বাংলাদেশ জাতীয় নারী ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক জাহানারা আলম এখন অবস্থান করছেন অস্ট্রেলিয়ায়। জাতীয় দলের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা শোনা গিয়েছিল। মাঝে এক বছরেরও বেশি সময় স্বেচ্ছায় নির্বাসনে থেকে দলে ফিরলেও বেশিদিন থাকেননি। পরে চলে যান অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়া থেকেই সমপ্রতি পত্রিকা এবং ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাহানারা আলম তার প্রতি অসদাচরণের নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। জাতীয় দলে খেলার সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন বলে অভিযোগ তুলেছেন জাহানারা আলম। তার অভিযোগের তীর নারী দলের সাবেক নির্বাচক ও ম্যানেজার, সাবেক জাতীয় পেসার মঞ্জুরুল ইসলাম এবং বিসিবির নারী বিভাগের সাবেক ইনচার্জ প্রয়াত তৌহিদ মাহমুদের দিকে। এছাড়াও অভিযোগ তুলেছেন ফিজিও, অধিনায়কসহ কয়েকজন ক্রিকেটার ও সাপোর্ট স্টাফের বিরুদ্ধে। এসব নিয়ে বিসিবিতে বিস্তারিত জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি বলে দাবি সাবেক এই অধিনায়কের। পত্রিকায় ওই সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর বিসিসি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে এসব অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করে। অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন, মনগড়া এবং মিথ্যা দাবি করে বিসিবি জানিয়ে দেয়, এগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও কু–উদ্দেশ্যমূলক। বিসিবি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, তারা নারী জাতীয় দলের নেতৃত্ব, খেলোয়াড় ও ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সমর্থন প্রকাশ করছে। বোর্ডের তদন্তে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যা উক্ত অভিযোগকে সমর্থন করে, এবং বিসিবি দৃঢ়ভাবে দলের পাশে রয়েছে। কিন্তু পরে যখন একজন ক্রীড়া সাংবাদিককে জাহানারা আলম ভিডিও সাক্ষাৎকার দেন এবং টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনের প্রতি যৌন হেনস্তার অভিযোগ তুললেন, তখন টনক নড়ে বিসিবির। এবার তারা পুনরায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানালো, বিসিবি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং এ নিয়ে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে। বিসিবির পক্ষ থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ নারী জাতীয় ক্রিকেট দলের এক সাবেক সদস্যের করা অভিযোগকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজনের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ ওঠার পর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে বোর্ড। বিবৃতিতে বিসিবি আরও জানায়, বিষয়টি সংবেদনশীল হওয়ায় অভিযোগের সত্যতা যাচাই ও বিষয়টি গভীরভাবে তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি আগামী ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশ জমা দেবে। বিবৃতিতে বিসিবি জানায়, খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের জন্য নিরাপদ, সম্মানজনক এবং পেশাদার পরিবেশ নিশ্চিত করতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অভিযোগের তদন্ত শেষে প্রাপ্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান থাকাকালীন সময়ে বিসিবি সব পক্ষকে বিশেষ করে গণমাধ্যমকে অনুমাননির্ভর মন্তব্য, প্রতিবেদন বা বিশ্লেষণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে, যাতে করে তদন্ত কার্যক্রমে কোনো ধরনের প্রভাব না পড়ে। ২০২২ বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলের নির্বাচক ও ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করা মনজুরুল ইসলামের কাছ থেকে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন জাহানারা।
একটি ইউটিউব চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে জাহানারা ইসলাম বলেন, ‘উনি (মনজুরুল ইসলাম) একদিন আমার কাছে আসলেন, আমার কাঁধে হাত রেখে বলছিলেন, তোর পিরিয়ডের কতদিন চলছে। পিরিয়ড শেষ হলে বলিস, আমার দিকটাও তো দেখতে হবে। পিরিয়ড শেষ হলে, যখন ডাকবো চলে আসিস।’ তবে এসব অভিযোগ ‘ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেছেন মনজুরুল। জাহানারার অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় বার্তা সংস্থা এএফপিকে বর্তমানে চীনে অবস্থানরত মনজুরুল বলেন, ‘সব মিথ্যা। আপনি দলের অন্য মেয়েদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন।
এদিকে নারী ক্রিকেট দলের পেসার জাহানারা আলম পাশে দাঁড়িয়ে স্বাধীন তদন্ত কমিশনের আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল। তামিম এক পোস্টে লিখেছিলেন, জাহানারা আলম যে অভিযোগগুলো তুলেছেন, সবগুলোই গুরুতর এবং সেসব সত্যি হলে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। শুধু একজন জাতীয় ক্রিকেটার বা সাবেক অধিনায়ক বলেই নয়, যে কোনো পর্যায়ের ক্রিকেটার হোক বা যে কোনো খেলার ক্রীড়াবিদ কিংবা যে কোনো নারী, কারো প্রতিই এমন আচরণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিসিবি সংশ্লিষ্টদের বাইরে রেখে স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন তামিম। তিনি বলেন, বিসিবি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বটে। তবে আমি মনে করি, এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কিংবা সরকারী পর্যায়ে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত, যেখানে বিসিবি সংশ্লিষ্ট কেউ থাকবেন না, যাতে বিন্দুমাত্র পক্ষপাতের সুযোগ না থাকে। যত দ্রুত সম্ভব এই কমিটি গঠন করা উচিত ও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপারটিকে দেখা উচিত। দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত শেষ করে দোষী যে–ই হোক, যার যতটুকু দায় থাকুক, উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
সরব হয়েছেন আরেক সাবেক ক্যাপ্টেন মাশরাফি বিন মোর্ত্তজাও। গতকাল দুপুরের পর নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে মাশরাফি লিখেছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেট ও গোটা ক্রীড়াঙ্গনের স্বার্থে জাহানারা আলমের প্রতিটি অভিযোগ বিসিবি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে আশা করি। আরও লিখেছেন, আশা করি, বিসিবির তদন্ত কমিটি পুরোপুরি প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করবে এবং অভিযোগের সত্যতা পেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে, যেন এসবের পুনরাবৃত্তি আর কখনো না হয়। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন নিরাপদ হোক সবার জন্য।











