কক্সবাজারের জীবন জীবিকার অন্যতম জলধারা বাঁকখালী নদী। এটি জেলার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বারোমাসী জলধারা। কক্সবাজারের দুই উপজেলা ও পার্বত্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা ও আনন্দ বেদনার ইতিহাস জড়িয়ে আছে বাঁকখালীকে ঘিরে। এ নদীতীরেই গড়ে ওঠেছে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তম শহর কক্সবাজার ও রামু উপজেলা সদর। এক সময় আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দর হিসেবেও ব্যবহৃত হত এ নদীর মোহনা।
বাঁকখালী নদীটি উৎপন্ন হয়েছে চট্টগ্রাম ও আরাকান অঞ্চলকে বিভক্তকারী পর্বতমালা থেকে, এরপর নদীটি উত্তরমুখী প্রবাহিত হয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। নাইক্ষ্যংছড়ির দোছড়ি সীমান্তে নদীটি বাঁকখালী ঝিরি নামে পরিচিত। এরপর গিরিখাদের মধ্য দিয়ে বাঁকখালী কক্সবাজার জেলার রামুর গর্জনীয়া-কচ্ছপিয়ায় প্রবেশ করে। এখানে যুক্ত হয় গর্জই, দোছড়ি ও নাইক্ষ্যংছড়ি খাল। এরপর পশ্চিমমুখী বাঁক নিয়ে রামু সদর ও কক্সবাজার শহরের পাশ দিয়ে একেবেঁকে উত্তর-পশ্চিমমুখী হয়ে বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী চ্যানেলে পতিত হওয়ার আগে বাঁকখালীতে যুক্ত হয়েছে চেইন্দা ও পাতুয়া খালসহ আরো ছোট ছোট অনেক জলধারা। বাঁকখালী নদীর মোট দৈর্ঘ্য ১০৫ কিলোমিটার। তবে বাংলাদেশ অংশে এর দৈর্ঘ্য ৬৭ কিমি। আরাকান থেকে উৎপন্ন হয়ে বান্দরবানের মধ্য দিয়ে নদীটি কক্সবাজারে প্রবেশ করলেও মাত্র ৪ বছর আগেই বান্দরবানের নদীর তালিকায় নাম ওঠেছে বাঁকখালীর। নদীটি মূলত কক্সবাজার সদর ও রামুর নিম্নাংশ পর্যন্তই জোয়ারভাটা প্রভাবিত। শুষ্ক মৌসুমে এর ঊর্ধ অববাহিকার জলধারা ক্ষীণ হয়ে আসে। মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ নদীর নিম্ন অববাহিকা পাহাড়ি ঢলে বন্যা কবলিত হয়, বিশেষত রামু ও কক্সবাজার এলাকার নিম্ন ভূমি। মিঠা পানির প্রবাহ আটকে রেখে শীতকালীন সেচের মাধ্যমে কৃষি আবাদের সুযোগ বৃদ্ধিতে মোহনার কাছাকাছি এ নদীতে বাংলাদেশের প্রথম রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়। শীতকালে বাঁকখালীর জলধারা কমে গেলে দুই তীরে জেগে ওঠা চরে ব্যাপক সবজির চাষ করা হয়। এতে হাজার হাজার কৃষকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়। কক্সবাজার জেলায় সবজি উৎপাদনে বিশাল অবদান রয়েছে বাঁকখালী নদী তীরের। আবার এ নদীর মিষ্টি পানিতে শুষ্ক মৌসুমে চাষ হচ্ছে হাজার হাজার একর জমি। নদীটির জোয়ারভাটা প্রভাবিত উপকূলীয় সমভূমি ব্যাপকভাবে লবণ ও মৎস্য চাষে ব্যবহৃত হয়। বাঁকখালীর নৌকা বাইচ স্থানীয়দের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এ নদীতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তাদের জাহাজ ভাসা উৎসব পালন করে। বাঁকখালী ৩৫ প্রকার মাছ এবং ১০ প্রজাতির চিংড়ির আবাসস্থল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। এছাড়া বঙ্গোপসাগরের ৪ শতাধিক সামুদ্রিক প্রাণির অধিকাংশই এ নদীর মোহনায় এসে ডিম ছাড়ে বলে জানান কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র প্রধান ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, বাঁকখালী কক্সবাজারের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে। অবদান রাখছে কক্সবাজারের জীববৈচিত্র্য রক্ষায়। বর্তমানে কক্সবাজার শহর ও খুরুশকুলের বাঁকখালী নদী তীরে বাইনসহ নানাজাতের ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ রয়েছে। তবে একসময় বাঁকখালী নদী তীর গোলপাতা ও কেওড়ার জন্য বিখ্যাত ছিল। বাঁকখালী নদীর মোহনা সমুদ্রগামী ট্রলারসমূহের পোতাশ্রয় হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে শত শত বছর ধরে। তবে প্রাচীনকালে এখানে আরব্য বণিকদের জাহাজ নোঙর করার ইতিহাসও রয়েছে। বৃটিশ আমলেও সাগরপথে কলকাতা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার- টেকনাফ-মংডু-আকিয়াব ও রেঙ্গুন রুটে স্টিমার চলাচল ছিল বলে জানান ‘কক্সবাজারের ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক মুহম্মদ নুরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে বাঁকখালী নদীতে কাঠের জেটি নির্মাণ করেছিল বৃটিশ নেভি। এতে তাদের যুদ্ধজাহাজও চলাচল করত। বৃটিশ আমলে বাঁকখালী ও বঙ্গোপসাগরের মাঝে বালুচরে গড়ে তোলা হয় সামরিক বিমান বন্দর, যেটি বর্তমানে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপ নিয়েছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাসের সাক্ষী এ নদী। হানাদাররা স্বাধীনতাকামীদের ধরে এনে বাঁকখালী তীরের ঠুইট্টাপাড়ায় বধ্যভূমিতে হত্যা করে পুঁতে ফেলতো। আবার কাউকে ভাসিয়ে দিতো নদীতে।
ইতিহাসবিদরা জানান, ১৭৮৪ সালের শেষদিকে বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) অধিপতি স্বাধীন আরাকানকে দখল করে নির্যাতন শুরু করলে হাজার হাজার শরণার্থী বাঁকখালী তীরবর্তী রামু ও কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স এদের পুনর্বাসন করেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের সমাধি বাঁকখালীর ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। আর ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের মৃত্যুর পর বাঁকখালী তীরের বাজারঘাটা নামক স্থানের ছোট্ট বাজারটি তার স্মৃতির উদ্দেশে কক্স সাহেবের বাজার নামে নামকরণ করা হয়। যেটি আজকের জেলা সদর ও দেশের সর্ববৃহৎ পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার।