জুম’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৭ জুন, ২০২৪ at ৭:৩০ পূর্বাহ্ণ

মানবাধিকার সংরক্ষণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত বিদায় হজ্বের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা!

মানবাধিকার অর্থ হচ্ছে মানুষের অধিকার। মানব জীবেেনর সাথে সম্পর্কিত মানুষের রক্ষার অধিকার। মর্যাদা রক্ষার অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, শিক্ষার অধিকার, চিকিৎসার অধিকার, ইসলামে নারীর অধিকার, উত্তরাধিকার প্রাপ্তির অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার, ন্যায় বিচার লাভের অধিকার, মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, প্রতিটি বিষয় ইসলামী মানবাধিকারে অন্তর্ভুক্ত। বিদায় হজ্বের ভাষণে রয়েছে মানব জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট নির্দেশনা।

বিদায় হজ্বের দিনে ইসলাম পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে ঘোষিত: ১০ম হিজরির ৯ যিলহজ্ব (৬৩২ খ্রি.) শুক্রবার আরাফার ময়দানে হজ পালনের লক্ষ্যে সমবেত প্রায় এক লক্ষ চব্বিশ হাজার মুসলিম জনতার সামনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষন ইসলামের ইতিহাসে বিদায় হজ্বের ভাষণ নামে পরিচিত। ৯ম হিজরিতে হজ্ব ফরজ হওয়ার পর এ আয়াত নাযিল হয়। এ বৎসর হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কে আমীরূল হুজ্জাজ নিযুক্ত করে মক্কা মুকাররমায় প্রেরণ করেন, মুসলমানগণ তাঁর নেতৃত্বে হজ্ব আদায় করেন। ১০ম হিজরির যিলক্বদ মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্বে গমনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। নবীজি হজ্বে গমনের বিষয়টি সর্বত্র প্রচার করা হয়। ১০ হিজরির ২৫ যিলক্বদ শনিবার যোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে নবীজি মক্কার উদ্দ্যেশে মদীনা মনোওয়ারা রাওয়ানা হলেন সাহাবায়ে কেরামের বিশাল কাফেলা নবীজির সঙ্গী হলেন। ঐতিহাসিকদের মতে এর সংখ্যা নব্বই হাজার অথবা এক লক্ষ চৌদ্দ হাজার অথবা আরো অধিক সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম রাসূলূল্লাহর সঙ্গী হলেন, নবীজি যিলহজ্বে ৪ তারিখে পবিত্র মক্কায় প্রবেশ করেন। (শরহে মাওয়াহিব, খন্ড:, পৃ: ১০৫, সীরাতুল মুস্তাফা, খন্ড: ৩য়, পৃ: ১৪০১৪১)

এ হজ্বকে “হাজ্জাতুল বিদা” বলা হয়। বিদায় হজ্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম জনতাকে বিদায় বার্তা জ্ঞাপন করেছেন। এটিকে হাজ্জাতুল ইসলাম ইসলামের হজ্ব নামেও অভিহিত করা হয়, যেহেতু মদীনা মুনাওয়ারা হতে ইসলামী বিধানের অন্তর্ভক্ত হজ্ব হিসেবে নবীজি আর কোনো হজ্ব করেনি, অবশ্য হিজরতের পূর্বে নবুওয়ত প্রকাশের পর একাধিকবার হজ্ব করেছিলেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড: ৫ম, পৃ: ১৯৫)

এ হজ্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত ভাষণের পর কুরআনুল করীমের এ আয়াত নাযিল হয়। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করে দিলাম। এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা: মায়িদা০৩)

আরাফার ময়দানে বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ: বিদায় হজ্বের ভাষণ ছিল মূলত: তিনটি ভাষনের সমষ্টি প্রথম ভাষণটি ৯ যিলহজ্ব আরাফার ময়দানে “কাসওয়া” নামক উটনীর উপর অবস্থান পূর্বক লক্ষাধিক জনতার উদ্দেশ্যে নবীজির প্রদত্ত ভাষণ। দ্বিতীয়টি ১০ যিলহজ্ব মিনাতে প্রদত্ত ভাষণ। তৃতীয়টি ১১ অথবা ১২ জিলহজ্ব গদীর ই খুম নামক স্থানে প্রদত্ত ভাষণ। সিহাহ সিত্তাহসহ প্রায় সকল হাদীস গ্রন্থে এই ঐতিহাসিক ভাষণের বিভিন্ন অংশ বিক্ষিপ্তভাবে বণির্ত হয়েছে, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে এ ভাষনের যিনি যে অংশ স্মরণ রাখতে পেরেছেন তিনি সেই অংশ বর্ণনা করেছেন যা ইসলামের ইতিহাসে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার এক শ্রেষ্ঠ সম্পদ ও অনবদ্য দলীল হিসেবে স্বীকৃত হয়ে আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলহজ্ব মাসের ৮ তারিখ মিনায় গমন করেন সেখানে নয় তারিখ সকাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। সূর্যোদয়ের পর আরাফার দিকে রওয়ানা হন, সূর্য ঢলে পড়ার পর তিনি একটি ভাষণ প্রদান করেন। (সীরতে ইবনে হিশাম, /৬০৩)

ভাষণের প্রারম্ভে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রশংসা করলেন, অত:পর উপস্থিত লক্ষাধিক জনতার উদ্দেশ্যে এক যুগান্তকারী ভাষণ প্রদান করেন।

জাহেলী যুগের সকল রীতি নীতি বাতিল ঘোষিত হলো:

নবীজি এ ভাষণে এরশাদ করেন, অন্ধকার যুগের সকল রীতি নীতি আমার পদতলে পদদলিত। জাহেলী যুগের খুন খারাবীর অর্থাৎ প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার বাতিল করা হলো। আমি সর্বপ্রথম রাবীআ ইবন হারিস ইবন আবদুল মুত্তালিবের খুন যা হুযায়ল গোত্রের উপর ছিল এর প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার বাতিল করলাম। জাহেলী যুগে সর্বপ্রকার সূদ প্রথা বাতিল করা হলো তোমাদের শুধু ঋণের মূল অংশ প্রদান করতে হবে। সর্বপ্রথম আমি (আমার চাচা) আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের সুদ বাতিল করলাম। (সহীহ মুসলিম, সীরাতুল মুস্তফা, ৩য় খন্ড, পৃ: ১৪০)

নারী জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিদায় হজ্বের ভাষণে নির্দেশনা: জাহিলী যুগে নারী জাতি ছিল সর্বদিক থেকে অবহেলিত, অধিকার বঞ্চিত, সামাজিক ভাবে তাদের কোনো মর্যাদা ছিলনা, সর্বত্র তারা ছিল নিগৃহীত লঞ্চিত বঞ্চিত অপমানিত। নারী জাতির জন্মকে অশুভ ও কলংক মনে করা হতো, নবজাত শিশু কন্যাকে জীবন্ত কবরস্থ করা হতো, ইসলামই নারী জাতির মর্যাদাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে, উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করেছে, নারীকে বোন হিসেবে মা, স্ত্রী হিসেবে নারী জাতির মর্যাদা ও সম্মান সুরক্ষায় সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে, নারী জাতির ইজ্জত সম্মান সম্ভ্রম সুরক্ষায় হিযাবের বিধান প্রবর্তন করেছে। সুখময় পারিবারিক জীবন গঠন ও দাম্পত্য জীবন শান্তিময় ও সুখকর করার লক্ষ্যে স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক দায়িত্ব কর্তব্য পালনের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছে। নারীদের মর্যাদা প্রসঙ্গে বিদায় হজ্বের ভাষণে নবীজির নির্দেশনা আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে, এরশাদ হয়েছে, “নারীদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, কারণ তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছো আল্লাহর দেওয়া কলেমার মাধ্যমে তোমরা তাদের হালাল করেছো তাদের কাছে তোমাদের প্রাপ্য হলো তারা যেন তোমাদের বিছানায় এমন কোন লোককে স্থান না দেয় যাকে তোমরা অপছন্দ কর। যদি তারা এরূপ করে তাদের হালকাভাবে প্রহার কর। আর তোমাদের উপর তাদের ন্যায়সঙ্গত ভরণ পোষনের ও পোশাক পরিচ্ছদের অধিকার রয়েছে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১২১৮)

কুরআন সুন্নাহ আঁকড়ে থাকলে পথভ্রষ্ট হবে না: আল্লাহর নির্দেশিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত, কুরআন ও সুন্নাহর বিধান অনুসরণেই সংকট মুক্তির পাথেয়। এ পথেই রয়েছে দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতে মুক্তি, কুরআন সুন্নাহর বিরোধীতা, কুফরির নামান্তর। কুফরি মানুষকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে। নবীজি তার ভাষণে এরশাদ করেছেন, আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যতদিন পর্যন্ত তোমরা এ দুটি জিনিসকে আঁকড়ে ধরবে ততদিন পর্যন্ত কখনো পথভ্রষ্ট হবেনা। তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাহ।

আরবের উপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই সকলে সমান: ইসলাম সাম্যের ধর্ম, মানবতার ধর্ম, সহমর্মিতার ধর্ম, ইসলাম বর্ণবাদের বৈষম্য বিলুপ্ত করেছে। এ ঐতিহাসিক ভাষণে সাম্যের বানী অনুরণিত হয়েছে এরশাদ হয়েছে, হে মানবমন্ডলী! নিশ্চয় তোমাদের প্রভূ এক, তোমাদের পিতা এক, সাবধান অনারবের উপর আরবের, কৃঞ্চাঙ্গের উপর শ্বেতাঙ্গের কিংবা শ্বেতাঙ্গের উপর কৃঞ্চাঙ্গের কোন শ্রেষ্ঠত্ব বা প্রাধান্য নেই তাকওয়া ব্যতীত।

প্রত্যেক মুসলিম ভাই ভাই: মু’মিন মাত্রই অখন্ড ভাতৃসংঘ। পৃথিবীর এক প্রান্তের মুসলিম অপর প্রান্তের মুসলিম ঈমানী সম্পর্কের সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ। পৃথিবীর যে কোনো নির্যাতিত মজলুম মুসলমানদের প্রতি সহমর্মিতা ও সমবেদনা প্রকাশ করা পারস্পরিক সহযোগিতা প্রসারিত করা অপর মুসলমানের নৈতিক ও ঈমানী দায়িত্ব, অন্যায়ভাবে কারো সম্পদে অবৈধ হস্তক্ষেপ ও গ্রাস করা ইসলাম কঠোর ভাবে নিষেধ করেছে, বিদায় হজ্বের ভাষণে এরশাদ হয়েছে, হে মানব মন্ডলী! আমার কথা শ্রবণ কর এবং হৃদয়ঙ্গম করো, জেনে রেখো! প্রত্যেক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। মুসলমানরা পরস্পর ভাই ভাই কাজেই নিজের ভাইয়ের কোন জিনিস তার খুশী মনে দান ব্যতীত গ্রহণ করা অবৈধ, তোমরা মানুষের উপর অত্যাচার করো না। হে আল্লাহ! আমি কি আপনার বাণী পৌঁছিয়ে দিতে পেরেছি! উপস্থিত জনতা সমবেত কন্ঠে বলে উঠলেন হে আল্লাহর রাসূল! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনি আপনার দায়িত্ব সঠিকভাবে পৌছিয়েছেন, রাসূলুল্লাহ এরশাদ করলেন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। হে আল্লাহ! আমাদের জীবনে বিদায় হজ্বের ভাষনের নির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমীন।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৬ দফা : চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতাদের ভূমিকা
পরবর্তী নিবন্ধমেঘের নাম মরিয়ম