প্রতিদিনের মতোই সকালটা শুরু হয়েছিল ট্রাফিক পুলিশ কনস্টেবল মো. মনির হোসেনের। প্রিয় সাইকেলে চেপে এসেছিলেন ডিউটিতে। রাস্তার পাশে সাইকেল রেখে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এই সাইকেলে চেপে কাছের মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন। দায়িত্ব শেষে ফিরে যেতেন স্বজনদের কাছে। ব্যতিক্রম হলো গতকাল। প্রিয়জনদের কাছে ফিরে গেলেন মনির সাদা কাফন গায়ে জড়িয়ে সহকর্মীদের কাঁধে চড়ে। নিজের জীবনের বিনিময়ে জীবন বাঁচালেন তিনি।
সিএমপি কমিশনার সালেহ্ মোহাম্মদ তানভীর মনিরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেন, পুলিশে যুক্ত হলো আরেকটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। যিনি পুলিশের কর্তব্যকে সর্বাগ্রে রেখে নিজের জীবনকে হাসি মুখে বিলিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ পুলিশ তার এ ত্যাগ, ভালোবাসা এবং কর্তব্য নিষ্ঠা চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
খুলশী ঝাউতলা রেল ক্রসিংয়ে এক পাশের নিরাপত্তা ব্যারিয়ার নামানো হয়েছে। অন্য পাশেরটা নামানো হয়নি। গেটম্যান আলমগীরের দেখা নেই। ট্রেন আসার আগেই রেললাইন অতিক্রম করতে উঠে পড়ে একটি ম্যাঙ্মিা ও সিএনজি টেক্সি। গাড়ি দুটিকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় বাস। ষোলশহর থেকে ছেড়ে আসা ডেমু ট্রেনটিও ক্রসিংয়ের দিকে ধেয়ে আসছে।
এ সময় রেল ক্রসিংয়ের পূর্ব দিকের সড়কে দায়িত্ব পালন করছিলেন সিএমপি উত্তর বিভাগের ট্রাফিক পুলিশ কনস্টেবল মনির হোসেন। বিপদ আঁচ করতে পেরে আটকে থাকা যানবাহনগুলো সরিয়ে দিতে ছুটে যান তিনি। তিনি রেললাইনের ওপর কাজও শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু চোখের পলকে ট্রেনের ধাক্কায় সব লণ্ডভণ্ড।
ঝাউতলা রেল ক্রসিং এলাকায় মনিরের ঠিক উল্টো পাশে দায়িত্ব পালন করছিলেন আরেক ট্রাফিক কনস্টেবল মো. আলী। তিনি আজাদীকে বলেন, ডেমু ট্রেন আসার সময় দ্রুত পার হতে গিয়ে বাস, সিএনজি টেঙি ও ম্যাঙ্মিা রেললাইনে উঠে যায়। এই পরিস্থিতিতে যানবাহনগুলো সরাতে দ্রুত ছুটে যান মনির ভাই। ট্রেনটি স্থান অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে সার্জেন্ট স্যারের সহায়তায় আমরা রক্তাক্ত মনির ভাইকে মেডিকেলে নিয়ে আসি। কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারিনি।
নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার খোয়াজপুর গ্রামের কেবিএম ফয়েজ হোসেনের ছেলে কনস্টেবল মনির হোসেন (৪৫)। নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন চন্দ্রনগর এলাকায় সপরিবারে বসবাস করতেন। ২৫ বছরের কর্মজীবনে কখনো শাস্তির মুখোমুখি হননি তিনি। বিভিন্ন সময় পেয়েছেন ৪৯টি পুরস্কার।
গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে বিলাপ করছিলেন তার বড় মেয়ে মাহমুদা ফেরদৌস লিমা ও মেঝ মেয়ে বিবি ফাতেমা। এ সময় লিমা বলেন, বাবা ছাড়া আমরা কীভাবে থাকব? বাবা আমাদের শাসন করতেন, আবার আদরও করতেন। বাবা ছাড়া আমরা অসহায়।
মেঝ মেয়ে বিবি ফাতেমা বলেন, বাবা মারা গেছেন। কে আমাদের দায়িত্ব নেবে? আমার বাবার কী দোষ ছিল? আল্লাহ, আমার আব্বুর সব পাপ মাফ করে দিন, তাকে জান্নাত দিন।
মনিরের মরদেহ ময়না তদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে যাওয়ার সময় তার স্ত্রী সেলিনা আক্তার জরুরি বিভাগের পুলিশ বক্সে বসে কান্নাকাটি করছিলেন। তিনি বলেন, উনার মতো একজন ভালো মানুষকে আল্লাহ কেন এভাবে নিয়ে গেলেন? এখন আমাদের কী হবে? আমার সন্তানদের কে দেখবে?
মনিরের বড় মেয়ের জামাতা আবু সালেহ বলেন, আমার শ্বশুরের সব স্বপ্ন ছিল ছোট ছেলেকে ঘিরে। ও ক্লাস ফোরে পড়ে। স্বপ্ন ছিল তাকে পুলিশ অফিসার বানাবেন। কিন্তু সে সময়টা আর পেলেন না।
সিএমপির তথ্য মতে, কনস্টেবল মনির হোসেন ১৯৭৭ সালের ১৫ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালের ৮ জুন তিনি পুলিশে যোগ দেন। ২০১৩ সালের ১৭ জুন সিএমপিতে যোগ দেন। ২০১৯ সালের ৮ জুন ট্রাফিক উত্তরে যোগ দেন। ময়না তদন্ত শেষে তার লাশ গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নেয়া হয়। সেখানেই নামাজে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়েছে।












