আমাদের সাহিত্যভুবনে ছড়া একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করছে । ছড়ার ঐতিহ্য বেশ পুরনো, এ প্রসঙ্গে কবি আল মাহমুদ বলেছিলেন ‘ছড়াই হল কবিতার আদিমাতা।’ কেউ বলেন ‘ছড়া শিশুদের খেলা মেলার কাব্য’ সময়ের পরিক্রমায় ছড়ার লৌকিক ঐতিহ্য পেরিয়ে এসে আমরা এখন ছড়া সাহিত্যিকদের বিভিন্ন ধারার ছড়ার সাথে পরিচিত হচ্ছি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন বৈচিত্র্যে ছড়া এগিয়ে চলেছে। ছড়াকারদের মাঝে সমকালীন ভাবনা স্থান করে নিয়েছে, এসেছে রাষ্ট্র ,নৈতিকতা, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মূল্যবোধের ধারণা। এই ধারার অবলম্বনে আমাদের এখনকার প্রতিপাদ্য ছড়াকার জি. এম. জহির উদ্দিনের সদ্য প্রকাশিত ছড়াগ্রন্থ ‘খোকার চোখে স্বপ্ন আঁকে’। তিনি মূলত কবি, ছড়া লিখছেন বিভিন্ন সময়ে আর ৩৬ টি ছড়া নিয়ে গ্রন্থস্থ হয়েছে এ বইটি, যা সমকালীন ভাবনায় মূর্ত। প্রকৃতিকে নিয়েই এই গ্রন্থের ছড়ার সূচনা। লেখক প্রথম ছড়াতেই ছন্দে ছন্দে তাঁর নিজ গাঁয়ের ছবি তুলে এনেছেন। ‘আমার প্রিয় গ্রাম ‘ ছড়াটি হালদা নদীর তীরবর্তী তাঁর নিজের জন্মভূমি এবং শৈশবের রঙিন দিনের ছবিতে সমৃদ্ধ। জারি সারি গান আর সরল মানুষের আনাগোনায় মুখর নিজ গ্রামের পরিবেশ। তাঁর ভাবনা এরকম ‘হালদা নদী এঁকেবেঁকে চলছে সাগর পানে / মনটা তোমার জুড়িয়ে যাবে মাঝির ভাটি গানে /আজো গ্রামে সরল মানুষ প্রচুর পাবে তুমি / গর্ব জাগে এ যে আমার প্রিয় জন্মভূমি।
প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবে লেখক লিখেছেন তাঁর দ্বিতীয় ছড়া ‘নিমন্ত্রণ’। গ্রামীণ পরিবেশের রূপময় বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন দীর্ঘ এ ছড়ায়। শিশুসুলভ ভাবনায় তিনি পাঠকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন নিজের গ্রামের স্নিগ্ধ পরিবেশে। তিনি লিখছেন ‘মাঠের পরে মাঠ জুড়ে ভাই শর্ষে ক্ষেতের চাষ / গ্রামের মানুষ ফলায় ফসল খেটে বারো মাস / বৈশাখ মাসে গ্রামটি জুড়ে আমের ছড়াছড়ি / নানান জাতের আমের থোকা ঝুলছে ঝুড়ি ঝুড়ি ।’
চট্টগ্রামের বিখ্যাত একটি নদী হালদার বর্তমান অবস্থায় তাঁর রচনা ‘হালদা নদী।’ মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপে বিপন্ন হালদা নদীর বর্ণনা দিতে গিয়ে ছড়াকার এর দূষণ এবং যন্ত্রযানের শব্দ দূষণে মা মাছের করুণ দশার কথা উল্লেখ করেছেন। ‘তুমি দেশের একটি নদী তুমি মায়ের তুল্য/ অর্থ লোভী নদী খাদক দিচ্ছে না তার মূল্য / দিন দুপুরে মেশিন দিয়ে তোমার বুকের মাটি / নিচ্ছে তুলে, দেয় না তোমায় থাকতে পরিপাটি।‘ কিংবা ‘ মা–মাছেরা শংকিত আজ দূষণ যন্ত্রযানে / হয়তো তারা হারিয়ে যাবে নীরব অভিমানে ।’
ছড়া যে শুধু শিশুর মনের কথা বলে তাই নয়, ছড়া একটি রাষ্ট্রের পরাধীনতার কথাও বলে। পরাধীনতার অন্ধকার থেকে মুক্ত জীবন প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা সবারই থাকে। ‘বদ্ধঘরে মুক্তবাক’ তেমনই একটি ছড়া যেখানে একটি জাতির বাক স্বাধীনতা এবং পরাধীন অবস্থার কথা ফুটে ওঠেছে। স্বাধীন ভাবে নিজেকে প্রকাশিত করার বাসনা একটি জাতির পরম চাওয়া। তিনি বলছেন ‘আজ এখানে চলছে দেখ বদ্ধ ঘরে মুক্তবাক/ চারদিকে যা চলছে দেখে হচ্ছি সবাই রুদ্ধবাক / অর্ধশতক পার হলো ভাই জাতির দুঃখ ঘুচলো না / দেশের মানুষ আজো কাঁদে সুখের দুয়ার খুললো না/ থামাও কান্না থামাও ঘেন্না নয়তো এ দেশ বাঁচবে না / সাহস নিয়ে না হটালে স্বাধীন হতে পারবে না।’
বইয়ের শিরোনাম যে ছড়া ‘খোকার ছোখে স্বপ্ন আঁকে’, যাতে খোকার স্বপ্নময় সোনালী ভবিষ্যতের এক চিত্র ফুটে ওঠে। খোকা স্বপ্ন দেখে, আঁধার কেটে গিয়ে আলোকময় সকালে অন্যরকম একটি দিন হবে। মায়ের স্বপ্ন আর খোকার স্বপ্ন একসাথে এগিয়ে যাবে এক রঙিন ভবিষ্যতের আশায়। ছড়ায় ছড়ায় ছড়ার ভাবনা বুনেছেন তাঁর ‘ছড়া মানে’ লেখায়। তিনি উপমায় ব্যক্ত করেছেন ছড়ার দিগন্ত। ছড়ার মধ্য দিয়ে মনের ভিতরকে আপন করে দেখা, বাবা মায়ের আদর ভরা মুখ আর বৃষ্টি মেঘের ছবি আঁকা। ছড়ার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় শীতের আমেজ আর শিশির ভেজা সকাল বেলা।
শিশু মনের ভাবনা, তার অন্তরের বক্তব্য, চাওয়া পাওয়া, বোঝার বিষয়গুলো ছড়াকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। ‘শিশু’ ছড়াটিতে তিনি শিশুর স্বাধীনতা, বাঁধনবিহীন মুক্ত চলাফেরার আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। শিশু কখনো হীরা মানিক মুক্তো চায় না, সে চায় ফুলপাখি আর বনলতা। শিশুর মনকে দেশবিরোধী শত্রুও নাড়া দেয়। শত্রুকে দেশ ছাড়া করার বাসনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়াসও দেখা যায় লেখক ব্যক্ত করছেন এভাবে ‘ওরা শিশু মুক্ত মনে গাইবে শুধু গান / দায় দেনাহীন জীবন যাপন মুক্ত রবে প্রাণ/ মুক্ত হৃদয় গড়বে ওরা শাসন বাঁধন হারা / শত্রু এলে লড়বে আবার করবে এদেশ ছাড়া।’
বিবেকানন্দ বলেছিলেন ‘ছড়া হওয়া চাই স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক। তার প্রধান শত্রু হচ্ছে কৃত্রিমতা। ‘ছড়াগ্রন্থটির প্রতিটি ছড়াই স্বাভাবিক বাস্তবতা আর শিশু মনসতত্ত্বের বিষয় নিয়ে রচিত। এর মধ্যে কোন কৃত্রিমতা নেই। একটি ছড়ার কথা বলা যায় ‘ব্যস্ত খোকা’। ছড়াটি দীর্ঘ কিন্তু খোকার স্বাপ্নিক জগতকে ছাড়িয়ে তার কাজের জগতের সরব অনুভূতি এতে প্রতিভাত হয়েছে। ‘এমন সময় মায়ের ডাকে ভাঙলো খোকার ঘুম / দেখে খোকা , আদরে মা কপালে দেয় চুম ! / একটু সময় পায়না খোকা এমন ব্যাস্ত আজ / সকাল থেকে রাত অবধি খোকার অনেক কাজ। ‘খোকার উপলব্ধি অকৃত্রিম ভাবনায় উৎসারিত ।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যেমন মহান, তেমনি মহান আমাদের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের অবদান। ছড়া গ্রন্থের লেখক মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে বীর শ্রেষ্ঠদের আত্মত্যাগ স্মরণ করেছেন পঙক্তিতে। লেখক বীর শ্রেষ্ঠের ভূমিকা স্মরণ করিয়ে আজকের শিশুদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে ধারণ করে দেশপ্রেমিক হওয়ার আহবান জানিয়েছেন।
‘আমার এ দেশ, শহীদ তোমাদের রক্তের অধিকার / আমরা পরাধীন যদি না শোধিতে পারি সে রক্তধার।’
ছড়াকে শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া সহজসাধ্য ব্যাপার নয় মোটেই। এর ছন্দ, বিষয় বৈচিত্র্য শিশুমনস্তত্ব এ বিষয়গুলোকে প্রাধান্য না দিলে তা ছড়া হয়ে ওঠে না। সমকালীন বিষয়গুলো নিয়ে ছন্দে ছন্দে ছড়া রচনা করতে গিয়ে লেখক জি.এম. জহির উদ্দিন স্বরবৃত্ত ছন্দকেই প্রাধান্য দিয়েছেন এবং বিষয়গুলো এনেছেন শিল্প সুষমায়। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী উত্তম সেন। দাম রাখা হয়েছে ২২০টাকা। প্রকাশ করেছে শৈলী ।
লেখক: প্রাবন্ধিক, বাচিকশিল্পী।











