আমি যখন মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র, তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘জীবন ও বৃক্ষ’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধ পাঠ্য ছিলো। বৃক্ষের সাথে মানবজীবনের সাদৃশ্য ছিলো এ প্রবন্ধের বর্ণনায়। মনে হওয়াতে জীবনের সাথে শুধু বৃক্ষের নয়, মানবসৃষ্ট বিশ্বাস, মতবাদ ও পরিবেশ ব্যবস্থার সম্পর্ক নির্ণয় ও বিষয়ের বিস্তার করবার চেষ্টা করবো।
মানুষ সাংস্কৃতিক জীব হিসেবে বিশ্বাসী ও মতবাদী। মানুষের জন্ম, বিকাশ ও মৃত্যু আছে। বৃক্ষেরও সৃষ্টি, বিকাশ ও লয় আছে। প্রাণ আছে উভয়েরই। বলা হয়, বৃক্ষেরও আছে আবেগ ও অনুভূতি, নেই সংস্কৃতি, বিশ্বাস। স্থির দাঁড়িয়ে থেকে জীবন কাটায়। মানুষ স্থান পরিবর্তন করতে পারে। আগেই বলেছি, মানুষ বিশ্বাসী। বিশ্বাসেরও সৃষ্টি বা উদ্ভব, বিকাশ ও লয় আছে। কোন বিশ্বাসই চিরস্থায়ী নয়। বিশ্বাস, মতবাদের উদ্ভব আছে, আছে বিকাশ ও শেষে লয়। বৃক্ষের শেকড় আছে। শেকড় মাটিতে। মাটি ফুঁড়ে অঙ্কুরোদগম হয়। ছিলো lithosphere এ, বিকশিত হয় atmisphere বা বায়ুমণ্ডলে। গাছ পানি ছাড়া বাঁচে না। তেমনি মানুষও। পানির অপর নাম জীবন। জীবের পানি দরকার। অর্থ হলো জীবের hydrosphere বা বারিমণ্ডলের প্রয়োজন। জীব নিজেই হলো, biosphere বা জীবমণ্ডলের অংশ। মজার ব্যাপার হলো, এই sphere বা মণ্ডলগুলোর সম্পর্কই হচ্ছে ecosystem বা পরিবেশ–ব্যবস্থা। মানুষ জীবমণ্ডলে Homo Sapiens বা বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হয়। তার বুদ্ধির ফল নিজেকে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রাণী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হওয়া। সমাজ ও এর অনুষঙ্গী হিসেবে রাষ্ট্র, সংঘ ও হাজারো সংগঠন, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি সৃষ্টি করেছে মানুষ। মানুষের সামর্থ্য তাকে সাংস্কৃতিক মণ্ডল তৈরি করতে সফল করেছে। এই মণ্ডলও অন্যান্য Sphere বা মণ্ডলগুলোকে প্রভাবিত করছে। পরিবেশ দূষণ বলতে আমরা যা বুঝি তা মূলত সাংস্কৃতিক মণ্ডলের ক্রিয়া বা Activity এর ফল।
বৃক্ষের জীবনের সাথে মানুষের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যতো আছেই। কিন্তু মানুষ যে সাংস্কৃতিক মণ্ডল তৈরি করেছে তার সাথে বৃক্ষের জীবনের সাদৃশ্য কেমন তাও ভেবে দেখবার বিষয়! মানুষ মত, পথ, বিশ্বাস সৃষ্টি করে এবং তা মানুষের জীবন ও লাইফ স্টাইলের নিয়ামক হয় ও এই মত ও মতাদর্শের সাথে বৃক্ষের জীবনের অপূর্ব মিল আছে ।
বৃক্ষ জন্মায় মৃত্তিকামণ্ডলে। বৃক্ষের শেকড় এখানেই। এক সময়ে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে বায়ুমণ্ডলে। বায়ুমণ্ডল বৃক্ষের জীবন ধারণের উপায়। মানুষেরও। তবে মানুষ তৈরি করেছে এক মণ্ডল–সাংস্কৃতিক মণ্ডল। আর এই মণ্ডলের সাথে তাকে খাপ খাইয়ে নিতে হয় আজীবন। আর এই খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া হচ্ছে, সামাজিকীকরণ। এই সামাজিকীকরণের মৌলিক দিক হলো মতাদর্শ ও ধর্মীয় মতের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া। মতাদর্শ স্থান, কাল ও পাত্রের পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত; বৃক্ষের বেড়ে ওঠার সাথে যা মিলে যায়।
বৃক্ষ মাটি ফুঁড়ে উঠার পরে, যদি তা লম্বাটে দীর্ঘকায় coniferous tree হয়ে, উপরে মোচাকৃতি আকারে শাখা–প্রশাখা গজাবে। ভূ–প্রকৃতির সাথে গাছের আকার ও বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হয়ে থাকে। একই আম, ভৌগলিক কারণে এর আকার ও ফলের স্বাদ ভিন্ন হয়ে থাকে। গাছ যেমনই হোক তা, শাখা–প্রশাখা গজাবে। মতাদর্শ ঠিক তেমনই। উদ্ভব হয়, সময়ের পরিক্রমায় শাখা–প্রশাখা গজায়। তবে বৃক্ষের শাখা–প্রশাখা গজানোর সাথে মতাদর্শের শাখার বৃদ্ধি বৃক্ষের মতো নয়। বৃক্ষের শাখা–প্রশাখা বৃক্ষের আদলেই হয়ে থাকে। শাখাকে কেটে মাটিতে পুঁতে রাখলে মনে হবে, মূল গাছেরই প্রতিরূপ আরেকটি গাছ। শাস্ত্রীর ভাষায় একে Fractal Geomentry এর প্রতিরূপ মনে করা হয়। বৃক্ষের শাখার মতন Branching বা শাখায়ন হয় মতাদর্শের, তবে এখানে সময় এক বড় ফ্যাক্টর। কোনে স্থানে, কোন সময়ে কোন মতাদর্শের সৃজন হলেও তা সময়ের সাথে সাথে মূল ধারণা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। একটা সময়ে মূল ধারণাটাই আর থাকে না। কোন মত বা মতাদর্শের নয়া আবির্ভাব হয়। আর এভাবেই মূল মতাদর্শের নামে হলেও মূল ধারণাটাই পরিবর্তন হয়ে যায় ।
মতাদর্শের শাখা , প্রশাখা সৃজনের আরেকটি কারণ হলো, মতাদর্শের জন্মস্থান থেকে দূরে গমন। যত দূরে যাবে মত, ততই শাখা–প্রশাখা গজাবেই। মুসলমানদের সৌদি আরব থেকে যত দূরে যাওয়া হবে, মতের শাখার বিস্তারও ঘটবে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার মুসলমানদের ধর্মমত এমন সাক্ষ্য দেয়।
গাছ আর মানুষ একই জীব মণ্ডলের অংশ হলেও, গাছ নিজেকে নিধন করে না, মানুষ করে। এর কারণ, মানুষ চিন্তা, মতাদর্শের ডালপালা গজিয়েছে, আর এর দ্বন্দ্ব, যুদ্ধাস্ত্র বানিয়ে নিধনের কাজটি করছে। গাছের ডালপালা প্রকৃতির সাথে সংগ্রামে গাছের প্রয়োজনে লাগে। বংশের বিস্তারও যদি ডালপালার বিস্তার হয়, সেখানেও দ্বন্দ্ব। কারণ সংস্কৃতি। মানুষ যে সাংস্কৃতিক জীব। কার বিশ্বাস, সংস্কৃতি শ্রেষ্ঠ, এই বিতর্কের কি শেষ আছে?
মানুষ যখন খাদ্য সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করতো, তখন গাছ ধ্বংস করতো না। গাছের পাতা, ছাল–বাকল, ফলমূল বেঁচে থাকবার জন্য প্রয়োজনীয় ছিলো। এছাড়া আয়ুর্বেদিক গুণের জন্যও গাছ কাটা হত না। গাছ আর মানুষের ভারসাম্য ছিলো। পার্থক্য ছিলো, মানুষ যাযাবর বা নোমাড জীবনে অভ্যস্ত ছিলো আর গাছ ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। সংস্কৃতির শাখা–প্রশাখার বিস্তৃতি, বিশদভাবে বললে প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানুষের গড় আয়ু বাড়িয়ে দেয়। মানুষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। মানুষের দরকার ঘর–বাড়ি, চাষের জন্য জমি। উপায় কী, গাছ কাটা। সেই যে শুরু হলো, এখনও চলছে। গাছ পরিবেশের দূষণ করে না। মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি প্রকৃতির মৃত্তিকা, বারি, বায়ু, জীব মণ্ডলকেকে ভারসাম্যহীন করে দিলো। জীবন যেমন জীবনকে ভোগ ও খাদ্যচক্রকে সচল রাখে আবার জীব জীবের বিনাশ করে প্রকৃতির সব স্বাভাবিক অবস্থাকে নষ্ট করে দেয়। ভেঙে দেয় জীববৈচিত্র্যকে আর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যেকে। গাছের সাথে মানুষের পার্থক্য এখানে। জীবন ও বৃক্ষ এখানে একরকম নয়।
বৃক্ষ মানুষের প্রতিপক্ষ নয়, মানুষ গাছের প্রতিপক্ষ। গাছ না কাটলে, সভ্যতা গড়ে উঠে না। তুন্দ্রা অঞ্চলে লগ কেবিন বানাতে গাছ লাগে। লাগে বাদযন্ত্রে। শিল্পচর্চা বন্ধ হয়ে যাবে গাছ না কাটলে। খাট–পালংতো আছেই। চিন্তা করুনতো, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদের ব্যবহার্য জিনিষ পত্রের কোন কোন ব্যবহারের জিনিষ কাঠের নয়?
শক্তি ও কাজ। আমরা জানি শক্তি প্রয়োগ করলেও কাজ নাও হতে পারে। কিন্তু আমাদের সভ্যতা শক্তি প্রয়োগে কাজের ফল। আমরা খাদ্য আহরণ করতাম গাছ–পালা, লতা–গুল্ম থেকে। এখন গাছের সংখ্যা কমিয়ে উৎপাদক হয়েছি। লতা–গুল্ম, শাক–সবজি, গাছের ফল খাই, আমরা তৃণভোজী প্রাণীও। আমরা যে ওমনিভোরাস বা সর্বভুক। গাছও উৎপাদক। সূর্যের তাপ শক্তিকে কাজে লাগায়। সালোক সংশ্লেষণ যাকে বলে। এখানে গাছও উৎপাদক। তবে এর জন্য উৎপাদনের উপায় হিসেবে জমি বা প্রযুক্তির দরকার হয় না।
খাদ্য শৃঙ্খলে গাছ হচ্ছে সর্বংসহা। মাংসাশীর মাংস আসে মূলত তৃণভোজী থেকে। লতা–গুল্ম, গাছ–পালা না থাকলে, খাদ্য শৃঙ্খলের কি হতো? মানুষ প্রজাতি না থাকলে, হয়তো খাদ্য–শৃঙ্খল সচল থাকতো। কিন্তু মানুষের প্রকৃতির উপর এ্যাকটিভিটি, খাদ্য–শৃঙ্খলটাকেও নষ্ট করে দিচ্ছে ।
গাছের সাথে মানুষের একটা বড় পার্থক্যও আছে। গাছ মূলত ন্যাচারাল সিলেকশনের উপর নির্ভরশীল। মরুভূমির গাছ, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় রোপণ করলে, ঐ এলাকার প্রকৃতি যদি গাছের টিকে থাকবার সিলেকশন না দেয় তাহলে তার টিকে থাকবার সম্ভাবনা নেই। মানুষ প্রযুক্তির সহায়তায়, বিরূপ প্রকৃতিকে বদলে, বেঁচে থাকার উপযোগী করে তুলতে পারে। যোগ্যতম বেঁচে থাকবার তত্ত্ব এখানে কার্যকর লক্ষ্য করা যায়। গাছ ও মানুষ জীবমণ্ডলের অংশ। এই মণ্ডলের ভাবসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। একে মেরামতের চেষ্টা চলছে। কিন্তু প্রকৃতির যে ডাইনামিক্স মানুষের প্রযুক্তি দিয়ে কি একে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা যাবে? ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বেঁচে থাকলে গাছ ও মানুষের ভারসাম্যহীন অবস্থা দেখে কী ভাবতেন? বৈসাদৃশ্যের কথা বলতেন?
লেখক: সমাজবিজ্ঞানী; উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি
অফ ফ্যাশন এন্ড টেকনোলজি, চট্টগ্রাম।