যোহরের নামাযের ফযীলত ও মাসায়েল
সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!
আল্লাহ তা’আলা কে ভয় করুন, তাঁর নির্দেশ মান্য করুন, তাঁর প্রিয় রাসূলের আনুগত্য করুন। মিরাজ রজনীর শ্রেষ্ঠ উপহার পঞ্জেগানা নামায কায়েম করুন। নামায আল্লাহর স্মরনের উৎকৃষ্ট মাধ্যম। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আমাকে স্মরনের জন্য তোমরা নামায কায়েম কর।” (২:১৪)
নি:সন্দেহে নামায এমন এক উত্তম ইবাদত, বান্দার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নামাযের মাধমে আল্লাহর স্মরণে নিয়োজিত হয়। আল্লাহর স্মরনই বান্দাকে প্রশংসিত ও সম্মানিত করে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আর নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ।” (২৯:৪৫)
আল্লাহর স্মরণেই হৃদয়ের প্রশান্তি: বিশ্বব্যাপী মানুষ আজ শান্তির জন্য হন্য হয়ে ঘুরছে, কোথাও শান্তি, স্বস্তি নেই। সর্বত্র, মানবতা আজ বিপন্ন, মিথ্যাচার, পাপাচার, শটতা, কপটতা, অনৈতিক কর্মকান্ডের সয়লাভে শান্তি, মুক্তি আজ সোনার হরিণ। একমাত্র আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ইসলামের শাশ্বত চিরন্তন বাণীর যথার্থ বাস্তবায়ন ও নূর নবীজির পদাঙ্ক অনুসরণে আল্লাহর স্মরণে রয়েছে মানবাত্মার প্রশান্তি। খোদাভীরু মুত্তাকী বান্দাদের কলব আল্লাহর যিকরে জাগ্রত হয়। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “জেনে রেখো! কেবল আল্লাহর স্মরণেই আত্মা প্রশান্তি লাভ করে।” (১৩:২৮)
বান্দার অন্তরে আল্লাহর স্মরণ সক্রীয় থাকে নামাযের মাধ্যমে।
আল কুরআনের আলোকে নামাযের নির্ধারিত সময়: ইসলামী শরীয়তে পঞ্জেগানা নামাযের জন্য রয়েছে নির্ধারিত সময় সূচি। নামায আদায়ে সময় সূচির প্রতিপালন অপরিহার্য। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “সালাত কায়েম কর, নিশ্চয় নির্ধারিত সময়ে সালাত কায়েম করা মু’মিনদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। (২৪:১০৩)
যোহরের নামাযের সময়ের নির্দেশনা রয়েছে, পবিত্র আল কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “অতএব আপনি তাদের এ সব উক্তিতে ধৈর্য ধারণ করুন। আর নিজ প্রভূর পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করতে থাকুন। সূর্যোদয়ও সূর্যাস্তের পূর্বে (অর্থাৎ ফজর এবং যোহর ও আসরের নামায এবং রাত্রিকালেও অর্থাৎ মাগরিব ও এশার নামায তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করুন। আর সব (ফরজ) নামাযের পরও (৫০:৩৯-৪০)
হাদীস শরীফের আলোকে যোহরের নামাযের ওয়াক্ত: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন গরমের তীব্রতা বেড়ে যায় তখন তোমরা যোহরের নামায দেরীতে আদায় করবে। কেননা গরমের প্রখরতা জাহান্নামের উত্তাপ থেকে সৃষ্টি হয়। (ইবনে মাযাহ, ১ম খন্ড, হাদীস : ৬৭৮)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহরের নামায পড়ার সময় সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে, হযরত জাবির ইবন সামুরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পশ্চিমাকাশে সূর্য ঢলে পড়ার পর যোহরের নামায আদায় করতেন। (ইবনে মাযাহ, ১ম খন্ড, হাদীস: ৬৭৩)
মাসআলা: দ্বিপ্রহরে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ার সাথে সাথেই যোহরের ওয়াক্ত শুরু হয়, ইমাম আবু হানিফা (র.)’র মতানুসারে প্রত্যেক বস্তুর ছায়া তার মূল ছায়া ব্যতীত দ্বিগুণ না হওয়া পর্যন্ত যোহরের সময় অবশিষ্ট থাকে। (ফাত্ওয়া-এ রজভীয়্যাহ, খন্ড: ২, পৃ: ২১০)
