জিওবি ফান্ডে ঋণের শর্ত মন্ত্রণালয়ের

চসিকের নগর ভবন প্রকল্প ফ্লোর বিক্রি করে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা মেয়রের

মোরশেদ তালুকদার | শনিবার , ১ নভেম্বর, ২০২৫ at ৭:৩২ পূর্বাহ্ণ

আধুনিক নগর ভবন নির্মাণে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে ২০২ কোটি ৩৯ লাখ টাকার একটি প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে চসিক। সাড়ে ছয় বছর পেরুলেও প্রকল্পটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়নি। উল্টো প্রকল্পে প্রস্তাবিত জিওবি (সরকারি অনুদান) অংশে ৫ শতাংশ সুদে ঋণের শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। যা পূরণের সামার্থ্য নেই চসিকের। এতে প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় নিজস্ব অর্থে প্রকল্পটি যে কোনোভাবে বাস্তবায়ন চায় চসিক। এক্ষেত্রে ফ্লোর বিক্রি ও ভাড়া দেয়ার পরিকল্পনা করছেন মেয়র। বিষয়টি নিশ্চিত করে চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক রাজধানী। এটা কমার্শিয়াল হাব। গুরুত্বপূর্ণ এই শহরে নগর ভবন নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন না দিয়ে জিওবি ফান্ডে ঋণের শর্ত দিচ্ছে। এই ঋণ পরিশোধের সামার্থ্য কর্পোরেশনের নেই।

তিনি বলেন, প্রকল্প অনুমোদন না দিয়ে জিওবি ফান্ডে ঋণের শর্ত দেয়া চট্টগ্রামের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ। এরপরও নগর ভবন নির্মাণ কাজ শেষ করবো ইনশাল্লাহ। পুরো নগর ভবন তো ২১ তলা হবে। আমার পরিকল্পনা হচ্ছে, একটি ফ্লোর বিক্রি করে দেব এবং মাসে মাসে ভাড়া আদায় করবে কর্পোরেশন। সেখান থেকে যে আয় হবে সেটা দিয়ে কাজ এগিয়ে নেব। তিনি বলেন, নগর ভবনের কাজ দ্রুত শেষ হওয়া উচিত।

কী আছে মন্ত্রণালয়ের শর্তে : চসিক সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পে প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয় ২০২ কোটি ৩৯ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে জিওবি ফান্ড থেকে ১৬১ কোটি ৯১ লাখ টাকা এবং চসিকের নিজস্ব ফান্ড থেকে ৪০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয় প্রস্তাব করা হয়।

চসিকের প্রস্তাবের পর ছয় বছর ঝুলে ছিল প্রকল্পটি। এরপর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি প্রকল্পের আর্থিক দিকটি ভেটিংয়ের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় জিওবি ফান্ডে ঋণের শর্ত জুড়ে দেয়।

শর্ত অনুযায়ীজিওবি অংশের ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ৯৭ কোটি ১৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকা জিওবি ঋণ এবং বাকি ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ৬৪ কোটি ৭৬ লাখ ৫১ হাজার টাকা জিওবি অনুদান হিসেবে দেয়া হবে। এছাড়া শর্ত অনুযায়ী, জিওবি ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হার হবে ৫ শতাংশ। ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের সময়সীমা হবে ২০ বছর। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে ত্রৈমাসিক কিস্তিতে। প্রকল্পটি অনুমোদিত হলে অর্থ বিভাগের সাথে একটি ঋণচুক্তি (এল) সম্পাদন করতে হবে। প্রস্তাবিত ব্যয় মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। চসিকের নিজস্ব তহবিলের অংশের ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবছর নিরীক্ষা প্রতিবেদন যথাসময়ে প্রকাশ করতে হবে।

এদিকে চসিক সূত্রে জানা গেছে, কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন মিলবে এমন আশা থেকে গত বছরের (২০২৪) ৬ মে আন্দরকিল্লায় নগর ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করে চসিক। এক্ষেত্রে প্রথম ধাপে বেইসমেন্টসহ তিনটি ফ্লোর (অবকাঠামোগত) নির্মাণের পরিকল্পনা আছে সংস্থাটির। ২৮ কোটি ৮০ লাখ টাকায় এ কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাহের ব্রাদার্স জেবি মজিদ অ্যান্ড সন্স। গত দেড় বছরে কাজের অগ্রগতি ১০ শতাংশেরও কম হয়েছে বলে চসিকের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

