সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের অর্থাৎ সৈয়দ, শেখ, মুঘল এবং আরব পাঠান, তুর্কী, ইরানী এবং আফগানি বংশোদ্ভত। বিদ্যমান প্রাচীন ও বর্তমান রীতি অনুযায়ী তাদের মতে সবচেয়ে উত্তম ও সম্মানজনক পেশা হলো কলম ও তরবারির মাধ্যমে আয়, এবং ভূ–সম্পত্তি ও অন্যান্য সম্পদ থেকে আসা আয়। এই দুটো পেশা ছাড়া বাকি সব পেশা যেমন হস্তশিল্প ও দোকানদারি করা তাদের মর্যাদা ও অবস্থানের জন্য মানহানিকর মনে করা হতো। অধিকন্ত, তাঁদের মানমর্যাদার বিষয় মাথায় রেখে জমিজমা চাষাবাদ ও ফসল ফলানোকেও অনুমোদন করতো না তারা। নিজ হাতে চাষাবাদ নিষিদ্ধ থাকায় তারা ভাড়া করা শ্রমিক দিয়ে চাষাবাদ ও ফসল তোলার কাজ করতেন। এই নিয়মের ব্যতায় হলে তাকে পুরো শ্রেণি হেয় করতো এবং উক্ত ব্যক্তি অন্যদের সুনজরে থাকতেন না।
এই সব আচার শুধু মুসলমানদের মধ্যে চালু ছিল তা নয়। উচ্চ বংশীয় হিন্দুদের মধ্যেও এই প্রথা চালু ছিল। আগে কোনো রাজপুত তরবারি হাতে নেওয়া ছাড়া আর কোন পেশায় নিয়োজিত হতে পারতো না এবং একইভাবে কোনো ব্রাহ্মণ ধর্মীয় কার্যাদি পালন ছাড়া আর কোনো কাজে নিয়োজিত হতে পারতেন না। কিন্তু, সময় বদলেছে। সাথে পুরনো রীতি ও আচারও। রাজপুতরা তাদেরকে বেধে দেওয়া বর্ণপ্রথা ভেঙে অনেক দূর এগিয়েছেন। শুধু একটা বাধা পেশা ছেড়ে তারা বিভিন্ন কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি নিজ হাতে চাষাবাদও। ব্রাহ্মণরা একই পন্থা অবলম্বন করতো। ধর্মীয় দায়িত্ব পালন ছাড়াও তাঁরা বহুবিধ কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েন। নিজ হাতে লাঙ্গল চালানো ছাড়া বাকি সব কৃষিকাজে তারা অংশগ্রহণ করতেন। এভাবে কৃষি ও ভূ–সম্পত্তি থেকে আদায়কৃত অর্থ দিয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করতেন।
আগেকার দিনে সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের আয়ের বা জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম ছিলো সামরিক ও বেসামরিক চাকরি ও ভূমি থেকে প্রাপ্ত আয়। কিন্তু, যখন এই মাধ্যমগুলোতে তারা ব্যর্থ হলেন, বাধ্য হয়ে অন্যান্য শিল্প ও পেশার দিকে ধাবিত হন। বিভিন্ন প্রকার চাকুরিতে যোগদান করা ও কৃষি কাজকে তারা পেশা হিসেবে বেছে নেন। সৈনিকরা সামরিক খাতে কাজ না পেয়ে বিশেষ করে কৃষি কাজে নিয়োজিত হন। একমাত্র এই পেশাকে তারা নিজেদের মেজাজ ও মর্জির সাথে উপযুক্ত মনে করতেন। কিন্তু, অভিজাত মুসলমান ও হিন্দুদের কাছে হস্তশিল্প ও কিছু কিছু কাজকে মারাত্মকভাবে অপমানকর মনে হতো। এবং যারাই এইসব কাজে নিয়োজিত হতেন তাদের সামাজিক অবস্থান অবনত হতো এবং অন্যরা তাদেরকে হেয় চোখে দেখতো। আগেকার দিনে অভিজাত মুসলমান জনগোষ্ঠী ব্যবসাকে সম্মানজনক পেশা মনে করতেন না। এর ফলশ্রুতিতে এদেশে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের মধ্যে মুসলমান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। হিন্দুস্থানের যেকোনো অঞ্চলে কোনো মুসলমান ব্যবসায়ী বা দোকানদারের খোঁজ পেলে বুঝতে পারবেন তারা ধর্মান্তরিত মুসলমান। ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পরেও তারা পূর্বপুরুষের পেশা ছাড়েননি। এবং নিজেদের ছেলেমেয়েদেরকেও একই পেশায় যেতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
যদি সৈয়দ, শেখ, পাঠান ও মুঘল বংশের কোনো মুসলমানকে ব্যবসা করতে দেখা যায়, যা খুবই ব্যতিক্রম, তাহলে বুঝতে হবে তাঁর পূর্বপুরুষরা উপরেল্লিখিত চারটি প্রাচীন মুসলমান পরিবারের সদস্য ছিলেন না। আর যদিও একান্ত কাউকে খুঁজে পাওয়া যার বংশধরেরা প্রাচীন মুসলমান পরিবারের উত্তরসূরী ছিলেন, তাহলে ধরে নিতে হবে তাঁর পূর্বপুরুষের কেউ এই কাজে জরুরি কোনো প্রয়োজনে জড়িয়েছিলেন। মুসলমানদের মধ্যে অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোকজন তাঁদের পূর্বপুরুষের পেশার ধারা বজায় রেখে যাওয়ার ক্ষেত্রে খুবই দৃঢ়চেতা ও অনড় ছিলেন। পূর্বপুরুষের দেখানো পথ অনুসরণ করতে গিয়ে, ব্যবসা বাণিজ্যে নিয়োজিত হতে না পেরে শেষতক দারিদ্র্য ও দৈন্যের শিকার হয়েছেন।
ব্যবসা বাণিজ্যের তুলনায় সরকারি চাকরির ক্ষেত্র ছিল অনেকটা সংকুচিত। অধিকন্তু, আয় রোজগারের দিক থেকে চাকরির তুলনায় ব্যবসা বাণিজ্যের আওতা ছিলো অনেকটা প্রসারিত। জমির পরিমাণও অনেকটা সীমিত ছিল। কৃষি থেকে প্রাপ্ত আয় বা সম্পদ ব্যবসা বাণিজ্যের তুলনায় ছিল অপ্রতুল। সব পেশার মধ্যে ব্যবসার ক্ষেত্র বা আওতা ছিল প্রসারিত। ব্যবসা থেকে আয় বরকত ছিল সীমাহীন। ব্যবসা বাণিজ্য ছাড়া কোনো জাতি ধন সম্পদে স্বনির্ভর হতে পারে না। ব্যবসা বা বাণিজ্যে অগ্রসর জাতিসমূহ সবচেয়ে ধনবান ও সম্পদশালী। যারা ব্যবসা বাণিজ্য থেকে নিজেদের বঞ্চিত করেন, তাঁরা আসলে নিজেদের ভাগ্য বঞ্চিত করেন।
ব্রাহ্মণ ও রাজপুতরাও মুসলমানদের ন্যায় একই কারণে আর্থিক দৈন্যের শিকার। অন্যদিকে, ইহুদিরা, যারা জাতি হিসেবে নিজস্ব কোনো ভূমির অধিকারী নয়, ধনসম্পদ ও আর্থিকভাবে তাঁরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতি তাঁদের একাগ্রতা ও নিষ্ঠার কারণে।
আমাদের সমধর্মীরা, যদিও পুরোদমে ব্যবসা বাণিজ্যকে অস্বীকার করেননি, কিন্তু দোকানদারি ও খুচরা ব্যবসাকে তুচ্ছ ও দায়িত্বহীন পেশা মনে করতেন। কিন্তু, এটা মনে রাখা উচিত পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া রাতারাতি বড় ও সফল ব্যবসায়ী হওয়া যায় না। বিশেষ করে পূর্বে দোকানদারি বা ব্যবসার অভিজ্ঞতা না থাকলে। বাস্তবে, যেকোনো শিল্প বা কর্মে মানুষ ধীরে ধীরে দক্ষতা অর্জন করে যা পরবর্তীতে লাভের মুখ দেখায়। প্রথমত, আমাদের এমন কোনো সম্পদের পাহাড় নেই যা বিনিয়োগ করে দ্রুতসময়ের মধ্যে বিশাল ব্যবসায়ী বনে যাব। দ্বিতীয়ত, ব্যবসা বাণিজ্য থেকে আমরা লাভ করতে চাই এবং ক্ষতি চাই না ব্যবসায়ের গতি প্রকৃতি না শেখার আগেই। এই ব্যাপারটা এমন যে, ধরুন একজন বালক স্কুলে না পড়ে ঘটনাক্রমে সে একজন অধ্যাপক হতে পারে না। বর্তমান আর অতীতের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। আগে মানুষের মর্যাদা ও সম্মান নির্ভর করতো ব্যক্তিগত মেধা ও যোগ্যতার উপর যার সাথে ধন সম্পদের তেমন কোনো যোগসূত্র নেই। কিন্তু, বর্তমানে বিষয়টা সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র ধারণ করেছে। টাকাই সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে এখন। তাছাড়া ব্যবহারিক বিজ্ঞান বা কলার যে কোনো বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে আর্থিক সচ্ছলতা জরুরি। বর্তমানে সকল বিবেচনা ও খ্যাতি আসে ধনদৌলতের মালিকানার উপর ভিত্তি করে। ধন সম্পদের কাছে অন্যান্য যোগ্যতার মূল্য নেই তেমন। এমনকি একজন মানুষের বংশমর্যাদা ও ব্যক্তিগত দক্ষতাও ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে টাকা ছাড়া। বর্তমান পরিস্থিতি যাই হোক না কেন পুরনো ধ্যান ধারণা নিয়ে জীবন ধারণ করা আসলেই বোকামো। মানুষ হিসেবে সময়ের ডাকে আপনাকে সাড়া দিতে হবে এবং পরিবর্তন মেনে নেওয়া ছাড়া সামনে এগুনো অসম্ভব। পূর্ব পুরুষের ধ্যান ধারণা ও বিবেচনাবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আমাদের মনে রাখা উচিত বর্তমান সময়ে আমাদের বাপ দাদা বেঁচে থাকলে সময়ের প্রয়োজনে নিজের মান মর্যাদা রক্ষায় সঠিক সিদ্ধান্তটাই নিতেন। কারণ এটা স্বাভাবিক যে জ্ঞানী ব্যক্তিরা সকল পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারেন। পৃথিবী নিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে। যেহেতু পৃথিবী নিয়তই পরিবর্তন হচ্ছে আমাদেরও উচিত সেই অনুসারে জীবনধারণের পন্থা পরিবর্তন করা। প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সহিত ব্যক্তি মানুষের উচিত জীবনধারণের গতি প্রকৃতি ঠিক করা। অবশ্যই তা সময়ের দাবি মেনে।
মুসলমানদের সংস্কার নিয়ে উপরে বর্ণিত আলোচনার সূত্র ধরে বলা যায় এই অঞ্চলের মুসলমান বা হিন্দু কেউ কাউকে অনুকরণ করে পেশা নির্বাচন করেছেন তা নয়। এশিয়াটিক জাতিগুলোর মধ্যে পারস্পরিক রীতিনীতি ও সংস্কারের সাদৃশ্য স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান।
মুসলমানদের মধ্যে যারা সামাজিকভাবে নিচু শ্রেণির বা মর্যাদার তারা বিভিন্ন পেশা ও ব্যবসা বাণিজ্যে নিয়োজিত ছিলেন। তারা বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত, এবং প্রত্যেকটা শ্রেণি আলাদাভাবে আখ্যায়িত, তাদের পেশা ও বাণিজ্যিক পরিচয়ের ভিত্তিতে। এই শ্রেণিসমূহের উৎপত্তি মূলত দুই ভাবে। বিদেশী মুসলমানদের ঔরসে জন্ম এবং স্থানীয় বিভিন্ন গোত্র ও বর্ণের ঔরসজাত। প্রত্যেক শ্রেণি প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজেদের পূর্বপুরুষের পেশা আকড়ে ধরেছিলেন। এবং তাদের পেশা বা কর্মের ধরণ বলে দেয় তারা কোন গোত্র বা বংশের উত্তরসূরী।
কিন্তু মুসলমানরা হিন্দুদের মতো কম মর্যাদার ও নোংরা কাজকর্ম করতো না। কারণ বাংলার কোথাও কোনো মুসলমান ঝাড়ুদার বা হরিজনের অস্তিত্ব নেই। এ থেকে বুঝা যায় মুসলমানদের মধ্যে সামাজিকভাবে নীচু শ্রেণির লোকজনও নীচু জাতের হিন্দুদের উত্তরসূরী নয়। সৌদি আরব ও ইরান প্রভৃতি দেশে কোন হরিজন বা নৈশপ্রহরী পেশার লোকজন নেই তাই এদেশের মুসলমানরাও সেইসব কর্মকে জীবিকার মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়নি।
যদিও অতীতে সামাজিকভাবে উঁচু শ্রেণির মুসলমানদের কাছে কায়িক শ্রম সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা ছিল, কিন্তু কিছু কিছু শিল্পের প্রতি তাদের একটা ইতিবাচক ধারণা ছিল। এবং সেই সব শিল্পে পারদর্শীতাকে অর্জন হিসেবে দেখা হতো। যেমন, সেলাই ও সুই–সুতোর কাজ সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত পরিবারের নারীরা প্রায়ই করতেন। এই শিল্প দরিদ্র নারীদের জীবিকার সন্ধান দিয়েছে, এবং সম্ভ্রান্ত নারীদের জন্য আলস্য কাটিয়ে অবসর কাটানোর মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। এভাবে এই শিল্প সকল শ্রেণির নারীদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এবং এই কাজে দক্ষতাকে নারীদের জন্য একটা অর্জন হিসেবে বিবেচিত হতো। এই কাজে তৈরি করা পণ্য তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বিক্রি করে আয় করাকে তাঁরা সম্মানজনক মাধ্যম হিসেবে দেখতেন। এইসব পেশা শুধু নারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। ধার্মিক মানুষজনও এটাকে উপার্জনের হালাল মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইতিহাসে আছে রাজাধিরাজদের অনেকেই রাজকোষ থেকে খরচের সুবিধা বা ব্যবস্থা সত্ত্বেও তাঁরা নিজেদের খরচের জন্য এই ধরণের কর্মকে বেছে নিতেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল টুপি সেলাই ও বিক্রি করা। [খন্দকার ফজলে রাব্বী রচিত দি অরিজিন অব দি মুসলমান্স অব বেঙ্গল অবলম্বনে।]
লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক।