মানসিক গঠনে মুখচোরা এবং লাজুক স্বভাবের জীবনানন্দ বেঁচে ছিলেন সাকুল্যে পঞ্চান্ন বছর। নাতিদীর্ঘ জীবনের শেষ বছরটি ছাড়া একটা ভদ্রোজনোচিত কর্মসংস্থানের জন্য শিক্ষাপরবর্তী জীবনের বিশাল একটা অংশ পার করেছেন বেকারত্বে এবং দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে। তাঁর এই জীবদ্দশায় তাঁর কাব্য প্রতিভার পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন হয়নি, যতটুকু মূল্যায়ন হয়েছে বুদ্ধদেব বসু প্রমুখদের দ্বারা, তার চেয়ে ঢের বেশি হয়েছে বিরূপ সমালোচনা এবং তাচ্ছিল্য। এই মূল্যায়নের আস্বাদ তিনি লাভ করতে শুরু করেছিলেন মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছর আগে। সংক্ষিপ্ত এই সময়ের মধ্যে নিয়তি তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল, তিনি পেয়েছিলেন একটা ভদ্রোচিত জীবিকার সন্ধান, পাঠক ও সম্পাদক মহলে পেয়েছিলেন সমাদর ও স্বীকৃতি। নিভৃতচারী এই কবির যে বিপুল অপ্রকাশিত রচনা তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে আবিষ্কৃত হয়, তাতে তাঁর প্রচারবিমুখতা প্রমাণিত হয় বটে, কিন্তু তাঁকে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের অবকাশও পাওয়া যায় তাঁর রচনার সমগ্রতা থেকে। ছেলেবেলা থেকে তাঁর এই চরিত্রগঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়।
আমরা জানি তাঁর মা কুসুমকুমারী দাশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব সামান্য হলেও তিনি ছিলেন কবি। হাল আমলের স্কুলপাঠ্য ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটির রচয়িতা তাঁর মা সাংসারিক কাজকমের্র চাপে লেখার সময় খুব বেশি পেতেন না। তারপরও ব্রহ্মবাদী পত্রিকা থেকে কবিতা চাইতে এলে তিনি রান্নার কাজ করতে করতে অনায়াসে একটা কবিতা লিখে দিয়ে দিতে পারতেন। খুব ছোট বয়সে জীবনানন্দের একবার যকৃতের রোগ হয়েছিল। তখনকার দিনে রোগ সারাবার জন্য চিকিৎসকেরা হাওয়া বদলের পরামর্শ দিতেন। মরণাপন্ন শিশু জীবনানন্দকে নিয়ে মা কুসুমকুমারী দিল্লী, আগ্রা, লক্ষ্েণৗয়ের নানান স্বাস্থ্যনিবাসে ঘুরে পুত্রকে সুস্থ করে ফিরে আসেন। অথচ তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা কখনোই সচ্ছল ছিল না। অশোকানন্দের জবানী থেকে জানা যায় ছেলেবেলার এই অসুখটার কারণেই বোধ হয় জীবনানন্দ কিছুটা মেজাজী ছিলেন, যা মাঝে মাঝে উসকে উঠত।
তাঁর বাবা পিতা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন স্কুল শিক্ষক এবং ধর্মযাজক। বাবার সম্পর্কে জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘প্রায় রোজ শেষ রাতে বিশেষত হেমন্ত ও শীতকালে উপনিষদের শ্লোক আওড়াতে আওড়াতে তিনি আমাদের অপরূপ সূর্যচেতনার প্রভাতে নিয়ে আসতেন।’ বাবা মায়ের এই গুনের যুগলবন্ধনে জীবনানন্দের ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছিল। পরিবারে সাহিত্যচর্চার উপযুক্ত পরিবেশের প্রভাবে জীবনানন্দ অল্প বয়স থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলেন। ছোটভাই অশোকানন্দ তাঁর অগ্রজের কাব্যপ্রয়াসের প্রমাণ দিতে গিয়ে একটা কবিতার দুটো লাইন উদ্ধৃত করেছেন: ‘এল বুঝি বৃষ্টি এল/ পায়রাগুলো উড়ে যায় কার্নিশের দিকে এলোমেলো।’
কিশোরবয়সে জীবনানন্দের ছিল বাগান করার শখ। সেসময় বরিশালে এত নার্সারি ছিল না, তাই বিভিন্ন লোকের বাড়ি থেকে ফুলের বীজ বা চারা জোগাড় করে আনতেন তিনি। ঘনিষ্ঠ কেউ কলকাতা গেলে তাদের কারো হাতে কখনো কলকাতা থেকেও বীজ আনাতেন তিনি। জীবনানন্দের প্রথম জীবনীকার গোপালচন্দ্র রায়ের তথ্যসূত্রে জানা যায় স্কুলের ওপরের ক্লাশে থাকতেই ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন তিনি, তবে সেগুলোর সবই পেন্সিল স্কেচ। এ প্রসঙ্গে তাঁর ছোট বোন সুচরিতা দাশ লিখেছেন, ‘তাঁর ছবি আঁকার নেশা ছিল, আলতো পেনসিলের মৃদু চঞ্চলতার অস্ফুট আলোছায়াময় কতই না ছবি ফুটে উঠত।’ বাগান করা কিংবা ছবি আঁকার পাশাপাশি বাড়িতে পিতার লাইব্রেরি থেকে বই পড়ার অভ্যাস রপ্ত করেছিলেন। কখনো মায়ের কাছ থেকে টাকা চেয়ে নিয়ে কখনো বা নিজের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে পছন্দের বই কেনার অভ্যাসটিও ছোটবেলা থেকেই গড়ে উঠেছিল তাঁর। বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর তীরে কিংবা শহর ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে এগিয়ে গেলেই চোখে পড়ত পথের দুধারে শস্যক্ষেত, বরিশালের নাবি অঞ্চলের শ্যামলিমা। এসব ছোটবেলা থেকেই আকর্ষণ করত বালক জীবনানন্দকে।
শৈশবে শুরু করা কবিতার চর্চা স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার পরও অব্যাহত ছিল। কলেজে ওঠার পর ইরেজিতেও কিছু কবিতা লিখেছিলেন তিনি। রচনা করেছিলেন কিছু গানও। তবে সেই সময়ে লেখা তাঁর কবিতা, গান বা চিত্রকর্ম-কিছুই পরবর্তী সময়ে আর পাওয়া যায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। যাঁর বেশিরভাগ সৃষ্টিকর্ম তোরঙ্গবন্দী হয়ে পড়ে ছিল দীর্ঘ সময়, যা জীবদ্দশাতে কখনোই প্রকাশ করেননি তিনি, তাঁর অপক্ক বয়সের কবিতা বা গান সংরক্ষণ করা হবে-এটি আশা করা যায় না। আমরা জানি ছাপার অক্ষরে তাঁর প্রথম কবিতা ছিল ‘বর্ষ-আবাহন’, এটি ছাপা হয়েছিল বরিশালের ব্রাহ্ম সমাজ থেকে প্রকাশিত মাসিক ব্রহ্মবাদী পত্রিকায়। সে সময় তাঁর বয়স একুশ বছর। উল্লেখ্য কবিতাটি জীবনানন্দের স্বনামে ছাপা হয়নি, রচয়িতার নামের জায়গায় কেবল ছিল ‘শ্রী।’ বছর শেষে সারা বছরের লেখকদের যে সূচি ছাপা হয় তাতেই দেখা যায় কবিতাটির রচয়িতা ছিলেন ‘শ্রী জীবনানন্দ দাস বি. এ।’ তাঁর প্রকাশিত প্রথম কাব্যপ্রয়াসে ছদ্মনামের ব্যবহার আবারও প্রমাণ করে দেয় তাঁর লাজুক স্বভাবের কথা। কিংবা হতে পারে কবিতাটি নিয়ে তাঁর সংশয় ছিল। এমনও হতে পারে কবিতাটি কারো অনুরোধ বা নির্দেশে লিখেছিলেন বলে তিনি নিজের নামটা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। এ ব্যাপারে গোপালচন্দ্র রায়ের অভিমত ‘যেহেতু ব্রহ্মবাদী ব্রাহ্মদের পত্রিকা এবং জীবনানন্দ নিজে ব্রাহ্ম হলেও ব্রাহ্মদের আচার অনুষ্ঠান, এমনকি সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানই এড়িয়ে চলতে ভালবাসতেন, সেই জন্যই হয়ত ঐ পত্রিকায় নাম প্রকাশ করতে চাননি।’