যোহরের রাকা’আত সংখ্যা: চার রাকা’আত ফরজের পূর্বে চার রাকা’আত সুন্নাতে মুআক্কাদাহ ও ফরজের পর দুই রাকাআত সুন্নাতসহ দু’রাকা’আত নফল মোট ১২ রাকা’আত। (নূরুল ইযাহ, পৃ: ১১২)
ফরজের পূর্বে চার রাকাআত সুন্নাতে মুআক্কাদার ফযীলত: হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি যোহরের প্রথম চার রাকা’আত পড়লো সে যেন চার রাকাআত তাহাজ্জুদ আদায় করলো। (তাবরানী শরীফ)
পাঁচ ওয়াক্ত নামায উম্মতে মোহাম্মদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৈশিষ্ট্য: পূর্ববর্তী নবীগণ তাঁদের প্রতি মহান আল্লাহর প্রদত্ত নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে বিভিন্ন সময় যে নামায আদায় করেছেন তা সমষ্টিগতভাবে মহান আল্লাহ উম্মতে মোহাম্মদীকে দান করেছেন, পূর্ববর্তী নবীগনের শরীয়তে সমষ্টিগতভাবে পাঁচওয়াক্ত নামাযের বিধান ছিলনা এটা নবীজিকে প্রদত্ত মিরাজের অনন্য উপহার, নবীজির উম্মতদের শ্রেষ্ঠত্বের দলীল। উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, ফজরের নামাযের সময় হযরত আদম (আ:)’র তাওবা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়, তিনি শুকরিয়া স্বরূপ দুই রাকাত নামায আদায় করেন এটা হল ফজরের নামায। হযরত ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক যোহরের সময় হযরত ইসমাঈল (আ.) কে কুরবানীর উদ্দ্যেশে আল্লাহর দরবারে উৎসর্গ করার পর তা কবুল হলে শুকরিয়া হিসেবে চার রাকা’আত নামায আদায় করেন, এটা হলো যোহরের নামায। আল্লাহ তা’আলা স্বীয় কুদরত প্রমানের জন্য হযরত উয়ারর (আ:) কে একশ বছর পর পূনরায় জীবিত করা হলে হযরত উযাইর (আ:) তার শুকরিয়া হিসেবে চার রাকাআত নামায আদায় করেন তা হল আসরের নামায। মাগরিবের সময় হযরত দাউদ (আ:) কে ক্ষমা করা হলো তিনি আল্লাহর শুকরিয়া হিসেবে তিন রাকা’আত নামায আদায় করেন, এটা হল মাগরীবের নামায। আমাদের নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্ব প্রথম এশার নামায আদায় করেছেন। (তাহাবী শরীফ)
পাঁচ ওয়াক্ত নামায আস্বীকারকারী ব্যক্তি সর্বসম্মতভাবে কাফির ও মুরতাদ হিসেবে গন্য। ইচ্ছাকৃত নামায ত্যাগ করা কবীরা গুনাহ। (ফিকহর কিতাব সমূহ দ্রষ্টব্য)
আরাফের ময়দানে যোহর ও আসর নামায যোহরের সময় পড়ে নিবে: ওয়াক্ত অনুযায়ী নামায পড়া ফরজ। তবে আরাফাত ও মুযদালিফার হুমুক ব্যতিক্রম। আরফাতের ময়দানে যোহর ও আসর, যোহরের সময় পড়ে নিবে। মযদালিফায় মাগরিব ও এশা নামায এশার সময় পড়ে নিবে। (বাহারে শরীয়ত, ৩য় খন্ড, পৃ: ১৩১)
মাসআলা: শীতকালে যোহরের নামায তাড়াতড়ি পড়া মুস্তাহাব। গ্রীষ্মকালে দেরী করা মুস্তাহাব। একা পড়ুক বা জামাত সহকারে পড়ুক।
মাসআলা: আরাফাতের যেখানে যোহর, আসর একত্রে পড়া হয়, তার মধ্যে বা তার পর সর্বপ্রকার সুন্নাত নফল মাকরূহ।
যোহরের শেষের দু’রাকা’আত নফলের ফযীলত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি যোহরের (ফরজের) পূর্বের চার রাকা’আত এবং যোহরের পরের চার রাকা’তের প্রতি যত্নবান হবে আল্লাহ তা’আলা তার উপর (জাহান্নামের) আগুন হারাম করে দেবেন। (সুনানে নাসাঈ, হাদীস ১৮১৭, পৃ: ২২০৭)
আল্লামা শামী (রা.) বলেন, তাঁর জন্য সুসংবাদ হলো তাঁর শেষ পরিণাম সৌভাগ্যের সাথে অর্থাৎ ঈমানের সাথে) মৃত্যু হবে। সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। (শামী, খন্ড: ২য়, পৃ: ৪৫২)
নফল সালাত ফরজ সালাতের পরিপূরক হবে: হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন বান্দার আমল থেকে সর্ব প্রথম সালাত সম্পর্কে হিসাব নেয়া হবে। তার সালাত যদি সঠিক হয় সে সফলতা লাভ করবে। আর সালাত যদি বিনষ্ট হয়, সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফরজ নামাযের হিসেবে যদি কিছু ত্রুটি হয়। তখন আল্লাহ তা’আলা বলবেন, তোমরা দেখো! আমার বান্দার কোনো নফল বন্দেগী আছে কি না? যদি থাকে তাহলে এর দ্বারা ফরজের ত্রুটি পূর্ণ করো, পরে তার অন্যান্য সব আমলের ব্যাপারে অনুরূপভাবে ঘাটতি পূরণ করা হবে। (আবু দাউদ শরীফ, হাদীস: ৮৬৬, মিশকাত শরীফ, হাদীস: ১৩৩০)
মাসআলা: নামাযরত অবস্থায় কুরআন শরীফ থেকে আয়াত কিংবা কোন কাগজ থেকে বা লিখিত স্থান হতে দেখে তিলাওয়াত করা এবং নামাযের মধ্যে ইচ্ছাকৃত ভাবে দেখা বা ইচ্ছাকৃত ভাবে দেখে পড়া মাকরূহ। (আলমগীরি, খন্ড:১ম, পৃ: ১০১)
হযরত ওমর (রা.) কর্তৃক নামায প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রশাসনিক নির্দেশ জারী: হযরত ওমর (রা.) প্রশাসনিক দায়িত্ব লাভের পর সরকারী কর্মকর্তাদের প্রতি নামায প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে লিখিতভাবে নির্দেশ জারী করেন, হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) তাঁর কর্মকর্তাদের প্রতি এ মর্মে লিখিত নির্দেশ পাঠান যে, তোমাদের যাবতীয় কাজের মধ্যে আমার নিকট সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, নামায কায়েম করা। যে ব্যক্তি নামায সংরক্ষণ করল সে দ্বীনকে সংরক্ষণ করলো, আর যে ব্যক্তি নামায বিনষ্ট করে সে নামায ছাড়াও অন্যান্য সবকর্মও অধিক বিনষ্টকারী। (মুয়াত্তা মালিক)
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায যথাযথ ভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম।
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ সিরাজউদ্ দৌলা চৌধুরী
নজুমিঞা হাট, বুড়িশ্চর, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: অনেক সময় মানুষ পায়খানা প্রস্রাবের প্রবল বেগ নিয়ে নামায আদায় করে এ ব্যাপারে শরীয়ত কি বলে? জানালে উপকৃত হব।
উত্তর: পায়খানা প্রস্রাবের গতি প্রবল হলে নামায পড়া শরীয়ত অনুমোদন করেনা। পায়খানা প্রস্রাবের গতিবেগ নিয়ে তাড়াহুড়া করে নামায পড়া এভাবে বায়ু নির্গত হওয়ার প্রবল বেগ নিয়ে নামায পড়া মাকরূহ তাহরীমি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আরকাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, যখন জামাত কায়েম হয়ে যায়। এবং কারো পায়খানা প্রস্রাবে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। প্রথমে পায়খানায় যাবে। (তিরমিযী, আবু দাউদ)
নামায শুরু করার পূর্বে যদি পায়খানা প্রস্রাবের প্রবলতা বৃদ্ধি পায় এসময় নামায শুরু করা নিষিদ্ধ ও গুনাহ। যদিও জামাত শেষ হয়ে যায়। প্রথমে হাজত সেরে নিবে আর যদি দেখা যায় হাজত সেরে অযু করতে গেলে নামাযের ওয়াক্ত চলে যাবে। এমতাবস্থায় সময়ের বিবেচনা করে নামায আগে পড়ে নেবে। আর যদি নামাযরত অবস্থায় পায়খানা প্রস্রাবের গতি বেগের প্রবলতা সৃষ্টি হয় নামাযের সময় থাকে তখন নামায ভেঙে ফেলা ওয়াজিব। আর যদি নামায না ভেঙে সে অবস্থায় পড়ে নেয় গুনাহগার হবে। (রদ্দুল মোখতার, বাহারে শরীয়ত, খন্ড:৩য়, পৃ: ২৬৬)