জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ অক্সিজেন

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি | রবিবার , ১১ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

অক্সিজেন, জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বায়বীয় একটি পদার্থ। দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। শুধু অনুভব করতে হয়। প্রাণবায়ু, বাতাসের উপাদান, পানির উপাদান। বাতাসের শতকরা প্রায় ২১% অক্সিজেন । পানির প্রতি একটি অণুতে একটি অঙিজেন থাকে। জ্বলতে সাহায্য করে। জ্বলে শক্তি উৎপন্ন করে।
মানুষসহ অন্যান্য স্থলজ প্রাণী, উদ্ভিদ, বাতাস থেকে অঙিজেন গ্রহণ করে শ্বসন প্রক্রিয়া সম্পাদন করে। জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ পানি থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে শ্বসন প্রক্রিয়া সম্পাদন করে।
বেঁচে থাকার জন্য, জৈবনিক প্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্য অক্সিজেন গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। এই অঙিজেন ফুসফুসে পরিশুদ্ধ হয়। রক্ত সংবহনের মধ্য দিয়ে কোষে চলে যায়। অঙিজেন রক্তের হিমোগ্লোবিনের সাথে অঙিহিমোগ্লোবিন যৌগ গঠন করে কোষে কোষে সংবাহিত হয়। কোষের স্থানান্তর প্রক্রিয়া শেষ করে কোষে সংগৃহীত কার্বন ডাই অঙাইড এবং অন্যান্য উচ্ছিষ্টের সাথে কার্বঙিহিমোগ্লোবিন হয়ে মানব ফুসফুসে ফেরত আসে।
এভাবেই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় জীবন পরিচালিত হয়, পরিবাহিত হয়, সংবাহিত হয়। পৃথিবীতে এই যে জীবনের চাষ, জীবনের চর্চা, জীবনের প্রক্রিয়া- সবকিছুই অঙিজেন নির্ভর। অক্সিজেনকে প্রাণবায়ু বলা হয়। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক মূলধন। এ মূলধনের সংরক্ষণ, পরিচর্যা, পরিবৃদ্ধি পৃথিবীর জীবন চর্চার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা বাতাসের অদৃশ্য সাগরে ডুবে আছি। আমাদের ভিতর বাতাসের অনুভব আছে। ব্যবহার আছে। পরিচর্যা কিংবা পরিশোধনের প্রক্রিয়া নেই। আমরা প্রাণীকুল বাতাস ছাড়া বাঁচতে পারি না এক মুহুর্ত। কারণ, বাতাস রক্তের পরিশুদ্ধি ঘটায় এবং রক্ত সংবহনের মাধ্যম দিয়ে জীবকোষকে জীবিত রাখে। জীবিত কোষের সমন্বয় জীবনের প্রবাহ সচল থাকে, অটুট থাকে, ধারাবাহিক থাকে।
বহুমাত্রিক প্রাণীর পৃথিবীতে উদ্ভিদ আছে, প্রাণী আছে, পানি আছে, মাটি আছে, কীটপতঙ্গ, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, অণুজীব, অনুপ্রাণসহ প্রাণের বিশাল বৈচিত্র্যময় সংগ্রহ আছে। সোমবার আছে। পৃথিবী একমাত্র গ্রহ, যেখানে সবুজ আছে। প্রাণের চাষ- চর্চা আছে। মাটি আছে। পানি আছে।
পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। মানুষের বৃদ্ধি এবং অন্যান্য কারণে পৃথিবীতে প্রাকৃতিক সম্পদ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক মূলধনের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে, পৃথিবী প্রায়ই এর ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু সংকট, বৈশ্বিক বিপর্যয়, প্রতিমুহূর্তে পৃথিবীর অসহনশীলতার বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
মানুষ পৃথিবী ছেড়ে অন্য গ্রহে বসবাসের চিন্তাও করছে। সবুজের সংকট পৃথিবীতে দারুণভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। সবুজ বিনাশী কর্মকাণ্ডে মানুষ পিছিয়ে থাকছে না। সবুজের শূন্যতার দিকে গমন পৃথিবীতে জীবনঘাতী কার্বন ডাই অঙাইড, কার্বন মনোঙাইডের মত গ্যাসের প্রবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। এখান থেকে উষ্ণায়নের বহুমাত্রিক রসায়ন তৈরি হচ্ছে।
পৃথিবী ক্রমেই একটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হচ্ছে। যে গ্যাস চেম্বারে জলবায়ু বিপর্যয়, উষ্ণায়নের অনুষঙ্গগুলোর প্রবৃদ্ধি ঘটছে। শুধু অক্সিজেন সংকটাপন্নতার অব্যাহত যাত্রা ধারাবাহিকভাবে সচল আছে। অঙিজেন প্রাণবায়ু। এর দ্বিতীয় বিকল্প নেই।
পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগ সাগর বেষ্টিত জলরাশি। এ জলেই আছে অক্সিজেন । সর্বজনীন প্রাণবায়ু। সাগর দূষিত হচ্ছে। পৃথিবীর আবর্জনা গ্রহণ করে, বাতাসের বহুমাত্রিক গ্যাস গ্রহণ করে সাগর অম্লীয় হচ্ছে। বিষাক্ত হচ্ছে। প্রাণী ও প্রানের অফুরন্ত ভান্ডার আর থাকছে না। আগামীতে মানব সভ্যতা টিকে থাকবে কিনা, তা সাগরের বিশুদ্ধতার উপর নির্ভর করছে বহুলাংশে।
বিগত প্রায় বারো মাস যাবত পৃথিবীতে, দেশে দেশে কভিড মহামারীতে বিপর্যস্ত মানুষের জীবন। মানুষ বেসামাল হয়ে গেছে জীবনকে সুরক্ষিত করতে। দেশে দেশে জীবনের আহাজারির সাথে বেঁচে থাকার সম্বল, পথ, প্রক্রিয়া, মাধ্যম সংকটাপন্ন। মানুষের দৈনন্দিন চলাচলের প্রক্রিয়া সীমিত হয়েছে। কোথাও কোথাও বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। মানুষ জীবনকে নিয়ে স্থবিরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার কিংবা রাষ্ট্রনায়কগণ পথ, প্রক্রিয়া, পদ্ধতি, প্রতিষেধক, প্রতিকার খুঁজতে খুঁজতে উদ্বেগ- উদ্বিগ্নতায় ভারাক্রান্ত।
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে জীবনঘাতি এ ব্যাধি দেশে দেশে বিপর্যয় ঘটিয়ে চলেছে। পরিবর্তিত রূপ নিয়ে, পরিবর্ধিত রূপ নিয়ে। মানুষের দিশাকে বিদিশায় পরিণত করে, জ্ঞান ও চর্চার বিভিন্ন পথ ও প্রক্রিয়াকে আমলে না নিয়ে।
দেশে দেশে জনজীবনের বিপর্যয় মানুষের সকল প্রকার অহংকারকে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে। বিদিশা গ্রস্থ জনপদ, জীবনকে সুরক্ষিত করতে সুপথ, সুনির্দেশনা, সুচিন্তা, সুসম জীবনাচারের পথনির্দেশ বেহাত হচ্ছে। অথবা সে পথ সাধারণ জীবনাচারের সাথে সংগতি রাখতে পারছে না। এটি কি মানুষের এযাবতকালের আচারিক মূল্য পরিশোধ? নাকি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হওয়ার পথনির্দেশ? মানুষকেই তা খোঁজে বের করতে হবে।
দেশে দেশে, গ্রামেগঞ্জে, শহরে- মফস্বলের, নগরে- বন্দরে, মানুষ এখন অঙিজেন শব্দটির সাথে সুপরিচিত। অক্সিজেন হীনতায় কে বাঁচিতে পারে, তা এখন মানুষ বোঝ।
অক্সিজেনের উৎস, অঙিজেনের পরিচর্যা, সংরক্ষণ, সংবহন এখন মানুষের চিন্তা- চেতনাকে নাড়া দেয়।
দেশে দেশে হাসপাতাল-ক্লিনিকে অঙিজেন সিলিন্ডার এখন মানুষের সুপরিচিত। অক্সিজেনের সংকটে মুহূর্তেই জীবন বিপন্ন হয়ে যায়। একথা এখন মানুষকে আর বোঝাতে হয় না। এই অক্সিজেনের সাথে যে বিশুদ্ধ বাতাসের সংযোগ আছে, অক্সিজেনের উৎপাদন কারখানা গাছপালার সম্পর্ক আছে, বিশুদ্ধ পানির সম্পর্ক আছে-তা এখন সবার জানা।
সম্পদ, সম্ভার, বিত্ত- বৈভব, স্বপ্ন- বাসনা, শিল্প- সমৃদ্ধি জীবনের অনুষঙ্গ। তবে অক্সিজেনের চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় নয়। সঙ্কটে, শঙ্কা ও সংশয়ে, বিপন্নতায়, বিপদে-আপদে, অর্থ অনর্থের কারণ হতে পারে। যে সম্পদ অর্থের বিনিময়ে সংগ্রহ করে জীবনকে বাঁচাতে পারে, সে সম্পদের প্রাকৃতিক উৎসকে নষ্ট করে বিপদাপন্ন হওয়া চরম আত্মঘাতি। এ পথে আমরা দীর্ঘ পথপরিক্রম করেছি। আমাদের বোধ- বিবেককে পিছনে রেখে আমরা পথ চলেছি। আমরা কুপমণ্ডুকতাকে জয় করেছি। সভ্যতাকে ধারণ করেছি। আমরা স্বপ্ন ভুবন গড়েছি। সুখ বিলাসে গা ভাসিয়েছি।
জীবনের বিভিন্ন প্রান্তে এসে আমরা হিসাব কষেছি, স্থায়ী সুখ, স্থায়ী সমৃদ্ধি, টেকসই নিরাপত্তা, নিশ্চিত হয়নি। প্রাকৃতিক মূলধন, জীবনের অনুষঙ্গ অঙিজেন প্রাপ্যতা আমাদের এযাবতকালের মূর্খতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। জীবনের চাষ ভিন্নতর পথে করে আমরা জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছি।
বিপদসংকুল পৃথিবী। বিপদাপন্ন দেশ- জনপদ, জনগণ। এ বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার হতে হবে। জীবনের দিকে নিবিড়ভাবে তাকাতে হবে। জীবনের প্রাকৃতিক অনুষঙ্গগুলোকে চর্চা করতে হবে। পানির বিশুদ্ধতার দিকে নজর দিতে হবে। বাতাসকে বিশুদ্ধ রাখার পথে চলতে হবে। সবুজের পরিচর্যা, পরিচর্চা, চাষ করতে হবে। প্রাণবায়ু অক্সিজেনসহ জীবনের নিবিড় অনুষঙ্গগুলোকে, প্রাকৃতিক মূলধনগুলোকে, জীবনের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য সুরক্ষিত- সংরক্ষিত করতে হবে।
এ পথেই প্রকৃতি ও জীবনের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আগামীর পথচলায় প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষায় জীবনকে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করা আমাদের জীবনাচারে, জীবন চর্চায় উদ্ভাসিত হোক। আমাদের ব্যক্তিগত সংরক্ষণতা এবং সুরক্ষায় জীবনের বিপর্যয়গুলো বিলীন হোক এই প্রত্যাশা করি।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক, কর্ণফুলী গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধআইসিটি-আউটসোর্সিংয়ে জরুরি সেবা চান উদ্যোক্তারা