চসিকের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ডিপিপি অনুযায়ী পুরো নগর ভবন নির্মাণ করা হবে ৩৮ হাজার ৪৯০ বর্গফুট বা ৫৩ দশমিক ৪৫ কাঠা জায়গায়। প্রণয়ন নামে একটি কনসাল্টেন্ট ফার্ম এর নকশা করে। নকশা অনুযায়ী এটি হবে ‘আইকনিক’ ভবন। তিনটি বেইসমেন্টসহ পুরো নগর ভবন হবে ২১ তলা। ভবনের ওপরে থাকবে সিটি ক্লক। ভবনের তিনপাশে সাজানো বাগান থাকবে। নির্মাণ করা হবে ফোয়ারা। ৮ম থেকে ২১ তলা সিটি কর্পোরেশনের অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হবে। ভবনের কয়েকটি ফ্লোর বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেয়া হবে। থাকবে মাল্টিপারপাস হল, কনফারেন্স হল ও ব্যাংকুয়েট হল।

জানা গেছে, আন্দরকিল্লা মোড়ে ১৮৬৪৬৫ সালের দিকে নির্মিত হয় নগর ভবন। পর্যায়ক্রমে ওই ভবন থেকেই চসিকের কার্যক্রম পরিচালিত হত। ভবনটি জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠায় ২০০৯ সালে ভেঙে ফেলা হয়। ভেঙে ফেলা ওই ভবনটির পাশে ৬০এর দশকের শেষে তিন তলা একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। যা পরবর্তীতে ছয় তলায় উন্নীত করা হয়। যা নগর ভবন নামে পরিচিত। এ ভবনটি চসিকের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হত। ২০১৯ সালের ২০ জুন তা টাইগারপাসের অস্থায়ী কার্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। ২০২৩ সালে ভাঙা হয় পুরাতন নগর ভবন।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, নগর ভবন নির্মাণে প্রথম উদ্যোগ নেন প্রয়াত মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি ২০১০ সালের ১১ মার্চ নগর ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া শুরু হয়েছিল এর নির্মাণ কাজ। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এ জে কনস্ট্রাকশন নগর ভবনের প্রথম ছয়তলা নির্মাণের কাজ পেয়েছিল ওই সময়। তখন চসিকের নিজস্ব তহবিল থেকে নগর ভবনের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৪৮ কোটি ৮৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। মহিউদ্দিন চৌধুরী চসিক নির্বাচনে হেরে গেলে বন্ধ হয়ে যায় প্রকল্পের কাজ। পরবর্তীতে তিনজন মেয়র এবং একজন প্রশাসক দায়িত্ব পালন করলেও নগর ভবন নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেননি। অবশ্য এ সময়ে উদ্যোগ থাকলেও অর্থ সংকট, মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না পাওয়াসহ বিভিন্ন জটিলতায় সে উদ্যোগ থমকে ছিল।

জানা গেছে, মনজুর আলম মেয়র থাকাকালে ২০১১ সালের ১৩ নভেম্বর ৪৯ কোটি টাকায় ৬২ শতক ভূমিতে ২০ তলা নগর ভবন নির্মাণে প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়। তবে নিজস্ব অর্থে চসিককে নগর ভবন নির্মাণ করতে বলা হয়। এরপর বিভিন্ন জটিলতায় প্রায় তিন বছর কাজ বন্ধ থাকে। ২০১৪ সালে পুনরায় কাজ শুরু হয়। কিছুদিন যেতেই অর্থাভাবে আবারও কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

এছাড়া আ জ ম নাছির প্রকল্প বাস্তবায়নে জনতা ব্যাংকের কাছ থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ চান। এতে আপত্তি জানায় অর্থ মন্ত্রণালয়।

প্রথম প্রকল্প নেয়া হয় ২০১৫ সালে : নগর ভবন নির্মাণে প্রথমে ২০১৫ সালে ৭৪ কোটি টাকায় ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে চসিক। ২০১৭ সালে ডিপিপিটি সংশোধন করা হয় ১২০ কোটি টাকায়। এরপর ২০১৯ সালের র্মাচ মাসে আবারও সংশোধন করে ২০২ কোটি ২৪ লাখ টাকায় ২৩ তলা নগর ভবন নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি সে প্রকল্পও। যা সংশোধন করে ২২৯ কোটি টাকা করা হয়। এরপর ২০২৩ সালের মার্চে মূল প্রকল্প থেকে তিনটি ফ্লোর কমিয়ে ২০ তলা নগর ভবনের ব্যয় প্রস্তাব করা হয় ২০২ কোটি। এ প্রকল্পটিই ঋণের শর্তে পড়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেন্টমার্টিন উন্মুক্ত আজ থেকে সাড়া নেই পর্যটকদের
পরবর্তী নিবন্ধপটিয়ায় অবৈধ ক্রসফিলিং স্টেশন, ২৩৭ গ্যাস সিলিন্ডার জব্দ