মাহে রমজানের বিদায়ী বার্তা : আজ জুমাআতুল বিদা। পবিত্র রমজানের শেষ জুমা। কুরআন হাদীসের আলোকে পবিত্র রমজান মাসে প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান ১০গুণ থেকে সাতশগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। এ বিশ্বাসে জুমাতুল বিদার একটি জুমাতে ন্যূনতম ৭০০টি জুমার সমতুল্য সওয়াব নিহিত।
আজকের জুমার মিম্বরে খতীবের কন্ঠে পবিত্র রমজানের বিদায়ের করুণসুর অনুরণিত। মাহে রমজানের বিদায়ের মুহূর্তে বেদনার্ত সূরে অন্তরাত্মার গভীর মহব্বত ও ভাালবাসার স্মারক নিবেদন করুন। আস্সালামু আলাইকা ইয়া শাহরা রামদান, আস্সালামু আলাইকা ইয়া শাহারাল কোরআন, আস্সালামু আলাইকা ইয়া শাহরাল মাগফিতাতে ওয়াল ইত্কে মিনানিরান। আল বিদাউ–আল বিদাউ ইয়া শাহারা রামাদান।
রহমত মাগফিরাত ও নাযাতের মাস তোমার প্রতি সালাম, তারাবীহ, তাসবীহ, তাহলীল, তিলাওয়াতের মাস তোমার প্রতি সালাম। যাকাত, ফিতরা, দান–সাদকা, আসহায়, গরীব–দুখী, বিপন্ন মানবতার প্রতি সহমর্মিতার মাস তোমার প্রতি জানাই সালাম।
হে আল্লাহ মাহে রমজানের বিদায়ের মূহুর্তে আমাদের সিয়াম সাধনা কবুল করুন। আমাদের তাওবা এস্তেগফার কবুল করুন। রমজান আসে তোমার মুক্তি প্রাপ্ত সৌভাগ্যবান বান্দাদের মধ্যে আমাদেরকে অন্তভূক্ত করুন। রমজানের জ্যোতিময় আলোতে আমাদের অন্তরাত্মা আলোকিত করুন। রমজানের প্রকৃত শিক্ষায় ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমাদেরকে অন্যায়, অবিচার ও গুণাহের কাজ থেকে বিরত রাখুন।
জুমাআ দিবসের আমলের সওয়াব অপরিসীম: একে তো জুমা দিবসকে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের জন্য সাপ্তহিক ঈদ ঘোষণা করেছেন। অন্যদিকে জুমাতুল বিদা রমজান শরীফে অনুষ্ঠিত হওয়ায় এর গুরুত্ব ও ফজীলত দশ থেকে সাতশগুণ বেশী। মহান আল্লাহ চান তো আরো অধিক দিতে পারে।
হযরত আউস ইবনে আউস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি জুমার দিবসে গোসল করবে এবং কাপড় চোপড় ধৌত করবে। সকাল সকাল প্রস্তুতি গ্রহণ করত: প্রথম ওয়াক্তে মসজিদে উপস্থিত হবে। কোন বাহনে আরোহণ না করে পদব্রজে রওয়ানা হবে। মসজিদে ইমামের সন্নিকটে বসবে। কোন অনর্থক কথা বলবেনা। বা বাজে কাজ করবেনা। তার প্রত্যেক কদমে এক বছরের নফল রোজা ও নফল নামাযের সওয়াব হবে। (তিরমিযী শরীফ)
দরুদ শরীফ জুমাবারের বরকতময় আমল: নিয়মিত দরুদ শরীফ পাঠের ফজীলত বর্ণনাতীত। একবার দরুদ শরীফ পাঠের দশবার আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়, দশটি গুণাহ ক্ষমা হয়, দশগুণ মর্যাদা বৃদ্ধি হয়। নবীজির বংশধরদের প্রতি মহব্বত অন্তরে জাগ্রত হয়। পরকালে নবীজির শাফায়াত নসীব হয়। বিশেষত: রমজান শরীফে ও জুমাবারে দরুদ শরীফ পাঠে সওয়াব আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন যে ব্যক্তি জুমার দিবসে আমার উপর আশিবার দরুদ শরীফ পাঠ করবে আল্লাহ তা’য়ালা তার আশি বছরের গুণাহ (সগীরা) ক্ষমা করে দেবেন। (দারে কুত্নী আস সুন্নাহ ২/১৫৪ পৃ🙂
পিতা–মাতা ও মুরব্বীদের কবর জিয়ারত: সম্মানিত নবী গণের রওজা শরীফ, সাহাবায়ে কেরাম, শোহাদায়ে কেরাম, আউলিয়ায়ে কেরাম, বুজুর্গানেদ্বীনের মাজার শরীফ, পিতা–মাতা, আত্মীয়–স্বজন ও মুরব্বীদের কবর যিয়ারত একটি পুণ্যময় বরকত আমল। এর দ্বারা ইহকালে পরহেজগারী সৃষ্টি হয়। খোদাভীতি জাগ্রহ হয়। পরকালের কথা স্মরণ হয়। যা কোরআন ও হাদীসের অসংখ্য বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। জুমাবারে যিয়ারতের উপকারিতা ও ফযীলত আরো বেশী।
এরশাদ হয়েছে, “উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহুা হতে বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তার পিতা–মাতা উভয়ের বা একজনের জুমাবার দিবসে যিয়ারত করবে এবং তাদের কবরের নিকট সূরা ফাতেহা পাঠ করবে, তাদের ক্ষমা করা হবে। (ইমাম সাফি/আল কামিল–৫./১৫১ পৃ🙂
চাঁদ দেখার গুরুত্ব: চাঁদ দেখার অপরিহার্যতা সম্পর্কে অসংখ্য হাদীস রয়েছে “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, রমজান মাসের চাঁদ না দেখা পর্যন্ত তোমরা রোজা রেখোনা। আর চাঁদ না দেখা পর্যন্ত তোমরা ইফতার করোনা (ঈদ করনা)। (বোখরী ও মুসলিম)
ঈদের চাঁদ দেখার দুআ: হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নতুন চাঁদ দেখলে বলতেন, “আল্লাহু আকবর, আল্লাহুম্ম আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানী ওয়াসসালামতি ওয়াল ইসলামী ওয়াতাওফিকী লিমা য়ুহিব্বু রাব্বুনা ওয়া ইয়ারদ্বা রাব্বুনা ওয়া রাব্বুকাল্লাহ।” অর্থ: আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, হে আল্লাহ! আপনি এ নতুন চাঁদের সূচনা করুন কল্যাণ, নিরাপত্তা ও ঈমানের সাথে শান্তি ও ইসলামের সাথে এবং আমাদের প্রভূ যা ভালবাসেন ও পছন্দ করেন তা পালনের তাওফিকসহ আমাদের ও তোমার (হে নতুন চাঁদ) প্রভু আল্লাহ। (দারিমী শরীফ)
ঈদুল ফিতরের রজনীতে আল্লাহ দুআ ফেরত দেন না: রমজান শেষে পশ্চিমাকাশে শাউয়াল চাঁদ উদিত হওয়ার সাথে সাথে ঈদুল ফিতরের আগমনী বার্তায় মু’মীন মুসলিমরা এ রজনীর বরকত ও নিয়ামত অর্জনের লক্ষ্যে ইবাদতে মনোযোগী হবে। ফরজ সুন্নাত ও নফল ইবাদত কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে এ রাতের পুণ্য ও বরকত অর্জনে সচেষ্ট হবে। হাদীস শরীফের বিভিন্ন বর্ণনায় পাঁচটি বরকতময় রজনীতে দুআ কবুলের সুসংবাদ রয়েছে “ হযরত অবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, পাঁচ রাত্রির দুআ আল্লাহ তা’য়ালা ফেরত দেন না। ১. জুম আর রাত, ২. রজবের প্রথম রাত, ৩. শাবানের ১৫ তারিখ শবে বরাতের রাত, ৪. ঈদুল ফিতরের রাত ও ৫. ঈদুল আযহার রাত। (ইমাম আবদুর রাযযাক, আল মুসান্নাফ, ৪/৩১৭ পৃ:, হাদীস ৭৯২৭)
ঈদের নামায সংক্রান্ত মাসায়েল: ১. ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার নামায ওয়াজিব। ঈদের নামাযে আযান ও ইকামত নেই। (বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ৭৭৯)
২. জুমার জন্য খুত্বা শর্ত, ঈদের জন্য খুত্বা সুন্নাত। জুমার খুত্বা নামাযের আগে, ঈদের খুত্বা নামাযের পরে। (দুররে মোখতার, খন্ড: ৩য়, পৃ: ৬০)
৩. ঈদের নামাযের সময় সূর্যোদয়ের ২০/২৫ মিনিট পর থেকে শরয়ীভাবে অর্ধদিন পর্যন্ত। ঈদুল ফিতর একটু দেরীতে ঈদুল আযহার নামায তাড়াতাড়ি পড়া মুস্তাহাব। (দুররুল মুখতার, ৩য় খন্ড, পৃ: ৬০)
ঈদের দিনে সুন্নাত আমল সমূহ: ১. ঈদের দিন গোসল করা সুন্নাত। এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন গোসল করতেন। (ইবনে মাযাহ, হাদীস: ১৩১৫)
ঈদগাহে যাওয়ার আগে খেজুর খাওয়া সুন্নাত: এরশাদ হয়েছে, হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে কয়েকটি খেজুর না খেয়ে যেতেন না। (বুখারী শরীফ, হাদীস: ৯৫৩)
ঈদগাহে একপথে যাওয়া অন্য পথে আসা সুন্নাত: এরশাদ হয়েছে, হযরত জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ঈদের দিনে নবীজি রাস্তা পরিবর্তন করতেন। (বুখারী, হাদীস: ৯৮৬)
ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার সময় নিম্নস্বরে তাকবীর বলবে। আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবার, লাইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ। (আলমগীরি, ১ম খন্ড, পৃ: ১৫২)
গুনাহমুক্ত দিনই প্রকৃত ঈদের দিন: ঈদ মানে আনন্দ, মুমিনের প্রকৃত আনন্দ অনূভূতি প্রসঙ্গে হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এরশাদ করেন, ১. যেদিন মুমীনের জীবন গুনাহ থেকে মুক্ত হবে সেদিনটি হবে তাঁর জন্য ঈদের দিন।
২. মু’মীন যেদিন ঈমান সহকারে মৃত্যু বরণ করবে, সেদিন হবে তাঁর প্রকৃত ঈদের দিন। (ফকীহ আবুল লাইস, আনোয়ারুল বয়ান, ৩য় খন্ড, পৃ: ১০২)
ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য ও শিক্ষা প্রসঙ্গে শাহেনশাহে বাগদাদ (র.) বর্ণনা করেন, আল্লাহর সৃষ্টিরাজি বলছে আগামীকাল ঈদ। কাল ঈদ, সকলেই খুশী আনন্দে বিভোর, কিন্তু আমার সমাপ্তি যেদিন ঈমানের উপর হবে সেদিনই আমার জন্য ঈদের দিন হিসেবে গন্য হবে। (আনোয়ারুল বয়ান, ৩য় খন্ড)
ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় সুন্নাত: ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ইসলামের প্রাচীনতম ঐতিহ্য ও ইসলামী সংস্কৃতির অংশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাহাবাগণ ঈদের দিন পারস্পরিক সাক্ষাতে বলতেন, “তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম” আল্লাহ আমাদের ও আপনাদের কবুল করুন।
মহান আল্লাহ জুমাতুল বিদার ওসীলায় আমাদের সিয়াম সাধনা কবুল করুন, আমাদের সকলকে কুরআনের বরকত দান করুন, মাহে রমজানের ওসীলায় করোনা ভাইরাসের মহামারী থেকে গোটা বিশ্ববাসীকে হিফাজত করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন
চন্দ্রঘোনা, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: সাদকাতুল ফিতর ঈদের পরে অন্য যে কোন সময়ে আদায় করা যাবে কিনা? সাদকাতুল ফিতর এর শরয়ী বিধান জানালে কৃতার্থ হব।
উত্তর: ইসলামী শরীয়তে সাদকাতুল ফিতর বছরের যে কোনো সময় আদায় করা জায়েজ। যখনই আদায় করা হয় আদায় হিসেবে গণ্য হবে। (বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ৯০)। তবে ঈদুল ফিতরের দিন সকালে ঈদের নামাযের পূর্বে আদায় করা উত্তম। নিসাব পরিমাণ অর্থ সম্পদের অধিকারী প্রত্যেক স্বাধীন সামর্থবান মুসলিম নর–নারীর উপর ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। ফিতরার ন্যূনতম পরিমাণ হলো, অর্ধ “সা” বা ২ কেজি ৫০ গ্রাম গম বা গমের আটা বা এর মূল্য সর্বসাকূল্যে ন্যূনতম ১২৫ টাকা দিতে পারবে। অমুসলিম ব্যক্তিকে ফিতরা প্রদান করা জায়েজ নেই। (দুররুল মোখতার, আলমগীরি, ১ম খন্ড, বাহারে শরীয়ত ৫ম খন্ড,)। যাদেরকে যাকাত দেয়া যায় তাদেরকে ফিতরাও দেয়া যাবে। যাদেরকে যাকাত দেয়া যায়না তাদেরকে ফিতরাও দেয়া যাবেনা। (রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ৯৫)