জীবনে প্রথম প্রকাশিত কবিতাটিতে নিজেকে প্রচ্ছন্ন রাখার যে চেষ্টা আমরা দেখলাম, সেটি কেবল তাঁর লাজুক নিভৃতচারী স্বভাবের সাথেই সমিল নয়, মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে আবিষ্কৃত তাঁর বিপুল অপ্রকাশিত রচনাসম্ভার লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে দেওয়ার বিষয়টিকেও তার সাথে সম্পর্কিত করা যায়। গোপনে সংরক্ষিত লেখাগুলো নিয়ে হয়তো বা তাঁর সংশয় ছিল, কিংবা ছিল অতৃপ্তি? তাঁর জীবদ্দশায় সে সব প্রকাশের কোনো ব্যবস্থা কিংবা কোনো তাগিদ অনুভব করেননি কেন-এই প্রশ্নের জবাব আর কখনোই পাওয়া যাবে না।
জীবনানন্দ ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স পাশ করেছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণীতে। এই ফল তাঁর কাম্য ছিল না। তবে এ উপলক্ষে সর্বানন্দ দাশের দৌহিত্র এবং দৌহিত্রীদের বিএ, বিএসসি এবং এমএ পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়া উপলক্ষে সর্বানন্দ ভবনে এক বিশেষ ব্রাহ্ম ধ্যানানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। তিনি যখন এমএ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন তিনি অসুখে পড়েছিলেন, সেকারণে তাঁর প্রস্তুতি ভাল ছিল না। জীবনানন্দের ইচ্ছা সে বছর পরীক্ষায় না বসে পরের বছর আরো ভালো প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষাটি দিতে, যাতে প্রথম শ্রেণী নিশ্চিত হয়। কিন্তু তাঁর বাবা ছেলের একটি বছর সময় নষ্ট করার পক্ষপাতী ছিলেন না, তাই ছেলেকে তিনি পরামর্শ দেন, যাতে সেবছরই পরীক্ষাটা দিয়ে ফেলেন। ভাল প্রস্তুতি না থাকায় এমএ-তেও জীবনানন্দ দ্বিতীয় শ্রেণীতে পাশ করেন।
জীবনানন্দের চরিত্রের এই দিকটি লক্ষ্যণীয়, একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক শিক্ষাজীবনের শেষে পৌঁছেও পিতার উপদেশ শিরোধার্য্য করে জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বদলে দিচ্ছেন। এই উপদেশ মেনে নিতে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত ফল থেকে বঞ্চিত হওয়া নিয়ে হয়তো তাঁর খেদ ও হতাশা ছিল, যার প্রকাশ ঘটেছে সুতীর্থ সহ তাঁর নানা গল্প উপন্যাসে। আমরা দেখেছি প্রথম শ্রেণী না থাকায় তিনি কোথাও শিক্ষকতার চাকরি জোটাতে পারছিলেন না। একাধিকবার কলেজ এবং সংবাদপত্রের (স্বরাজ) চাকরি থেকে পদচ্যুত হওয়ার পর দারিদ্র্য তাঁর পিছু ছাড়ছিল না। দুর্বিষহ সেই বেকার জীবনে তাঁকে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য যে কোনো ধরনের কাজ করতে হয়েছে, এমনকি ইন্সুরেন্সের দালালির মতো চরম অসম্মানজনক কাজও করেছিলেন তিনি। সেই বেকারত্ব, প্রথম শ্রেণী না পাওয়ার আক্ষেপ এবং অর্থকষ্ট তাঁকে তাড়া করে ফিরেছে আমৃত্যু। তাঁর সেসময়কার হীনন্মন্যতা এবং মানসিক অবস্থার কিছুটা আভাস পাওয়া যায় অশোক মিত্রের লেখায়, ‘জীবনানন্দের সঙ্গেও কলকাতায় এলে নিয়মিত দেখা হতো, তিনি ক্রমশ উদভ্রান্ত, ক্রমশ আত্মবিশ্বাসরহিত। তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধুরা, যেমন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, যেমন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন, অথচ তিনি নিজে একটি ভদ্রগোছের অধ্যাপনার কাজ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পারছেন না। পরিচিত এঁকে-তাঁকে ধরেও কোনও ফল হচ্ছে না, আমরা যাঁরা তাঁর ভক্ত শুভানুধ্যায়ী তাঁরাও কিছু করে উঠতে পারছি না। একদিন, বর্ষার এক সন্ধ্যা, রাসবিহারী এভিনিউর প্রায় মোড়ে, ল্যান্সডাউন রোডের গলিতে তাঁর একতলার ফ্ল্যাটের বহির্দুয়ার দিয়ে ঢুকেছি, হঠাৎ আমাকে টেনে এক কোণে, নিচু নিমগাছের ডালের আড়ালে, নিয়ে গেলেন, কানে-কানে তাঁর অস্ফুট প্রশ্ন: ‘আচ্ছা, আপনি কি জানেন, বুদ্ধদেব বাবুর নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকার ফিঙড আছে?’ (‘আপিলা চাপিলা’, আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. কলকাতা)।
একজন ইংরেজির অধ্যাপনা চাকুরিপ্রার্থী প্রথম শ্রেণীবঞ্চিত মানুষের এই যন্ত্রণা, হতাশা ও আক্ষেপ প্রতিফলিত হয়েছে জীবনানন্দের ‘জলপাইহাটি’ উপন্যাসে। উল্লেখ্য, ‘মাল্যবান’ কিংবা ‘জলপাইহাটি’ উপন্যাসদ্বয়কে যেমন জীবনানন্দের আত্মজীবনীমূলক বলে সহজে চিহ্নিত করা যায়, ‘সুতীর্থ’কে শুরুতে তেমনটি মনে হলেও পরে সেই ধারণা আর থাকে না। তবে উপন্যাসটির শুরুতে পেশাগত জীবনের চাপে এবং সময়ের অভাবে একজন কবি যে লেখা ছেড়ে দিয়েছেন সে ইঙ্গিত আছে। এমনকি তাঁর নিকটতম দোসর দারিদ্র্যই যে কবিতা লিখা ছেড়ে দেওয়ার মূল কারণ সেকথাও আছে এভাবে, ‘নিজে অনেকদিন থেকে কিছু লিখছে না বটে কিন্তু সেটা অক্ষমতার জন্যে নয়, অবসরের অভাবে। অর্থের সচ্ছলতা নেই। এই নিরেট পৃথিবীতে টাকা রোজগার করতে গিয়ে মূর্খ ও বেকুবদের সঙ্গে দিন-রাত গা ঘেঁষাঘেঁষি করে মনের শান্তিসমতা যায় নষ্ট হয়ে।’
আমরা জীবনানন্দের জীবনসমগ্র যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাই, কৈশোরে কবিতা লেখা, ফুলের বাগান করা, ছবি আঁকার চেষ্টা করা, তারুণ্যে ও যৌবনে কবিতার চর্চা করা একজন মানুষ কেবল পেশাগত অনিশ্চয়তা এবং আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে হীনমন হয়ে যাচ্ছেন তা নয়। তাঁর সাথে ঘনিষ্ট হওয়া বিভিন্নজনের ভাষ্যে জানা যায় তিনি ছিলেন কিছুটা খাপছাড়া, যথেষ্ট মুখচোরা এবং সবার্থে আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন একজন মানুষ। তাঁর খাপছাড়া চরিত্রের আভাস মেলে তাঁর সর্বশেষ কর্মস্থল হাওড়া গার্লস কলেজ থেকে আচমকা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায়। তাঁর আগের কর্মস্থল থেকে নানান ছুতোয় অনুপস্থিত থাকার বহু কারণ ছিল, কিন্তু বহুদিন বেকার থাকার পর তাঁর পছন্দসই একটা চাকরি জোটার পরও তিনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক কিংবা মৌখিক অনুমোদন না নিয়ে হাওড়া থেকে দিল্লীর মতো দূরত্বে চলে যাওয়ার ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে বাস্তবরহিত খাপছাড়া এক কবি। এমনকি জীবনানন্দের প্রথম জীবনীকার গোপালচন্দ্র রায়ের মতে হাওড়া গার্লস কলেজের চাকরির জন্য তিনি প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করতেও অনিচ্ছুক ছিলেন এবং দেখা করেনওনি। পরে জীবনানন্দ যখন প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করেন, তিনি তাঁকে শুধু একটা দরখাস্ত পূরণ করতে বলে জানিয়ে দেন যে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হবে। তাঁর কবিখ্যাতির কারণেই বোধকরি খুব দ্রুত চার-পাঁচজনকে ডিঙিয়ে বিভাগীয় প্রধান করে দেওয়া হয় তাঁকে। ভাইস প্রিন্সিপাল করার কথাও বিবেচনা করা হচ্ছিল একসময়। গোপালচন্দ্র জানান, এই প্রস্তাবে জীবনানন্দ রাজী না হয়ে বরং বলেছিলেন, ‘আর না, বেশ আছি।’ এসব ঘটনা থেকে ধারণা করা যায়, তিনি প্রকৃতপক্ষেই ছিলেন মুখচোরা ও অপ্রতিভ ধরনের মানুষ, বড় দায়িত্ব গ্রহণের ভার নিতেও যেন অক্ষম।
বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ সব চেয়ে নির্জন, সব চেয়ে স্বতন্ত্র।’ বুদ্ধদেব বসুর এই কথায় জীবনানন্দ একদিন তাঁর সহকর্মী অধ্যাপক নিরঞ্জন চৌধুরীকে বলেছিলেন, ‘নির্জন কবি, নির্জন কবি বলে বুদ্ধদেব বসু আমার সম্বন্ধে একটা লিজেন্ড খাড়া করেছেন, যেটা আমার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ঠিক নয়।’ অথচ জীবনানন্দের সাথে মিশেছেন এমন অনেকের ভাষ্যে জানা যায় তিনি কোনো অর্থেই সামাজিক এবং মিশুক প্রকৃতির ছিলেন না। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘সে যেন এই সংগ্রাম-সংকুল সংসারের জন্য নয়, সে সংসার-পলাতক। যেখানে অনাহুত ধ্বনি ও অলিখিত রং জীবনানন্দের আড্ডা সেইখানে।’ এই মন্তব্যের সূত্র ধরেই হয়তো জীবনানন্দের ছোটবোন সুচরিতা দাশ তাঁর মৃত্যুর পর লিখেছিলেন, ‘দাদার সম্পর্কে অনেক জনশ্রুতি প্রচলিত। তিনি জীবন থেকে পালিয়েছেন। তিনি মানুষের সখ্য সহ্য করতে পারেন না। তিনি নির্জন, তিনি নিরিবিলি। সব কোলাহল থেকে দূরে। এ সব বাক্য গঠনের সত্য-সত্যতা কতটুকু তা আমার বিবেচ্য নয়, যদিও এ সবের অনেকগুলোই ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে হয়ত এতদিন।’
সবার কাছ থেকে দূরে থাকার মনোভাবটি জীবনানন্দ হয়তো পোষণ করতেন আত্মসম্মানবোধ থেকে, তাঁর ধারণা ছিল অনেকের সাথে মিশতে গেলে আত্মসম্মানের বিষয়টি কোনো কোনো সময় উপেক্ষা করতে হয়, এটি তিনি মেনে নিতে পারতেন না। তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবার থেকে স্বতন্ত্র একাকী এবং নিভৃতচারী। তাঁর এই স্বভাব তাঁকে কি দিয়েছিল আমরা জানি না, কিন্তু বাংলা কবিতাকে দিয়েছিল নতুন মাত্রার সন্ধান।