এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ভূমি দিতে ১৩৭ কোটি টাকা চাইছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা ক্রসিং পর্যন্ত এলাকায় বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রায় সাত একর ভূমি হুকুমদখল করা হচ্ছে। সিডিএ এই টাকা পরিশোধের ব্যাপারে নীতিগতভাবে একমত। তবে দুটি সরকারি সংস্থার মধ্যে টাকার বিনিময় কীভাবে হবে বা আদৌ টাকার লেনদেন হবে কিনা তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গতকাল শনিবার উচ্চ পর্যায়ের একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় টিম প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছে। এই টিমের রিপোর্টের ভিত্তিতেই ভূমির মূল্য প্রদানের বিষয়টির সুরাহা হবে। টাকার ব্যাপারে সুরাহা না হলেও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অ্যালাইমেন্ট পরিবর্তন জরুরি ছিল। কমিটি এ বিষয়ে একমত হয়েছে। সূত্র জানায়, লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সন্নিকটস্থ টানেল রোড পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। পাঁচ ধাপে ভাগ করে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকায় ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে লালখান বাজার-বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত প্রথম ধাপ, বারিক বিল্ডিং-সল্টগোলা ক্রসিং দ্বিতীয় ধাপ, সল্টগোলা ক্রসিং-সিমেন্ট ক্রসিং তৃতীয় ধাপ, সিমেন্ট ক্রসিং-কাঠগড় চতুর্থ ধাপ এবং কাঠগড় থেকে পতেঙ্গার ল্যান্ডিং পয়েন্ট পর্যন্ত পঞ্চম ধাপ চিহ্নিত করা হয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল শেষ ধাপ থেকে। বর্তমানে ল্যান্ডিং পয়েন্ট থেকে সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত দুটি ধাপের (৪র্থ ও ৫ম) কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই দুই ধাপে গার্ডার স্থাপনের কাজ চলছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা গতকাল জানিয়েছেন, ফ্লাইওভারের এই অংশের কাজ ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের তৃতীয় ধাপ সল্টগোলা থেকে সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত অংশের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলেছে। এই অংশটিতে প্রকল্পের কাজ ৬০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।
প্রকল্পটির দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে চিহ্নিত বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা ক্রসিং পর্যন্ত এলাকার ব্যাপারে বন্দর কর্তৃপক্ষ আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, বিমানবন্দর সড়কের এই অংশটিতে বিদ্যমান সড়কের উপর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হলে বন্দরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। আইএসপিএস কোড অনুযায়ী বন্দরের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুরোধের প্রেক্ষিতে বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা ক্রসিং পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বিদ্যমান সড়কের উপর নির্মাণ না করে ত্রিশ ফুট বাইরে দিয়ে নতুন অ্যালাইমেন্ট তৈরি করা হয়। এতে বন্দর কর্তৃপক্ষের সাত একর এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন পাঁচ একর জায়গা হুকুম দখলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বেশ কয়েকটি বহুতল ভবনসহ নানা স্থাপনাও ভাঙতে হবে। এতে প্রকল্প ব্যয় প্রায় ৪শ কোটি টাকা বেড়ে যাবে।
এর মধ্যে ৬ দশমিক ৬৯ একর ভূমি হুকুমদখল বাবদ বন্দর কর্তৃপক্ষ দাবি করে ১৩৭ কোটি টাকা। বন্দর কর্তৃপক্ষের এই টাকা প্রদানের ব্যাপারে সিডিএ থেকেও নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু সরকারি প্রকল্পের টাকার যোগান সরকারকেই দিতে হবে। টাকার গ্রহিতাও সরকারি প্রতিষ্ঠান। এতে করে সিডিএ থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষকে টাকা দেয়া হবে নাকি টাকা ছাড়া দেয়া হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওই বৈঠকে বিষয়টি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একটি রিপোর্ট দেয়ার জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শওকত হোসেনকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মনিরুজ্জামান মিয়া এবং বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সিডিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সদস্য করা হয়। গতকাল কমিটির সদস্যরা চট্টগ্রামে এসে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নতুন অ্যালাইমেন্ট সরেজমিনে পরিদর্শন করেন।
এ সময় সিডিএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামস, প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান, বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট) জিল্লুর রহমানসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। টিমের সদস্যরা পুরো এলাকা ঘুরে দেখেন এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের আপত্তির যৌক্তিকতা খুঁজে পান। কমিটির সদস্যরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অ্যালাইমেন্ট পরিবর্তনের যৌক্তিকতার ব্যাপারেও একমত হন।
এদিকে বন্দরের ভূমির মূল্য বাবদ ১৩৭ কোটি টাকার ব্যাপারে কমিটি কোনো মতামত দেয়নি। ঢাকায় গিয়ে মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানাবে। কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই টাকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। তবে বেসরকারি পাঁচ একর ভূমি এবং স্থাপনার ক্ষতিপূরণ প্রদান করার ব্যাপারে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে সিডিএ।
প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান গতকাল আজাদীকে জানান, কমিটির সদস্যরা সবকিছু দেখে গেছেন। এখন তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতেই পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। টাকার ব্যাপারে সুরাহা না হলেও বারিক বিল্ডিং থেকে সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় বন্দরের খালি জায়গায় সিডিএ কাজ শুরু করেছে। তিনি বলেন, টাকার ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
সিডিএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামস আজাদীকে জানান, নতুন অ্যালাইনমেন্ট না করে উপায় ছিল না। বন্দর কর্তৃপক্ষ যৌক্তিক কারণেই আপত্তি জানিয়েছিল। এখন বন্দরের আপত্তিতে আমরা রাস্তা থেকে সরে বন্দরের জায়গায় এসেছি। পুরো বিষয়টি সরকারের সামনে উপস্থাপন করা হবে। ভূমির মূল্যের ব্যাপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে তাই বাস্তবায়িত হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট) মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের ৬.৬৯ একর ভূমি প্রয়োজন হচ্ছে। এই ভূমির বাজারমূল্য অনেক। তবে সরকারি নিয়মেই এই ভূমি হুকুমদখল করতে হবে। হুকুমদখলের টাকা প্রদানের ব্যাপারেও সিডিএ নীতিগতভাবে একমত। বন্দর টাকা পেয়ে গেলে আর সমস্যা থাকে না। টাকা ছাড়া ভূমি দেয়ার সাধ্য বন্দর কর্তৃপক্ষের নেই। তবে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে যে নির্দেশনা আসবে বন্দর কর্তৃপক্ষ তা অনুসরণ করবে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ১১ জুলাই একনেক সভায় অনুমোদন দেয়া হয় প্রকল্পটি। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৪০ শতাংশেরও বেশি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান।