জাহাজ মালিকদের বিরোধ ছড়ালো শ্রমিকদের মাঝেও

বহির্নোঙরে অচলাবস্থা সৃষ্টির আশংকা । কাল একপক্ষের সমাবেশ আহ্বান । চলছে অপরপক্ষের প্রচারণা

হাসান আকবর | সোমবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২৪ at ৮:০৭ পূর্বাহ্ণ

দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন রুটে চলাচলকারী লাইটারেজ জাহাজের সিরিয়াল প্রথা নিয়ে মালিকদের বিরোধে এবার জড়িয়ে পড়ছেন শ্রমিকেরাও। সিরিয়াল প্রথার পক্ষে থাকা জাহাজ মালিকদের পক্ষে আগামীকাল চট্টগ্রামে বড় ধরনের শ্রমিক সমাবেশ আহ্বান করা হয়েছে। অপরদিকে দর নির্ধারণসহ বিভিন্ন বিষয়ের মীমাংসার আগে সিরিয়াল প্রথা নয় এমন দাবিতে সিরিয়াল প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া জাহাজ মালিকদের পক্ষের শ্রমিকেরাও মাঠে রয়েছেন। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর এবং কর্ণফুলী নদীতে সিরিয়াল প্রথার পক্ষে মাইকিং করা হচ্ছে। অপরদিকে বিরোধীপক্ষও সমানতালে নিজেদের প্রচারণা চালাচ্ছে। বিরোধীপক্ষের শ্রমিকদের ‘দালাল’ আখ্যা দিয়ে প্রতিরোধের হুমকি দেয়া হচ্ছে। সবকিছু মিলে বিবদমান দুই গ্রুপের মুখোমুখি অবস্থানে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অচলাবস্থা সৃষ্টি এবং দেশব্যাপী পণ্য পরিবহনে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টির আশংকা করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আমদানিকারকদের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে। অপরদিকে পণ্যের এজেন্টদের পক্ষ থেকে নিজেদের জাহাজে নিজেদের পণ্য পরিবহনের অনুমোদন দিতে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে আবেদন করা হচ্ছে।

সূত্র বলেছে, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে পণ্য পরিবহনে নীতিমালা প্রণয়ন করে প্রজ্ঞাপন জারির পর বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল বা বিডব্লিউটিসিসি’র মাধ্যমে সিরিয়াল প্রথার আওতায় লাইটারেজ জাহাজ চলাচলের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা হয়নি। জাহাজ মালিকদের তিনটি সংগঠনের সমন্বয়ে বিডব্লিউটিসিসি গঠনের কথা হলেও সবাই ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি। সিরিয়াল প্রথা চালু করার আগে কিছু বিষয়ের মীমাংসার দাবি করে চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকেরা বের হয়ে যান।

বিডব্লিউটিসিসির মাধ্যমে সিরিয়াল প্রথা চালু করার পক্ষে অবস্থানকারী জাহাজ মালিকেরা বলেছেন, পুরো সেক্টরটি ধ্বংস হয়ে গেছে। জাহাজ মালিকেরা দিশেহারা। নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় শত শত জাহাজ মালিক শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ভাতাও দিতে পারছেন না। চার শতাধিক জাহাজ ইতোমধ্যে স্ক্র্যাপ করতে কেটে ফেলা হয়েছে। এই সেক্টরটিকে বাঁচাতে হলে বিডব্লিউটিসিসির আওতায় একই সিরিয়ালে জাহাজ চলাচল শুরু করতে হবে।

অপরদিকে বিরোধী অবস্থানে থাকা জাহাজ মালিকদের কথা হচ্ছে, ডব্লিউটিসির ব্যাপক অনিয়ম এবং দুর্নীতিই এই সেক্টরের বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। একই স্টাইলে আবারো সিন্ডিকেট করা হলে শুধু জাহাজ মালিকেরাই নন, দেশের আমদানি খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা আর পুরোনো সিস্টেমে ফিরে যেতে চান না বলেও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। তারা নতুনভাবে নতুন উদ্যোগে সবার স্বার্থ সংরক্ষণ করে সিরিয়াল প্রথা চালু করার পরামর্শ দেন।

