বাংলাদেশের সংগীত ভুবনে জিলু খান নামটি বরাবরই নেপথ্যের একটি নাম। ক্যাসেটের কভারে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে গায়ক যদি বলেন, তাহলে এই নামটি আমরা শুনি। বলা যায়, কাগজে–কলমে ও কানে শোনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ এই নামটি।
জিলু খানকে দেখার ইচ্ছে, তাঁকে জানার আগ্রহ বেশ কয়েক বছর ধরে ঘুরঘুর করছিল। সমস্যাটা হলো, তিনি থাকেন ঢাকায়। চট্টগ্রামে থাকলে হয়তো বাসার দুয়ারে গিয়ে বসে থাকতাম। যা হোক, অবশেষে সেই দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবসান ঘটলো। মাসখানেক আগে ঢাকার গুলশানে ‘১৩৮ ইষ্ট’ নামে একটি ক্যাফেতে জিলু খানকে সামনাসামনি দেখলাম। কথা হলো। প্রাণ খুলে স্মৃতিচারণ করলেন। আমরা তিনজন গুণমুগ্ধ শ্রোতা হয়ে শুনেই গিয়েছি। সেইদিনের আলাপচারিতায় ছিলেন দেশের বরেণ্য গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী ভাই এবং রেনেসাঁর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ড্রামার, সুরকার, গায়ক শাহবাজ খান পিলু ভাই। মূলতঃ নকীব ভাই এবং পিলু ভাইয়ের আন্তরিকতায় শ্রদ্ধেয় জিলু খানের সাথে কথা বলার সুযোগ হয়েছে।
বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকে একটি গান কালজয়ী হয়ে আছে। ভাবলেই আনন্দিত হই। আর শুনলেই পুলকিত হই। সেই গানটি হচ্ছে :
“মন শুধু মন ছুঁয়েছে
ও সে তো মুখ খুলেনি
সুর শুধু সুর তুলেছে
ভাষা তো দেয়নি।”
সোলস–এর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান এটি। বলা যায়, গানটি সোলস–এর ব্র্যান্ড গান। এখনো এই গানটি ছাড়া সোলস–এর অনুষ্ঠানই হয় না। এই কালজয়ী শব্দের তকমা লাগানো গানটির সুরকার হলেন জিলু খান। কী অসাধারণ সুর। কয়েক প্রজন্ম ধরে গানটি গাইছে। এমন জাদুকরী সুর সৃষ্টি করে জিলু ভাই আমাদের মাঝে পরম শ্রদ্ধার আসনে আছেন। আর এই গানটির গীতিকার হলেন তাঁরই ছোটভাই নকীব খান। এই দুই ভাই মিলে এমন একটি গান সৃষ্টি করলেন, যার মোহে আজও মোহিত শ্রোতা।
জালালউদ্দিন খান। জিলু খান নামেই পরিচিত। জন্ম : ১৭ আগস্ট ১৯৪৯। পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামের চুনতি গ্রামে, বিখ্যাত দারোগা বাড়ি। শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চায় সুখ্যাতি আছে দারোগা বাড়ির। বংশ পরম্পরায় সংগীতের সাথে এই বাড়ির সদস্যরা যুক্ত থেকেছেন। জিলু ভাইয়ের বাবা, দাদা, নানা সকলেই গানের সাথে সম্পৃক্ত। দারোগা বাড়ির একটা রেওয়াজ ছিলো: বিয়েতে জামাইকে বরণ করে নেয় গান গেয়ে। আর এই গান গাওয়ার জন্য আগে থেকেই মহড়া চলতো। বিয়ে উপলক্ষে আয়োজন করা হতো গান, নাটকের অনুষ্ঠান। দাদা মরহুম মোহাম্মদ ইউনুস খান, বাবা মরহুম আইয়ুব খান, নানা বদরুল কবীর খান সিদ্দিকী– এঁরা সকলেই গান লিখতেন। সুর করতেন। সুতরাং, বলা যায় এমন সুন্দর এক পারিবারিক আবহে জিলু ভাইয়ের বেড়ে ওঠা। জিলু ভাইয়ের যখন দশ বছর, তখন উনার মেজ খালার বিয়ে উপলক্ষে প্রথম তিনি হারমোনিয়ামে সুর তোলেন। যা বিয়েতে জামাই বরণে গেয়েছিলেন। শৈশবের এই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা জিলু ভাই পরবর্তী সময়েও গানের সাথেই যুক্ত থেকেছেন।
এই সময়ে একটি মজার স্মৃতিচারণ করলেন জিলু ভাই। তাঁর ছোট ভাই নকীব খান খুব ছোট। কান্না করতো খুব। একদিন জিলু ভাই তাঁর বাবাকে বললেন, একটি হারমোনিয়াম এনে দেন। হারমোনিয়ামের সুর শুনলে কান্না থামবে। বাবা এনে দিলেন। জিলু ভাই বাজানোর পর ঠিকই ছোট ভাই নকীবের কান্না বন্ধ হয়ে গেল। এই স্মৃতিচারণে চমকিত হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ছোট্ট শিশু নকীব খানের ধমনীতে এভাবেই সুর মিশে গেল। যা পরবর্তীতে আমরা দেখলাম, নকীব খানের সুরকার ও গায়ক হয়ে বিখ্যাত হয়েছেন। বংশের ধারায় নকীব খানও আজ প্রতিষ্ঠিত একজন সংগীতশিল্পী।
ষাটের দশকে জিলু ভাই চট্টগ্রাম কলেজে পড়াকালীন সময়ে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে গেলেন সংগীত চর্চায়। চট্টগ্রাম কলেজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিটার, তবলা বাজিয়েছেন। গান গেয়েছেন। ঐ সময়ে চট্টগ্রাম কলেজে গড়ে উঠে জিংগা শিল্পী গোষ্ঠী। শাফক্বাত জামানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই সংগীত দলে জিলু ভাইও যুক্ত হলেন ১৯৬৪ সালে। ছিলেন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত। অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন স্যার তখন চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যাপক। তিনি জিংগার রিহার্সাল দেখতে আসতেন। পরামর্শ দিতেন। পরবর্তী সময়ে জিংগা শিল্পী গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে জিলু ভাই বন্ধুদের নিয়ে “হিন্দোল” নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়লেন। এই দলে তিনি একোডিয়ান বাজাতেন। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান স্যারের লেখা তিনটি গান সুর করলেন। বড় পরিসরে এটাই ছিল নতুন যাত্রা। ১৯৬৭ সালে রেডিওতে তালিকাভুক্ত সুরকার হলেন। ১৯৬৯ সালে ছাত্র লীগের আয়োজনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। জিলু ভাই ছিলেন দায়িত্বে। সফল অনুষ্ঠান হয়। ঐ সময়ে বন্ধু হেনা ইসলামের লেখা গান সুর করেন। গানগুলোও জনপ্রিয় হয়।
১৯৭২ সালে লালদীঘি ময়দানে ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বিশাল অনুষ্ঠান হয়। জিলু ভাই ছিলেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দায়িত্বে। পরবর্তীতে কানুনগো পাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিচয় হয় প্রবাল চৌধুরীর সাথে। জিলু ভাইয়ের সুরে গান গেয়ে প্রবাল চৌধুরী পরবর্তীতে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
১৯৭২ সালে জিলু ভাই গড়ে তোলেন “বালার্ক” নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। এর সাথে যুক্ত ছিলেন প্রবাল চৌধুরী, উমা ইসলাম, খসরু, মিলন, দেবব্রত, রফিক, হাসনাইন, লাবু, তসলিম, রশিদ, বাহাদুর, নকীব খান ও শাহবাজ খান পিলু। চট্টগ্রামের বিভিন্ন ক্লাবে, অনুষ্ঠানে বালার্ক নিয়মিত পরিবেশন করেছে। তখন ভারতীয় বাংলা আধুনিক, ইংরেজি গানই গাওয়া হতো।
১৯৭৩ সালে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। স্মৃতি রোমন্থন করলেন জিলু ভাই। বললেন: ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন অপসারণের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি যুদ্ধ জাহাজ আসে। তখন সেই জাহাজের এক নৌ অফিসার আমায় ডেকে বললেন: “তোমরা কেন ইংরেজি গান করো। এত সুন্দর দেশ– প্রকৃতি। নিজস্ব গান গাইতে পারো।” কথাটা মনে দাগ কাটে। বালার্ক তখন থেকে মৌলিক গান পরিবেশনের দিকে আগ্রহী হয়ে ওঠে। গীতিকার হেনা ইসলামের কথা ও জিলু খানের সুরে বেশ কিছু গান তৈরি হয়।
পরবর্তী সময়ে জিলু খান উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য ঢাকা চলে গেলেন। বালার্ক–ও আর চলমান থাকলো না। ততদিনে ছোট দুই ভাই নকীব খান এবং শাহবাজ খান পিলু বড় হয়ে উঠছেন। সংগীতের ধারা তাঁদের হাতে তুলে দিয়ে ঢাকাবাসী হয়ে গেলেন জিলু খান। তারপর লেখাপড়া শেষে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত হন। নানান কাজের চাপে আর গানের জগতের সাথে যুক্ত থাকতে পারলেন না তিনি। তবে চট্টগ্রামে থাকা অবস্থায় ফাঁকে ফাঁকে বেশ কিছু গানের সুর করেছেন। যার মধ্যে আছে
♦ মন শুধু মন ছুঁয়েছে
♦ সুখ পাখি আইলো উড়িয়া
♦ মনে করো এখন অনেক রাত
♦ তোমার ঘরে উৎসব আজ
♦ সাতকাইন্যার থুন নোয়া বউ আইস্যে
♦ দরগাহে মোম জ্বেলে কি হবে
♦ আমার সাজানো বাসর গেছে ভেঙে
জিলু ভাইয়ের সুরে কুমার বিশ্বজিৎ–এর গাওয়া “সাতকাইন্যার থুন নোয়া বউ আইস্যে” গানটি লিখেছেন তাঁর পিতৃব্য উমেদ খান। এই গানটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এই বিষয়ে জিলু ভাই বললেন: চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের মধ্যে এক ধরনের ওয়েস্টার্ন ধাঁচ আছে। বিভিন্ন সময়ে ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ইংরেজদের আগমন ঘটে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তাদের ভাষার মিশ্রণ ঘটেছে। সেই সাথে গানেও। যার কারণে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানে বহুমাত্রিক সুর আছে। যা চাটগাঁইয়া গানকে সমৃদ্ধ করেছে। “জিলু ভাইয়ের কথার সাথে দারুণ মিল খুঁজে পেলাম। যেমন, পরবর্তী সময়ে শহীদ মাহমুদ জঙ্গী ভাইয়ের লেখা “ননাইয়া ননাইয়া কথা কই”–গানের ক্ষেত্রে। ওয়েস্টার্ন ব্লুজ ঘরানায় সুর করেছেন নকীব খান। এটি একটি সাহসী বিষয়। আর এই গানটি গেয়েছেন ফয়সাল সিদ্দিকী বগী। রেনেসাঁ ব্যান্ডের প্রকাশিত অডিও ক্যাসেটে গানটি আছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত গানকে ব্লুজ–এর সুরে নিয়ে আসার বিষয়টি জিলু ভাইয়ের কথাকে সমর্থন করে। সবশেষে জানতে চাইলাম নকীব ভাই ও পিলু ভাই সম্পর্কে। হেসে জিলু ভাই বললেন: আমার যেখানে শেষ, সেখানেই নকীব ও পিলুর শুরু। ওদের কাছেই তুলে দিয়েছি সংগীতকে। আপন ভাই হিসেবে বলছি, ওদের বর্তমান অবস্থানে আমি সত্যিই গর্বিত। নকীব এতো বহুমাত্রিক সুরকার, যা আমাকে বিস্মিত করে। ওর সুরের বৈচিত্র্যতা মুগ্ধ করে। আর পিলু তো শাস্ত্রীয় সুরের সাথে আধুনিকতার দারুণ মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। যেমন ধরো: “আজ যে শিশু”–গানটি তো আরও কয়েক প্রজন্ম গাইবে। চলতে থাকবে। সুর নিয়ে তাদের দুইজনের গবেষণা আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। আমার এই দুই ভাইয়ের জন্য অনেক দোয়া। জিলু ভাইয়ের সাথে স্মৃতিচারণ করা ও আলাপচারিতা আমাদের অনেক ঋদ্ধ করেছে। আরও অনেক কিছু জানার আছে। আক্ষেপ শুধু একটাই : জিলু ভাই যদি আরও বছর খানেক গানের সাথে যুক্ত থাকতেন, আমরা আরও সমৃদ্ধ গান পেতাম।
ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে তিনি সময় দিলে, আবারও আলাপচারিতায় মেতে উঠবো। গতকাল ১৭ আগস্ট ছিল জিলু খানের জন্মদিন। তাঁর প্রতি রইলো আমাদের সকলের শ্রদ্ধা ও শুভকামনা।