অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে যাওয়া নকল, জাল–ভেজালের সংবাদ এখন মানুষকে চমক দেয় না। সমাজের সর্বত্র দুর্নীতি আর জাল–ভেজালে সয়লাব। ভেজালের জালে তাল হারিয়ে নাজেহাল হচ্ছেন অনেকেই, কখনও ক্রেতা,কখনও বিক্রেতা এবং বিশেষ করে যারা সম্পৃক্ত নয় অথচ তাদের অজান্তেই তাদের নাম বা তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহারে হচ্ছে।
জাল–ভেজাল যুগ যুগ ধরেই ছিল, বর্তমানেও আছে,ভবিষ্যতেও থাকবে। প্রায় ৮০/৯০ বছর আগে সজনীকান্ত দাস ভেজাল নিয়ে একটি বিখ্যাত ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছিলেন। খুব একটা পার্থক্য না থাকলও সময়ের কারণে চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গুণে–মানে জাল–ভেজাল হয়েছে সমৃদ্ধ এবং প্রসার। নকল, ভেজাল, ভুয়া, জাল, প্রতারণা ইত্যাদি শব্দ আজকাল সবার সয়ে গেছে। সম্পর্কে ভেজাল, জমির দলিল জাল করা নতুন কোন কাজ নয়, এই তথ্য সবার জানা। ওজনে কম দেওয়া, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো অনেক পুরোনো। নকল ঔষধ, নকল টাকা, স্বাক্ষর, সার্টিফিকেটসহ এমন কি, গণতন্ত্রে ভেজাল, নেতায় ভেজাল, সরকারে ভেজাল, স্বর্ণে ভেজাল, মুক্তিযোদ্ধায় ভেজাল, ধর্মীয় কাজে ভেজাল, কথায় ভেজাল, আমাদের বাতাসে ভেজাল (দূষণ),খাদ্যে ভেজাল, নকল প্রসাধনী,পানিতে ভেজাল (আর্সেনিক), প্রতিশ্রুতিতে ভেজাল। আন্দেলন(অধিকার আদায়)ও ভেজাল। এতোসব ভেজালের মধ্যে থেকে আমরা আমাদের সাথেও ভেজাল করতে কুন্ঠাবোধ করি না । দেশে আইন প্রণয়ন হলেও কিছু অসাধু চক্রের সমন্বয়ে নকল–ভেজালের কর্মকাণ্ড চরম গোপনীয়তার সঙ্গে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সারা দেশে। নীতি নৈতিকতার অধঃপতনে অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে একাজে। মানুষের আচরণ থেকে শুরু করে সর্বত্র ভেজাল।
পড়াশোনা ও প্রতিযোগিতা করে সনদ লাভ করা কঠিন ও পবিত্রতম কাজ । কিন্তু অসাধু শ্রেণি ভুয়া সনদ তৈরি ও বিক্রির মাধ্যমে একদিকে মানুষের চিরায়ত প্রচেষ্টার প্রাচীর ভেঙে দিচ্ছে, অন্যদিকে প্রাণসংহারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এতে কেউ সাময়িক লাভবান হচ্ছে, কেউ লোভে পড়ে হেরে যাচ্ছে। আর কারো হচ্ছে সর্বনাশ। জাল সনদ তৈরি ও বিক্রির অভিনব প্রক্রিয়া এবং চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে বহু আগে, যেগুলোতে শুধু জাল ড্রাইভিং সার্টিফিকেটই নয়, জাল পাসপোর্ট, ভিসা এবং নম্বরপত্র ও সনদ তৈরি হয়। যারফলে অনেক নিরীহ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পিতভাবে জড়িয়ে নাজেহাল করা হয়।
শিক্ষাব্যবস্থায় যখন দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে, তখন বিচলিত না হয়ে পারা যায় না। কারণ একটি জাতির মাথা তুলে দাঁড়ানোর জায়গা শিক্ষাব্যবস্থা। জাল সনদ নিয়ে যখন শিক্ষক–বিচারক–ডাক্তার–পুলিশ হন, তখন সেই আদর্শচ্যুত মানুষ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সনদ গ্রহণকারী কি ন্যায়–অন্যায়ের পার্থক্য প্রয়োগ করতে পারে ? জাল সনদ একটি সংক্রামক ব্যাধি, ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র । প্রতিহিংসা বশত অসুস্থ প্রতিযোগিতায় শিক্ষায় নিয়োজিত সনদধারী শিক্ষিতরা সমাজকে কলুষিত করছে। এরা বুদ্ধিদৃপ্ত প্রতিবন্ধী। যেকোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়ার আগে শিক্ষাগত সকল সনদ যথাযথভাবে যাচাই করা প্রয়োজন। যাচাই ছাড়া জাল সনদে নিয়োগ প্রতিরোধ করার জন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার । দেশে জাল সনদ বিক্রেতাদের একটি সামান্য অংশ ধরা পড়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সনদ জাল করা এবং পেশাদারী সনদ ভেজাল করে চোখে ধুলা দেওয়ার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে এর জন্য নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে সঠিক তদন্তের জন্য সক্ষমতা, পেশাদারত্ব গড়ে তোলার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা আমূল পরির্বতন এবং উপযুক্ত আইন প্রয়োগ জরুরি।
জাল সনদের পাশাপাশি জাল টাকার ব্যবসাও বেড়েছে। সারা দেশে কমবেশি সক্রিয় থাকে জাল টাকা তৈরির চক্ররা। ঈদকে সামনে রেখে দেশব্যাপী প্রায় হাজার কোটি টাকার জাল নোট বাজারে ছাড়া হয়। ঈদের সময় এই চক্রের তৎপরতা ব্যাপক আকারে বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে চক্রের কিছু সদস্যকে বিপুল পরিমাণ জাল টাকাসহ আটক করার ঘটনা ছবিসহ প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই হয় না। ঈদের জন্য বসে না থেকে সারা বছর জাল নোট চক্রের অপতৎপরতা রোধে প্রশাসনের উচিত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। জাল টাকা সনাক্ত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপ থাকার পরও দুষ্ট চক্র নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে। প্রতি বছর বিভিন্ন জাল চক্রের শত শত সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হলেও, তাদের অপরাধের বিচার এবং সাজার মাত্রা কী, কেউ জানে না। দৃশ্যমান কোন সাজার কথাও শুনা যায় না। অভিযোগ রয়েছে, শুধু চক্র ধরা আর ‘বিনিময় প্রথা’র মাধ্যমে তাদের মুক্ত করে দেওয়া হয়। যারফলে যুগের পর যুগ এটি ‘লাভজনক ব্যবসায়’ পরিণত হয়েছে।
বিস্ময়কর ব্যপার হচ্ছে, জাল টাকা বা সনদ ব্যবসায়ীরা অনলাইনে সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যবসা করছে। ইনবক্সে যোগাযোগের জন্যও বলা হচ্ছে। অথচ, সাইবার ইউনিট কেন এসব লক্ষ্য করে না? সরকারের নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হচ্ছে দ্রুত এ বিষয়ে দেশের মানুষকে মোবাইল এসএমএস, পত্রিকা, টেলিভিশনের মাধ্যমে বিস্তারিত জানিয়ে সতর্ক করা। ভেজাল খাদ্য বা ঔষধ দেশের এক অন্যতম প্রধান সমস্যা। এ কথা বলাই যায় যে, বতর্মানে দেশের কোনো খাদ্যই শতভাগ ভেজালমুক্ত নয়। ভেজাল খাদ্যের তালিকায় বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে কৃত্রিমভাবে তৈরি খাবারগুলোর সঙ্গে সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রাকৃতিক শাক–সবজি ও ফলমূলের নাম। বেশ কিছুদিন আগেই গুঁড়ো দুধে মেলামাইন এক আলোচিত ইস্যু ছিল। এখনো গুঁড়ো দুধ আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করা হয়নি। এছাড়া অন্যসব খাবারেও ভেজাল মেশানো থেমে নেই। বিশুদ্ধ খাবারের সঙ্গে কোনো ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের কিংবা অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের দ্রব্যাদি মিশিয়ে ভেজাল খাদ্য বাজারজাত করা হচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পুঞ্জীভূত শক্তির আধার ভেজালের কারণে বাংলাদেশের মানুষ আজ বিবিধ রোগব্যাধিতে নাকাল হচ্ছে। এ থেকে প্রমাণ হয়, কতিপয় মানুষ আর মানুষ নেই। সবাই প্রতিনিয়ত ভেজাল খাবার খাচ্ছে এবং নিজেদের অজান্তেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যারা ভেজাল খাদ্য বাজারজাত করছে তারাও কিন্তু কোনো না কোনোভাবে ভেজাল খাদ্যই খাচ্ছে। সমাজের কেউই বিষাক্ত খাবারের হাতে থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টির সঙ্গে আমাদের সবার স্বার্থ নিবিড়ভাবে জড়িত। তাই সকলের উচিত ভেজাল খাদ্য বাজারজাতকরণ বন্ধের লক্ষ্যে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসা। ভেজাল খাদ্যের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন, এবং ভেজাল খাদ্যে ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সবার মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভেজাল খাদ্য বাজারজাত বন্ধ করা। সাথে সাথে এটাও মনে রাখতে হবে, জাল–ভেজাল–নকলের পিছনে কারা আছে তা জানা । কারণ বাজার দখলের জন্য বাইরের ষড়যন্ত্র বা দেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা বা দেশের বাইরে অপ্রচারে হয়তো এরা লিপ্ত।
জাল–ভেজাল আমাদের জীবনে অনিবার্য হয়ে গেছে। নীতি–নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে দেশে জাল–ভেজাল প্রসারিত। নানা ফন্দিফিকিরের ফলে জাল–ভেজাল এখন পেশায় পরিণত। বর্তমানে দেশে ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিস পাওয়া নিতান্তই দুর্লভ ব্যাপার। নকল আর ভেজালের কারণে সবকিছুই যেন ‘খাঁটিত্ব’ হারিয়েছে, সবখানে সবকিছুতেই পুরোদমে ভেজাল। এত সব ভেজালের মধ্যে আমাদের মানবিক সম্পর্কে পর্যন্ত ভেজাল ঢুকে গেছে। ভেজাল আবেগ, ভেজাল মানবিক অনুভূতি ছন্দে ছন্দে বেজে উঠলেও জীবনের ছন্দপতন ঘটাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভেজালিয়াতির অক্টোপাস যেভাবে আমাদের চারদিক থেকে চেপে ধরেছে, তার থেকে রেহাই পাওয়ার পথ হারিয়ে ফেলছে সমাজ।
কিছু অসাধু ব্যবসায়ী যেভাবে ভেজালের জাল বিস্তৃত করে রেখেছে তা থেকে সাধারণ জনগণকে মুক্তি দিতে সম্মিলিত ভাবে এই কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করা দরকার। শুধু মাঝেমধ্যে কিছু অভিযান পরিচালনা করে জনগণকে ভেজালের হাত থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন বছরব্যাপী পরিকল্পিত অভিযান। রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে জনগণ। জনগণ সচেতন থাকলে কোনো অনিয়ম দুর্নীতি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। জাল সনদ,ভেজাল খাদ্য, নকল ঔষধ বা প্রসাধনী রোধ করতে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন ও আইন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়েরও প্রয়োজন।
সন্দেহাতীতভাবে জাল–ভেজাল–নকল যে নামেই দেয়ই না কেন, এটি জাতীয় সমস্যা। শুধু কঠিন থেকে কঠিনতম আইন পাস করলেই চলবে না প্রয়োজন তার যথাযথ বাস্তবায়ন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সনদ, নিরাপদ খাদ্য–ঔষুধ সামগ্রী নিশ্চিত করতে সকলকে সচেতনতার সাথে স্বীয় দায়িত্ব পালন করতে হবে। ভেজাল মুক্ত সমাজ নিশ্চিত করার জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া, পণ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, সরবরাহ ও বিপণন প্রতিটি পর্যায়ে সচেতনতা এবং নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা প্রয়োজন। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিরাপদ বাংলাদেশ তৈরি করা অবশ্যই সম্ভব।
লেখক : উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি এবং টেকসই উন্নয়নকর্মী