জাহাজ মালিকদের এই পরস্পর বিরোধী অবস্থানে এবার জড়িয়ে গেছেন লাইটারেজ জাহাজের শ্রমিকেরাও। শ্রমিকেরাও দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন। বাংলাদেশ লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়ন আগামীকাল পতেঙ্গার চরপাড়া ঘাটে বড় ধরনের শ্রমিক সমাবেশের ডাক দিয়েছে। এতে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দও অংশ নেবেন। ইতোমধ্যে এই সমাবেশের জন্য বিভিন্ন পয়েন্টে পথসভা করা হচ্ছে। যাতে একই সিরিয়ালভুক্ত লাইটারেজ জাহাজ চলাচলের মাধ্যমে নৌ শিল্পকে রক্ষার আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা সিরিয়াল প্রথা অনুসরণ না করে কোনো জাহাজ যাতে চলাচল করতে না পারে সেই ব্যবস্থা নেয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন। অপরদিকে নীতিমালা ঠিকঠাক করার আগে সিরিয়াল প্রথায় যেতে রাজী নন তাদের জাহাজে কর্মরত শ্রমিকদের সাথে বিভিন্ন শিল্পগ্রুপের মালিকানাধীন জাহাজের শ্রমিকেরা যোগ দিয়েছেন। তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নানাভাবে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন। এতে করে জাহাজ মালিকদের পাশাপাশি জাহাজের শ্রমিকেরাও বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। অবস্থান নিচ্ছেন মুখোমুখি। বিষয়টি পরস্পর বিরোধী অবস্থানেই সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি বড় কোন সংকটের দিকে যাচ্ছে তা নিয়েও শংকা প্রকাশ করা হয়েছে। বিশেষ করে গতকাল একাধিক আমদানিকারক বলেছেন, লাইটারেজ জাহাজ চলাচল কোনো কারণে বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্বের নানাদেশ থেকে পণ্য নিয়ে আসা মাদার ভ্যাসেলগুলো বহির্নোঙরে অলস ভাসবে। এতে দেশের আমদানিকারকদের লাখ লাখ ডলার গচ্চা দিতে হবে। আমদানিকারকরা বিষয়টি দ্রুত সুরাহা করার জন্য নৌপরিবহন উপদেষ্টা, নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

এদিকে পণ্যের এজেন্টদের পক্ষ থেকে গতকাল নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে প্রেরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, ডব্লিউটিসির দুর্নীতি, অনিয়ম, জাহাজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অনেক পণ্যের এজেন্টই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে জাহাজ কিনেছেন। নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করে জাহাজ কিনতে হয়েছে। এখন নিজেদের এসব জাহাজে নিজেদের কোম্পানির পণ্য পরিবহনের অনুমোদন দেয়া না হলে পণ্যের এজেন্টদের বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। পণ্যের এজেন্টদেরকে নিজেদের জাহাজ সিরিয়াল প্রথার বাইরে রেখে পরিচালনার অনুমোদন দেয়ার জন্য চিঠিতে আবেদন জানানো হয়েছে।

চট্টগ্রামের একজন শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি বলেছেন, জাহাজ কিভাবে চলবে সেটা আমাদের বিবেচ্য নয়। আমরা কোন ধরনের ঝামেলা ছাড়া প্রতিযোগিতামূলক ভাড়ায় আমদানিকৃত পণ্য হাতে পৌঁছাতে চাই। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, লাইটারেজ জাহাজ নিয়ে কোনো কিছু বলার বা করার এখতিয়ার আমাদের নেই। বহির্নোঙরে কোন জাহাজ থেকে কোন লাইটারেজ জাহাজ পণ্য খালাস করবে বা জাহাজটি কোনো সংগঠন থেকে বরাদ্দপত্র পেয়েছে কিনা সেটা দেখার সুযোগ আমাদের নেই। তিনি বলেন, ইতোপূর্বে ডব্লিউটিসি নামের একটি সংগঠন থেকে আমাদেরকে পত্র দেয়া হলে আমরা বিষয়টি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি। তবে বন্দরের বহির্নোঙর অচল হলে নিশ্চয়ই বন্দর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে হস্তক্ষেপ করবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ গ্রেপ্তার, কারাগারে প্রেরণ
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে আরও ৫১ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত