জি-২০ সম্মেলন ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে না বলা কথা

অনুপ দাশগুপ্ত | সোমবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

গত ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর’২৩ ভারতের দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো জি২০ শীর্ষ বৈঠক। বিশ্বের এই বড় সম্মেলনের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে বিশ্বের সকল প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় চলছে তুমুল আলোচনা। হচ্ছে তর্ক ও বিতর্ক। যদিও এবারের জি২০ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, ‘চেতনায় এক বিশ্ব,এক পরিবার,এক ভবিষ্যৎ’ গড়ার অঙ্গীকার। এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে জি২০ সদস্যভুক্ত দেশ ছাড়াও বাংলাদেশ সহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর আগ্রহও লক্ষণীয়। এর কারণ জি২০ সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিজেদের বহুপক্ষীয় বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে থাকে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপি চলমান সন্ত্রাস, জলবায়ুর অভিঘাৎ মোকাবিলার পাশাপাশি রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগের ওপর গুরুত্ব দেয় সম্মেলনে অংশ নেওয়া জি২০ সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা। মূলত দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বনেতাদের অনেকেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের বৈঠকে ‘এক বিশ্ব,এক পরিবার, ভিসা মুক্ত’ বিশ্ব গড়ার স্লোগান দিয়ে আসছিল। এবার বিষয়টি সম্মেলনের প্রতিপাদ্য করে সামনে নিয়ে আসা হলো। আর এ কারণে পুরো বিশ্বের দৃষ্টি ও আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল এই সম্মেলন। দিল্লীর ঐতিহাসিক প্রগতি ময়দানের ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার ‘ভারত মণ্ডপম”এ এবারের শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন জি২০ এর সদস্যসহ বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশের শীর্ষ নেতারা।আমাদের সৌভাগ্য সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।তাঁর বক্তব্যও বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি কেড়েছে। অন্যদিকে কনভেনশন সেন্টারের সামনেই স্থাপন করা হয়েছে বিশাল এক নটরাজ মূর্তি। জি২০ সম্মেলনে বিদেশি রাষ্ট্রনেতাদের স্বাগত জানাতে ২৮ ফুট লম্বা এ নটরাজ মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল। জি২০ সম্মেলনটি এ মাসে এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হলো, যখন করোনা মহামারির ভয়াবহ বিপর্যয়ের পরপর এবং রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা পৃথিবী এক মহা অর্থনৈতিক সংকটে ভূপাতিত। আর জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সংকট তো বিরাজমান রয়েছেই। তাই বিশ্ব তাকিয়ে ছিল, জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ,বিভিন্ন মহামারিসহ ডিজিটাল ডিভাইসের কারণে সৃষ্ট বৈষম্যমূলক পরিস্থিতিতে বিশ্ব নেতারা কী বলেন সেদিকেই।

জলবায়ু পরিবর্তন এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংকট। যদিও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা রাশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাকে পাশাপাশি বসিয়ে সর্বসম্মত দিল্লি ঘোষণাপত্র হলো জি২০র বর্তমান সাফল্য। এও বলা হচ্ছে, বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী দেশগুলির কাছে দিল্লি বৈঠকে তা যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার ক্ষেত্রে দিল্লি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়িত অর্থাৎ পুনর্নবীকরণ যোগ্য বিদ্যুৎ তৈরির পরিকাঠামো এখনকার তুলনায় তিনগুণ বাড়ানো, গ্রিন হাইড্রোজেন ইনোভেশন সেন্টার ও গ্লোবাল বায়োফুয়েল অ্যালায়েন্স তৈরি করা যাতে আরও সবুজ জ্বালানির সন্ধান পাওয়া যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫.৮ থেকে ৫.৯ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলারের প্রয়োজনও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এবং এটাও মানা হয়েছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে গোটা পৃথিবীতে কার্বন নিঃসরণ শূন্য করে দেওয়ার জন্য চাই প্রতি বছর ৪ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার। এখন কথা হলো এই বলা আর করার মধ্যে আগামী দিনগুলোতে কতটা সাযুজ্য থাকবে? কিন্তু সেই প্রশ্নকে আপাতত দূরে সরিয়ে রাখলেও ভুলে গেলে চলবে না যে, জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে ১৪ বছর আগে যে পরিমাণ আর্থিক সাহায্যের অঙ্গীকার আমেরিকাসহ উন্নত দেশ গুলো করেছিল, তা আজ অবধি হয়ে ওঠেনি। দিল্লি সিদ্ধান্ত পত্রের পিছনে আসলে কে বা কোন শক্তিধর নেতার ভূমিকা কাজ করেছিল। সে প্রশ্ন উঠেছে এখন।এই ঘোষণা বা সিদ্ধান্ত পত্রের প্রায় সবই পড়েছে ‘মিটিগেশন’এর চৌহদ্দিতে। মিটিগেশন মানে হল মূলত নতুন ব্যবস্থা সৃষ্টি ও তাদের পাথেয় করে উষ্ণতা সৃষ্টিকারী গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানো। আর নতুন ব্যবস্থা মানেই নতুন বাজারের হাতছানি। মোট কথা হলো জি২০এর জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত অ্যাকশন প্ল্যান প্রায় অপহরণ করে নিয়েছে ‘মিটিগেশ’ বা প্রশমন প্রয়াস এবং ‘মার্কেট’ অর্থাৎ বাজার। নেই, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি যাদের দায়িত্ব, সেই জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ কয়লা তেল ও গ্যাসের ব্যবহার কমানোর কথা। নেই, জলবায়ু সংকট মোকাবিলা বা বন্ধ করার জন্য ‘অ্যাডাপ্টেশন’ বা ‘অভিযোজন’ অর্থাৎ মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাকে স্পষ্ট করে আর্থিক সাহায্য বাড়ানোর কথা, যা স্বল্পোন্নত ও ভারত, বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য বলছে, ‘মিটিগেশন’ খাতে আন্তর্জাতিক আর্থিক সাহায্য ইতিমধ্যেই ‘অ্যাডপ্টেশন’এর তুলনায় অনেক বেশি এবং সে প্রবণতা বাড়তে চলেছে। ঘোষণা পত্রে সেই ভাবে কোনও উল্লেখই নেই, ‘লস এন্ড ড্যামেজ’ বা ক্ষয়ক্ষতির। অর্থাৎ পৃথিবীর ইতিমধ্যেই জলবায়ু বিপন্ন অঞ্চলগুলির মানুষদের জন্য আর্থিক সাহায্যের কথা, যা নিয়ে গত বছরের শর্ম এল শেখ আন্তর্জাতিক জলবায়ু বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল একটি আলাদা তহবিল তৈরি করার, এবার কিন্তু তেমন কিছু পাওয়া যায়নি।

জলবায়ু পরিবর্তন সামলাতে বাজারের ভূমিকার কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু শুধু বাজারের উপর নির্ভর করে জলবায়ুর এই বিশাল পরিবর্তনকে সামলানো সম্ভব নয়। এখানে সরকারের বিশাল অর্থ লগ্নি দরকার।

বাজার অর্থনীতি সবসময় কাজ করে লাভের ওপর বা রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট এর উপর। অর্থাৎ লগ্নিকৃত মূলধন কীভাবে ফেরত আসবে তার ওপর। সব কিছু বাজারের ওপর ছাড়লে হবে না; সরকারকেও থাকতে হবে। এই অংকে সুন্দরবনের সেই সব লক্ষ লক্ষ মানুষ নেই, যাঁরা ইতিমধ্যেই বারংবার ঘর, চাষের জমি হারিয়েছেন; নেই বাংলাদেশের ব্রহ্মপুত্র নদীর চরে কোনও রকমে বেঁচে থাকা হাজার হাজার মানুষ, যাঁরা বছরের অনেকটা সময় দশ দিনের নবজাতক থেকে নব্বই বছরের বৃদ্ধবৃদ্ধাদের নিয়ে ঘরের আধপাকা ছাদে কাটতে বাধ্য হন। কেননা পুরো দীপাঞ্চলই পানির নীচে তলিয়ে যায়। তাহলে শুধু বাজারি ফর্মুলা দিয়ে এসব মানুষগুলোকে বাঁচানো সম্ভব হবে কি? নিশ্চয় নয়। দরকার পাবলিক ফিনাইন্স, অর্থাৎ সরকারি সাহায্য। যার সঠিক গুরুত্ব দিল্লি ঘোষণায় নেই। যা সত্যিই আশংকার।

মনে রাখতে হবে, নেতারা জি২০ তে যখন এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তার ঠিক আগেই জাতিসংঘের গ্লোবাল স্টক টেক রিপোর্ট জানাচ্ছে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ২০১৯ সালের তুলনায় ৪৩ শতাংশ কমাতে না পারলে কোনও রকমেই প্রাকশিল্পায়ন যুগের তুলনায় পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে দেড় ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে আটকে রাখা যাবে না। বর্তমানে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.২ ডিগ্রি বাড়তেই কী পরিস্থিতি, সেটা স্পষ্ট। দাবদাহে পুড়ছে সে সব দেশ ও অঞ্চল, যেখানে আগে এমন পরিস্থিতি চিন্তা করা যায়নি, বাড়ছে তীব্র ঘূর্ণিঝড়, হঠাৎ আকাশভাঙা বৃষ্টি এবং অনেক ক্ষেত্রেই এক সঙ্গে সেগুলি ঝাঁপিয়ে পড়েছে পৃথিবীর ওপর। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে, পৃথিবী জুড়ে গরিব মানুষ, যাঁদের এমন পরিস্থিতি সামলানোর মতো শক্তি ও সঙ্গতি কোনটিই নেই। তাই গ্লোবাল স্টক টেক রিপোর্টে নির্দিষ্ট করে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রাকে ছোঁয়া তো দূরের কথা, তার কাছাকাছিও পৌঁছানো সম্ভব হবে না যদি জীবাশ্ম জ্বালানী ব্যবহার উন্নত দেশ গুলি দ্রুত বন্ধ না করে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো কমিয়ে আনতে না পারে। যা আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে তাঁর দেওয়া বক্ত্যব্যের চার দফা সুপারিশে বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বার বার মনে করিয়ে দেন এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সদস্য হিসেবে জলবায়ু জনিত অভিবাসন মোকাবিলায় অতিরিক্ত অর্থায়নের ব্যবস্থা করার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষতি এবং ক্ষয়ক্ষতি তহবিল চালু করার অনুরোধ জানান। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলো এই শীর্ষ সম্মেলনে যেটুকু কথা দিয়েছেন তাও যদি ঠিক মতো কার্যকর করেন, তাহলে হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকেরা মানবিক মর্যাদা, অধিকার ও সম্মান নিয়ে হয়তো বাঁচতে পারবে। কবি শামসুর রাহমান তাঁর ‘কথা ছিল’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘কথা ছিল, আমার আনন্দগানে ভরিয়ে তুলব অলিগলি, জনপথ, অবাধ প্রান্তর/ৃকথা ছিল, উৎসবের কবিতা নিরুদ্বেগ লিখে মুছে ফেলবো সকল দু:খ শোক/এ মুহূর্তে সূর্যাস্তের ছোপলাগা কবরের দিকে অসহায় চেয়ে থাকি/বন্দিদশা এল বুঝি পুনরায়..’। জলবায়ু অবিভাসনের এই বন্দিদশা থেকে মুক্তির জন্য ধনী দেশগুলোর কথা দিয়ে কথা রাখার ওপর নির্ভর করছে, জি২০ সম্মেলনের সার্থকতা।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোহিঙ্গা সংকটের শেষ কোথায়
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে স্বেচ্ছাসেবক দলের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন