সাবেক এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পর গতকাল মঙ্গলবার (১১ মে) দুপুরে চট্টগ্রাম মহানগরীর খুলশি এলাকায় পুলিশ ব্যুরো অভ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মেট্রো অঞ্চলের কার্যালয়ে উপস্থিত হন বাবুল আক্তার।
বাবুল আক্তারকে রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের পর তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ নানা অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি করে। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও খবর আসে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। বিডিনিউজ
তবে এ বিষয়ে মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআই-এর কোনো কর্মকর্তাই সরাসরি কিছু বলছেন না।
পিবিআই সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া) আবু ইউসুফ রাত সোয়া ৯টায় বলেন, “বাবুল আক্তারকে তদন্ত কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। তাকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি।”
এরপর বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হলেও তাকে পিবিআই কার্যালয় থেকে বের হতে দেখা যায়নি। গভীর রাতে পিবিআই কার্যালয়ে তালা ঝুলানো ছিল এবং বাবুল ভেতরেই রয়েছেন বলে পিবিআই কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই মেট্রো অঞ্চলের পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা রাতে বলেন, “এ বিষয়ে পরে জানতে পারবেন।”
এর আগে তিনি বলেছিলেন, “হত্যা মামলার বাদী হিসেবে তিনি (বাবুল আক্তার) আমাদের কাছে এসেছিলেন। বিষয়টি তদন্তাধীন হওয়ায় উনার সাথে কী কথা হয়েছে, তা বলা যাবে না।”
বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে পিবিআই প্রধান, পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার সন্ধ্যায় বলেছিলেন, “মামলার প্রয়োজনে আমরা তাকে ডেকে নিয়ে কথা বলছি। এটাকে জিজ্ঞাসাবাদ বা তদন্তের বিষয়ে জানতে চাওয়া, যেকোনো কিছুই বলা যেতে পারে।”
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় সড়কে খুন হন পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু।
পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ সদরদপ্তরে যোগ দিতে ঐ সময় ঢাকায় ছিলেন বাবুল। তার ঠিক আগেই চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশে ছিলেন তিনি।
হত্যাকাণ্ডের পর নগরীর পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন বাবুল আক্তার নিজেই।
শুরুতে মেয়েজামাইয়ের পক্ষে বললেও কিছুদিন পর অবস্থান বদলান বাবুল আক্তারের শ্বশুর পুলিশের সাবেক পরিদর্শক মোশাররফ হোসেন। তিনি অভিযোগ তোলেন, তার মেয়েকে হত্যার পেছনে তার জামাইয়ের যোগসাজশ রয়েছে বলে তার সন্দেহ।
ঐ ঘটনার পর পুলিশের চাকরি ছাড়তে দৃশ্যত বাধ্য হওয়া বাবুল অবশ্য বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।
স্ত্রী হত্যার পর দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে প্রথমে ঢাকায় শ্বশুরবাড়িতে উঠেছিলেন বাবুল। পরে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে ছেলে-মেয়েক নিয়ে আলাদা বাসায় ওঠেন।
চট্টগ্রাম এবং তার আগে কক্সবাজারে বিভিন্ন জঙ্গি অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া বাবুল আক্তারের স্ত্রী ২০১৬ সালে খুন হওয়ার পর জঙ্গিদের দিকেই ছিল সন্দেহের তীর।
কিন্তু তার কিছুদিন পর দৃশ্যপট পাল্টে যায় ঐ বছরের ২৪ জুন গভীর রাতে ঢাকার বনশ্রীর শ্বশুরের বাসা থেকে ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর।
তবে ঐ বিষয়ে পুলিশের স্পষ্ট কোনো বক্তব্য না আসায় নানা গুঞ্জন ডালপালা মেলতে থাকে। বাবুলকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলেও খবর রটে।
পরদিন বিকালে ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পেয়ে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে বাবুল বলেছিলেন, ‘আলোচনা করতে’ তাকে ডেকে নেওয়া হয়েছিল।
তার প্রায় এক মাস পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জানান, এসপি বাবুল চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেছেন।
তারও ২২ দিন পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, বাবুলের আবেদনে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে বাবুলকে নিয়ে সন্দেহের কথা বলেন তার শ্বশুর মোশাররফ।
তিনি বলেন, “এখন যেসব শুনছি, তার কিছুটাও যদি সত্য হয় তাহলে তো বুঝব, স্ত্রী মারা যাওয়ার পর বাবুল আমার বাসায় থেকে অভিনয় করেছে। আসলে তখন তো আপনারা তাকে প্রশ্ন করতে পারেন নাই। আমিই আপনাদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। আসলে ভুলটা আমারই হয়েছে। এটা তার এক ধরনের কৌশল ছিল।”
কেন বাবুলকে সন্দেহ- তার জবাবে তিনি বলেছিলেন, বাবুলের অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বলে তার মেয়েকে খুন হতে হয়েছে।
নিজের এলাকার এক নারীর সঙ্গে বাবুল আক্তারের সম্পর্কের অভিযোগ উঠেছিল তখন। ঐ নারীর স্বামী পুলিশের এসআই আকরাম হোসেন লিটনের মৃত্যুর তদন্তও দাবি করেন মোশাররফ। তার ভাষ্য, ঐ খুনের তদন্ত তার মেয়ে খুনের জট খুলে দিতে পারে।
তিনি তখন বলেছিলেন, “এখন যা শুনছি, এমন অভিযোগ বাবুলের বিরুদ্ধে আজীবন ছিল। শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়-স্বজনরা মাহমুদাকে (মিতু) অত্যাচার করত। ঘটনার ১৫ দিন আগেও বাবুল আক্তারের বাসায় একটা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল। এখন তো ঢাকায়, নোয়াখালী, বিদেশেও তার পরকীয়ার কথা শুনি। বাবুল আক্তারের পরকীয়া, মিতুর সঙ্গে ঝগড়া, মিতুর আত্মহত্যার চেষ্টা করা, ঢাকায় বাবা-মায়ের কাছে চলে আসতে চেয়েও না পারার কথাগুলো তদন্ত কর্মকর্তাকে বিশদভাবে জানানো হয়েছে,” বলেছিলেন তিনি। তখন মামলার তদন্তের দায়িত্বে ছিল ডিবি।
ঐ নারী অবশ্য পরে সংবাদ সম্মেলন করে বাবুলের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেছিলেন।
পুলিশ কর্মকর্তার ছেলে বাবুল আক্তার নানা গুঞ্জনে নীরব থাকলেও শ্বশুরের সন্দেহ প্রকাশের পর এক ফেসবুক পোস্টে জবাব দিয়েছিলেন।
‘সবাই বিচারক, আর আমি তথ্য প্রমাণ ছাড়াই খুনি’ শিরোনামে প্রায় দুই হাজারের বেশি শব্দের ঐ পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, তার শ্বশুর, শাশুড়ি তার নিহত স্ত্রী মিতুর স্কুলপড়ুয়া এক খালাত বোনের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাতে রাজি না হয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসায় তার ওপর ক্ষিপ্ত হন তারা। এতে তারা ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণও হয়েছিলেন। বলেছিলেন, এর পরিণাম হবে খারাপ এবং আমাকে পচিয়ে ছাড়বেন তারা,” লিখেছিলেন বাবুল।
তদন্তের বিষয়ে দক্ষ হিসেবে পরিচিত সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও লিখেছিলেন, “বাস্তব জীবনটা কোনো চলচ্চিত্র না। আমি সুপারকপের মতো উঠে গিয়ে স্ত্রীর খুনি বের করে ফেলব?”