানকালীন সময়ে নবীজি কোনো বৎসর কুরবানী ত্যাগ করেননি। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি সামর্থ থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করেনা সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। [সুনানে ইবনে মাযাহ, ৩১২৩, ফয়জুল কাদীর, খন্ড ৬ষ্ঠ, পৃ: ২০৮]
কুরবানীর সময়সীমা:
১০ জিলহজ্ব তারিখে কুরবানী করা উত্তম। কোন কারণবশত প্রথম দিবসে করা সম্ভব না হলে দ্বিতীয় দিন, এতেও সম্ভব না হলে ১২ তারিখ পর্যন্ত করা জায়েজ। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, কুরবানীর সময় তিন দিন, প্রথম দিনই উত্তম। [ বাদায়েউস সানায়ে, খন্ড ৫ম, পৃ:৬৫]
মাসআলা: কুরবানীর পশু ক্রয় করেছে কিন্তু কুরবানীর দিন সমূহে কোন কারণে কুরবানী করতে পারেনি সেক্ষেত্রে পশু সাদকা করে দিবে। আর যদি পশু ক্রয় না করে থাকে তখন একটি বকরীর মূল্য সাদকা করে দেওয়া ওয়াজিব। এরূপ করা না হলে গুনাহগার হবে। [রদ্দুল মুখতার, খন্ড ৫ম, পৃ: ২০৪, ফাতওয়া–এ ফয়জুর রাসূল, খন্ড ৩য়, পৃ: ২৩০]
১০ জিলহজ্বের ফযীলত:
জিলহজ্বের দশম তারিখ এর ফযীলত প্রসঙ্গে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে, এরশাদ হয়েছে, হযরত জাবের ইবন আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহর নিকট ১০ জিলহজ্ব (ঈদুল আযহা) থেকে উত্তম কোনো দিন নেই। [সহীহ ইবন হিব্বান ৯/১৬৪, হাদীস নং: ৩৮৫৩]
একাধিক ব্যক্তির কুরবানীর বিধান:
ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা এ তিন শ্রেণির পশুতে একাধিক ব্যক্তি শরীক হতে পারবেনা। একজনের জন্য একটি কুরবানী করতে হবে। পক্ষান্তরে গরু, মহিষ ও উট এই তিন প্রকার পশুর প্রত্যেকটিতে সাত ব্যক্তি পর্যন্ত শরীক হতে পারবে। (আলমগীরি ৫ম খন্ড)
কুরবানীর পশুর বয়স:
ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কুরবানীর জন্য এক বছরের হওয়ার শর্ত। যদি এরূপ মোটা তাজা হয় যে, দেখতে এক বছরের মত মনে হয়। তাহলে ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ। এক বছরের চেয়ে কম বয়সের হলে এর দ্বারা কুরবানী জায়েজ হবেনা। (শামী)
জন্মগতভাবে যে পশুর শিং নেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েজ হবে। যে পশুর শিং মূলসহ উপড়ে গেছে এ ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী জায়েজ নয়। (রদ্দুল মুহতার)
মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করা জায়েজ। বরং সওয়াবের কাজ। এতে মৃত ব্যক্তির রূহে ছওয়াব পৌছে যা উপকারী ও কল্যাণকর। (বাহারে শরীয়ত)
কুরবানীর পশুর হাড় বা অন্য কোন কিছু বিক্রি করলে তার মূল্য সাদক্বাহ করে দেওয়া ওয়াজিব। (আলমগীরি)
কুরবানীর মাংস নিজে খাবে। আত্মীয়–স্বজনকে দিবে, ও ফকীর মিসকীনকে দান করবে। তবে মাংস তিন ভাগ করা উত্তম। একভাগ নিজ পরিবারের জন্য, একভাগ আত্মীয়–স্বজনের জন্য ও একভাগ ফকীর মিসকীনদের জন্য। (বাহারে শরীয়ত)
কুরবানকারী ব্যক্তির জন্য কুরবানীর মাংস বিক্রি করা জায়েজ নয়। যাবেহকারীর পারিশ্রমিক বা মাংস প্রস্তুতকারীদের পারিশ্রমিক হিসেবে কুরবানীর মাংস বা চমড়া দেওয়া জায়েজ নেই। (বাহারে শরীয়ত)
কুরবানির চামড়ার শরয়ী বিধান: কুরবানীর চামড়া দান করে দিবে, ইচ্ছা করলে নিজেও ব্যবহার করতে পারবে, বিক্রি করলে তার মূল্য গরীব মিসকীনকে দান করে দিতে হবে। (বাহারে শরীয়ত)
দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের এতিম মিসকীন শিক্ষার্থীদের সাহায্যার্থে লিল্লাহ বোডিং–এ দান করা উত্তম।
কুরবানীর চামড়ার মূল্য দ্বারা মসজিদ, মাদরাসার, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও শিক্ষকদের বেতন দেওয়া জায়েজ নেই। (আলমগীরি)
কুরবানীর পশুর রশিও সাদক্বাহ করা মুস্তাহাব। (বাহারে শরীয়ত)
পশু যবেহ করার বিধান:
কুরবানীর পশু নিজ হাতে যবেহ করা মুস্তাহাব। নিজে করতে না পারলে অন্যদের দ্বারা করাবে, তবে সামনে নিজে উপস্থিত থাকা উত্তম। (শামী ৫ম খন্ড)
যবেহ করার সময় পশুকে ক্বিবলামুখী করে শোয়াবে অত:পর (বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর) বলে যবেহ করবে।
যবেহ করার পূর্বে ছুরি ভালভাবে ধার দিতে হবে। যবেহকারী ক্বিবলামুখী হওয়া সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। যবেহ করার সময় ৪টি রগ কাটা সুন্নাত। এগুলো হলো, ক. শ্বাসনালী, খ. খাদ্য নালী, গ. দুই পাশে দুটি রক্ত বাহী মোটা রগ এ ৪টি কাটা গেলে পশু হালাল হয়ে যাবে, সম্পূর্ণরূপে গলা কেটে ফেলা মাকরূহ। (আলমগীরি)
তাকবীর তাশরীক:
জিলহজ্ব মাসের ৯ তারিখের ফজর হতে ১৩ তারিখের আসর পর্যন্ত ফরজ নামাযের পর উচ্চস্বরে একবার তাকবীর পাঠ করা ওয়াজিব, তিনবার পড়া উত্তম। তাকবীর: “আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, ওয়ালিল্লাহিল হামদ।” হে আল্লাহ আমাদের কে তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কুরবানী করার তাওফীক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।