এক সময় স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করে দেশে লোহার চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ করা হতো। তখন বাংলাদেশে জাহাজ ভাঙা শিল্প ছিলো জমজমাট একটি শিল্প। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপকূলের ২৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছিলো এর বিস্তৃতি। বর্তমানে পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক কারণে অনেক ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সক্রিয় ইয়ার্ডের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০–৩৫ টিতে। তবে এখনো এই শিল্প দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ও হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান করছে। নব্বইয়ের দশকে চীন যখন এই শিল্প থেকে সরে আসে তখন বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো জাহাজ ভাঙার প্রধান গন্তব্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে সীতাকুণ্ড বিশ্বের অন্যতম প্রধান জাহাজ ভাঙার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তখন সীতাকুণ্ড উপকূল বরাবর প্রায় ১৫০টি ইয়ার্ড সক্রিয় ছিল, যার মধ্যে ৫০–৬০টি সারা বছর চালু থাকত। তখন এটি দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতো, যার বার্ষিক টার্নওভার ছিলো প্রায় ১২,৭৫০কোটি টাকা (২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী)। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বৈশ্বিক জাহাজ ভাঙা শিল্পে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিলো এবং ২০২০ সালে বিশ্বের প্রায় ৩৮.৫% জাহাজ এখানে রিসাইকেল করা হয়েছিল। তবে
একসময় বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম জাহাজ ভাঙা শিল্পে নেতৃত্ব দিলেও, বর্তমান সংকটে খাতটি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালে বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মাত্র ১৪৪টি জাহাজ আমদানি হয়েছে যা ২০০৫ সালের পর সর্বনিম্ন। ২০২৪ সালে মাত্র ৯৬৮,০০০ গ্রস টনের (GT) স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে।
জানা যায়, বর্তমানে উচ্চ ডলারের মূল্য, এলসি খোলার জটিলতা এবং স্ক্র্যাপ জাহাজ কম থাকার কারণে শিল্পটি বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে। কারণ উচ্চ শিপিং ভাড়ার কারণে পুরোনো জাহাজগুলো সচল রাখা লাভজনক হওয়ায় স্ক্র্যাপের জন্য জাহাজের সরবরাহ কমে গেছে। অন্যদিকে দেশের ডলার সংকট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নির্দেশনার কারণে ৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি এলসি খুলতে অনুমতির প্রয়োজন হওয়া এবং আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজারের দামের পার্থক্য ও উচ্চ পরিচালন ব্যয়ে (operational cost) মুনাফা কমে যাওয়াও কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে। আবার অনেক ইয়ার্ড আধুনিকায়ন করতে না পারায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে শ্রমিকরাও কর্মহীন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে জাহাজভাঙা শিল্পের শুরুটা ছিলো নাটকীয়। ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম সমুদ্র উপকূলে প্রচণ্ড গতিতে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড়। ওই ঝড়ে সীতাকুণ্ডের শীতলপুর উপকূলে আটকা পড়ে গ্রিক জাহাজ ‘এমভি আলপাইন’। বহু চেষ্টা করেও এই জাহাজকে সাগরে ভাসানো সম্ভব হয়নি। পরিত্যক্ত অবস্থায় উপকূলেই ছিল এটি। এই জাহাজ দেখতে তখন স্থানীয় লোকজনের ভিড় হতো প্রতিদিন। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে তখন এটি ছিলো এক বিস্ময়। ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রাম স্টিল হাউস কর্তৃপক্ষ জাহাজটি কিনে নেয়। সনাতন পদ্ধতিতে জাহাজটি ভেঙে স্ক্র্যাপ লোহা সংগ্রহ করা হয়। এভাবেই জাহাজভাঙা শব্দটির সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মিত্রবাহিনীর বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত পাকিস্তানি একটি জাহাজও পরে স্ক্র্যাপ জাহাজ হিসেবে বিক্রি করা হয়। কর্ণফুলী মেটাল ওয়ার্কস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান জাহাজটি কিনে নিয়ে ভেঙেছিল। ব্যাপারটা লাভজনক হওয়ায় শুরু হয় জাহাজ ভাঙা শিল্পের। এরপর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে রমরমা একটা ব্যবসায় পরিণত হয় সীতাকুণ্ডের জাহাজভাঙা শিল্প। জাহাজভাঙা কারখানা এলাকার মানুষের আয় উপার্জন বাড়তে থাকে। প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। আবার জাহাজের হরেক রকম পণ্যের ব্যবসাও রমরমা হয়ে উঠে। এতে একদিকে বাড়তে থাকে কর্মসংস্থান ও বাড়তে থাকে ব্যবসা বাণিজ্য।
এই শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, জাহাজ আমদানি করে, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫৫ থেকে ৬০টি। জাহাজের নানা পণ্য বেচাকেনার সঙ্গে কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান জড়িত। জাহাজভাঙা শিল্পের বাইরে ব্যবহৃত পণ্য বেচাকেনায় বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু এখন ব্যবসা অনেকটাই মন্দা।
একটি জাহাজের যত লোহা আছে, তার প্রায় সবই পুনর্ব্যবহার করা যায়। ক্ষতিকর বর্জ্য ছাড়া জাহাজের কোনো কিছুই ফেলনা নয়। একটি জাহাজে যেমন বড় আকারের রান্নাঘর থাকে, তেমনি থাকে নাবিকদের আবাসন, চিকিৎসা, স্টেশনারি। আবার জাহাজ চালানোর জন্য থাকে জেনারেটর ও যন্ত্রপাতি। আলপিন থেকে শুরু করে নাটবল্টু, রান্নাঘরের জিনিস থেকে শিল্পকারখানার কাঁচামাল এমন হাজারো পণ্য থাকে পুরোনো জাহাজে।
তবে জাহাজে শিল্পকারখানার কাঁচামাল থাকে অনেক। এর অন্যতম হলো রিরোলিং মিলের কাঁচামাল–ইস্পাত। থাকে বড় পাইপ, যন্ত্রপাতিসহ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, আসবাব, জাহাজের জেনারেটর, বৈদ্যুতিক তার, তৈজসপত্র, শোপিস, ব্যায়ামের সরঞ্জাম, এয়ারকন্ডিশনার, বৈদ্যুতিক পাখা, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, সাউন্ডবক্স, প্রিন্টার, ফটোকপি মেশিন, কম্পিউটার, টেলিভিশন ইত্যাদি। এ ছাড়া রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবে জাহাজের সবচেয়ে দামি অংশ প্রপেলার। বড় জাহাজের প্রপেলার বিক্রি হয় পাঁচ থেকে দশ কোটি টাকায়। তামা, পিতল, মরিচারোধী ইস্পাতের সরঞ্জামের অনেক পণ্যও রপ্তানি হয়।
বর্তমানে এই শিল্পের প্রধান অন্তরায় হলো আন্তর্জাতিক আইন ‘হংকং কনভেনশন’। এই আইন অনুযায়ী শিপ রিসাইক্লিং ইয়ার্ডগুলো গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তর না করলে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করতে পারবে না। আর এ আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকেই বড় ধরনের সংকটে পড়েছে দেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প খাত। এরইমধ্যে ইয়ার্ড আধুনিকায়ন করতে না পেরে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন অনেকে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০১৬ সালে ২৫২টি স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করা হয়। যার ওজন ছিল ৩৪,০৫,০৬৮ টন। ২০১৭ সালে আনা হয় ২০৪টি, ওজন ছিল ২১,২৮,৭৬৩ টন। ২০১৮ সালে ২১৫ টি, ওজন ২৫,৪০,১৭৮ টন, ২০১৯ ২০৬টি, ওজন ২৩,৬০, ৭১৪ টন, ২০২০ ১২৮টি, ওজন ২০,৩৯,৬৬৬ টন, ২০২১ সালে ২৮০টি, ওজন ২৭,২৮,৫৯৭ টন, ২০২২ সালে ১৫০টি, ওজন ১১,৪৫,৩২৪ টন, ২০২৩ সালে ১৭৩টি, ওজন ১০,২২,১১০ টন এবং ২০২৪ সালে ১৪৪টি, ওজন ৯,৬৮,০২২ টন। আর ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে আমদানি হয় ৫৫টি জাহাজ, যার মোট ওজন ৪,৩৯,৯৩৩ টন।
হংকং কনভেনশন অনুযায়ী, গ্রিন ইয়ার্ড চালুর পর ২০২৪ সালের শেষ ছয় মাসে আমদানি হয়েছে মাত্র ৩৮টি জাহাজ। অর্থাৎ গ্রিন ইয়ার্ড বাধ্যতামূলক হওয়ার পর জাহাজ আমদানি আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কভিড সংক্রমণের কারণে বিশ্ববাজারে মন্দা দেখা দেয়ায় জাহাজ ভাঙা শিল্পের পতন শুরু হয়। পাশাপাশি দেশে বড় অংকের এলসি বন্ধ হয়ে যাওয়া ও অভ্যন্তরীণ ডলার সংকট আমদানিতে বড় ধাক্কা দেয়। ব্যাংক ঋণ ও সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় জাহাজ আমদানি কমতে শুরু করলে অনেক ব্যবসায়ী ইয়ার্ড বন্ধ করে দেন। ২০২০ সালের পর থেকে অনেকে ইয়ার্ড বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও এখন হংকং কনভেনশন কার্যকর হওয়ায় কেবল গ্রিন ইয়ার্ডের মালিকরাই আমদানি করতে পারছেন, ফলে স্ক্র্যাপ জাহাজের সংকট আরো বেড়েছে।
বিএসবিআরএ ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ১৭টি ইয়ার্ড গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তরের কাজ সম্পন্ন করেছে। আরো ছয়টি তালিকাভুক্তির শেষ ধাপে রয়েছে।
বিএসবিআরএর সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, ১১৬টি শিপইয়ার্ডের তালিকা থাকলেও প্রাথমিক অনুমোদন রয়েছে ১০৫টির। এর মধ্যে ২৩টি ইয়ার্ড গ্রিন ইয়ার্ডে অন্তর্ভুক্ত হলেও বাজেট সংকটে অধিকাংশই আধুনিকায়নের কাজ শুরু করতে পারেনি। কর্মকর্তাদের অভিমত, বাংলাদেশ ২০২২ সালে হংকং কনভেনশনে স্বাক্ষর করে, যা ২০২৪ সালের ২৫ জুন থেকে কার্যকর হয়েছে। এ কনভেনশনের শর্ত পূরণ না করলে ব্যবসায়ীরা কোনো জাহাজ রিসাইক্লিং ইয়ার্ডে আনতে পারবেন না। ফলে গ্রিন শিপ ইয়ার্ড ছাড়া এ শিল্পে ব্যবসা পরিচালনার আর কোনো সুযোগ নেই, যা এ খাতের জন্য সম্পূর্ণ নতুন বাস্তবতা। যেখানে আগে জাহাজ এনে ইয়ার্ড চালানো যেত, এখন ইয়ার্ড প্রস্তুত না থাকলে জাহাজই আসবে না।
তবে একটি ইয়ার্ডকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে (গ্রিন ইয়ার্ড) ৫০–১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন, যা উদ্যোক্তাদের জন্য বড় আর্থিক চাপ সৃষ্টি করেছে। কারণ ব্যাংকগুলো জাহাজ আমদানিতে ঋণ দেয় কিন্তু ইয়ার্ড আধুনিকায়নে আগ্রহী নয়। যেটা প্রচলিত ব্যাংকিং কাঠামোর সঙ্গে সংঘাত তৈরি করেছে। তাই সংকট মোকাবিলায় ইয়ার্ড উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি বিশেষ ঋণের উদ্যোগ নেয়া খুবই জরুরি। না হয় এই বিশাল শিল্প ও এর সাথে জড়িত লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান ধ্বংস হয়ে যাবে–এইটি নিশ্চিত!
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।












